দশ লক্ষ মানুষের জন্য রয়েছে একটি মাত্র ব্লাড ব্যাঙ্ক। মহকুমা হাসপাতালের সেই ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে ২৪ ঘণ্টা রক্ত পেতে পারে একমাত্র ওই হাসপাতালই। কাজের দিনে একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই পরিষেবা দেওয়া হয় শহরের নার্সিংহোমগুলিকে। রবিবার-সহ সরকারি ছুটির দিনগুলিতে ওই ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে কোনও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে রক্ত দেওয়ার নিয়ম নেই। নার্সিংহোমগুলিতে ভর্তি থাকা কোনও রোগীর রক্তের জরুরি প্রয়োজন পড়লে, নিয়ম মেনে মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি হলেই হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে রক্ত পাবেন তিনি। কিন্তু নার্সিংহোম থেকে ছুটি নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স জোগাড় করা বা হাসপাতালে ভর্তি প্রক্রিয়ার বিভিন্ন কাজকর্ম সারতে যতটা সময় লাগবে, ততক্ষণে যে রোগীর প্রাণসংশয় অবধি হতে পারে, সম্প্রতি কালনা শহরের স্নিগ্ধা সাহা নামে এক পার্শ্ব শিক্ষিকার মৃত্যু সেই প্রশ্নই তুলে দিল।
সম্প্রতি কালনা শহরের একটি হাসপাতালে প্রসববেদনা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন একটি স্কুলের পার্শ্বশিক্ষিকা স্নিগ্ধা সাহা। তাঁর স্বামী দেবাশিসবাবু জানান, প্রসবের পর রক্তের প্রয়োজন পড়ে তাঁর স্ত্রীর। কিন্তু রবিবার থাকায় নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ মহকুমা হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে প্রয়োজনীয় রক্তের ব্যবস্থা করতে পারেননি। বাধ্য হয়ে স্নিগ্ধাদেবীকে মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। কিন্তু ততক্ষণে অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যু হয় স্নিগ্ধাদেবীর। দেবাশিসবাবুর আক্ষেপ, “সময় মতো রক্ত পেলে হয়তো এভাবে মরতে হত না স্নিগ্ধাকে।” রক্ত না পাওয়ায় কালনা থানা ও কালনার মহকুমাশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগও করেছেন তিনি। মহকুমাশাসক শশাঙ্ক শেঠি বলেন, অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ১০টি নার্সিংহোম রয়েছে কালনা শহরে। কিন্তু কোনওটিরই রক্ত দেওয়ার জন্য নিজস্ব পরিকাঠামো নেই। রোগীদের রক্তের প্রয়োজন হলে নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষকে মহকুমা হাসপাতালের উপর নির্ভর করতে হয়। রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনার (আরএসবিআই) আওতাধীন গরীব মানুষেরা এই বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে নিখরচায় অস্ত্রোপচার করানোর সুযোগ পান। শহরের একটি নার্সিংহোমের মালিক নাসির শেখ বলেন, “সরকারি হাসপাতালের উপর চাপ কমানোর জন্য আরএসবিআই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত রোগীদের নার্সিংহোমে অস্ত্রোপচার করার সুযোগ মেলে। যে দিনগুলিতে মহকুমা হাসপাতাল থেকে রক্ত পাওয়া যায় না, ওই প্রকল্পের আওতায় থাকা রোগীদেরও বাধ্য হয়ে ফিরিয়ে দিতে হয়।” তিনি জানান, ছুটির দিনে যে অস্ত্রোপচারগুলি আগে থেকে ঠিক করা থাকে, তার জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত আগে থেকেই জোগাড় করে রাখা হয়। সরকারি প্রকল্পের আওতায় থাকা রোগীদের জন্য ছুটির দিনে রক্ত সরবরাহের পরিষেবা চেয়ে অতীতে মহকুমাশাসকের কাছে আবেদন জানালেও কোনও ফল হয়নি বলে দাবি নাসিরবাবুর। তাঁর বক্তব্য, “সরকারি ভাবে লাইসেন্স নিয়ে নার্সিংহোমগুলিতে নিজস্ব ব্লাড ব্যাঙ্কের পরিকাঠামো গড়া সম্ভব। কিন্তু তাতে খরচের অনুপাতে ব্যবসা হবে না।” কালনার এসিএমওএইচ সুভাষচন্দ্র মণ্ডলের আশ্বাস, “কালনার কোনও নার্সিংহোম ব্লাড ব্যাঙ্ক গড়তে চাইলে তাকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করা হবে।”
হাসপাতাল সূ্ত্রে খবর, নার্সিংহোমে ভর্তি থাকা রোগীরা মূলত তিন ভাবে রক্ত পেতে পারেন হাসপাতাল থেকে। চিকিৎসক রক্তের প্রয়োজনীয়তার কথা লিখে দিলে ‘ডোনার কাডর্’ জমা দেওয়ার পরে রক্ত দেওয়া হয়। কার্ড না থাকলে ‘ডোনার’ বা রক্তদাতা নিয়ে এসেও রক্ত নিয়ে যাওয়া যায়। যদি ‘ডোনার’ বা ‘ডোনার কার্ড’ কিছুই না থাকে তবে ৫০০ টাকা দিয়ে সরকারি রসিদ নিয়ে কিনতে হয় সেই রক্ত। কাজের দিনে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আবেদনকারীদের আবেদন জমা নেওয়া হয়। আবেদন অনুযায়ী, রক্ত দেওয়া হয় বিকেলে। রবিবার ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিন বন্ধ থাকে এই পরিষেবা। এই দিনগুলিতে হাসপাতালে ভর্তি থাকা কোনও রোগীর রক্তের প্রয়োজন হলে ব্লাড ব্যাঙ্কের টেকনিশিয়ানকে জরুরি ভিত্তিতে ডেকে পাঠিয়ে রক্ত জোগাড় করা হয়।
ঠিক সময়ে রক্ত না পেলে যে স্নিগ্ধাদেবীর মতো অনেক মুমূর্ষু রোগীরই যে প্রাণসংশয় হতে পারে, তা স্বীকার করেছেন কালনার মহকুমা হাসপাতালের সুপার অভিরূপ মণ্ডল। তাঁর দাবি, “মহকুমা হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা থাকা উচিত। কিন্তু পরিকাঠামোর অভাবে হাসপাতালের পক্ষে ছুটির দিনে রক্ত-পরিষেবা দেওয়া যায় না। পরিকাঠামো বাড়ালেই এক মাত্র এই পরিষেবা দেওয়া সম্ভব।” তিনি জানান, বর্তমানে ব্লাডব্যাঙ্কে টেকনিশিয়ান রয়েছেন ৩ জন। তাঁরা ব্লাড ব্যাঙ্কে পরিষেবা দেওয়া ছাড়াও মহকুমার বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্ত সংগ্রহ করার কাজ করেন। ২৪ ঘণ্টার পরিষেবা চালু করতে হলে অন্তত ৫ জন টেকনিশিয়ান দরকার। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনা হয়েছে বলে দাবি তাঁর। সুভাষবাবুর বক্তব্য, “বিষয়টি নিয়ে রোগী কল্যাণ সমিতির বৈঠকে আলোচনা হবে।” |