ভাড়া সেই বাড়লই, পরিবহণ তবু চিন্তায়
বাস ও ট্যাক্সির ভাড়া বৃদ্ধির দাবি যে অযৌক্তিক নয়, দেরিতে হলেও তা মেনে নিল রাজ্য সরকার। বাস-ট্যাক্সির ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল বৃহস্পতিবার থেকেই। ভাড়া বাড়ছে জলপথ পরিবহণেও। তবে ভাড়া বৃদ্ধির যা হার, তাতে পরিবহণ শিল্পের সঙ্কট আদৌ কাটবে না বলেই মনে করছেন এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের অনেকে।
যদিও এই ভাড়া বৃদ্ধির জন্যও সরকারের সঙ্গে কম চাপাচাপি চলেনি বছরখানেক ধরে। বাস ও ট্যাক্সির মালিকরা বলে আসছিলেন, ডিজেল, যন্ত্রাংশ ও অন্য খরচ গত কয়েক বছরে বহু গুণ বেড়েছে। এখনই ভাড়ায় গাড়ি চালাতে লোকসান হচ্ছে। বসে যাচ্ছে বহু বাস-ট্যাক্সি। এ রকম চললে কর্মহীন হয়ে পড়বেন এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে যুক্ত কয়েক লক্ষ পরিবার।
তবু অনড়ই ছিল রাজ্য সরকার। আরও স্পষ্ট করে বললে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে কারণে, পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র কখনও কবুল করেছেন, ভাড়া না বাড়িয়ে উপায় নেই। আবার কখনও দল ও সরকারের নেত্রীর মত বুঝে হুমকি দিয়েছেন, “বাস চালাতে না পারলে পারমিট ফেরত দিন। সরকার অন্যদের দিয়ে বাস চালাবে।” সমস্যা তাতে বেড়েছে বই কমেনি। ক্রমে ক্রমে রাজ্যের বিভিন্ন রুটে প্রায় ৪০ ভাগ বাসই বসে যায়। দুর্ভোগ বাড়তে থাকে নিত্যযাত্রীদের।

কাল ছিল পথ খালি...। বুধবার বিকেল সওয়া চারটে।
সুনসান শ্যামবাজার মোড়। দেখা নেই বাসের। ছবি: দেবাশিস রায়
এরই মধ্যে দক্ষিণ শহরতলির বজবজ এলাকার কয়েকটি বাসরুটের যাত্রীরা নিজেরাই ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। কার্যত যাত্রীদের চাপে সরকারি নীতির উল্টো পথে হেঁটে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিবহণ দফতর ওই রুটে বাড়তি ভাড়া অনুমোদন করে। কারও কারও মতে এর পিছনে রাজ্য সরকারেরই কৌশলগত সায় ছিল। মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধে লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত বাস ট্যাক্সির চাকা বন্ধ না করলেও পরিবহণ মালিকদের সংগঠনগুলি এর পর খোলাখুলিই বলতে শুরু করে, এ বার নিজেদেরই রাস্তা খুঁজে নিতে হবে। যাত্রীদের সমর্থন নিয়ে বা অটোরিকশার মতো নিজে থেকেই ভাড়া বাড়ানোর পথে না হাঁটলে এমনিতেই অচল হয়ে পড়বে বাস-ট্যাক্সি। সঙ্কট এই রকম তীব্র হয়ে ওঠায় ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় সরকারের অন্দরেও।
পরিবহণের সমস্যা সমাধানে সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গড়ে দেওয়া মন্ত্রিগোষ্ঠীর সদস্য পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য এ দিনের সিদ্ধান্তকেও ভাড়া বৃদ্ধি বলতে নারাজ। তাঁর কথায়, “এটা ভাড়া বৃদ্ধি নয়, আয় বৃদ্ধি। গত দেড় বছরে ক’বার তেলের দাম বেড়েছে বলুন তো! আমরা কিন্তু এই সময়ে ভাড়া বাড়াতে দিইনি। যাত্রী এবং মালিকদের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দাবি অনেক ছিল। কিন্তু সব দিক বিবেচনা করে, বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার যুক্তিতে বাস-ট্যক্সির ভাড়া বাড়ালেও, রাজ্য সরকার কিন্তু এখনও রেলের ভাড়া বাড়ানোর বিরুদ্ধে সরব। শিল্পমন্ত্রীকে এ দিন প্রশ্ন করা হয়, আয় বাড়ানোর জন্য রেল মন্ত্রক যদি ভাড়া বাড়ায়, আপনারা কি তা সমর্থন করবেন? জবাবে পার্থবাবু বলেন, “রেল আর বাস এক নয়। এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে রেল খরচ কমাতে পারে। রেলমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মুকুল রায় তা প্রমাণ করেছেন। তাই রেল ভাড়া বাড়ালে সেটা অনুচিত কাজ হবে। এই কারণে, রেলমন্ত্রীর পদ থেকে দীনেশ ত্রিবেদীকে সরেও যেতে হয়েছিল।”
ভাড়ায় আমরা-ওরা
এটা ভাড়া বৃদ্ধি নয়, আয় বৃদ্ধি। গত দেড় বছরে ক’বার তেলের দাম বেড়েছে বলুন তো!
অনেক জায়গা আছে যেখানে রেল খরচ কমাতে পারে। রেল ভাড়া বাড়ালে অনুচিত হবে।
পার্থবাবুর এই বক্তব্যে স্ববিরোধ দেখতে পাচ্ছেন অনেকে। রাজ্য প্রশাসনেরই একটি অংশ প্রশ্ন তুলছে, রেলে যদি খরচ কমানোর সুযোগ থাকে তবে রাজ্যের সরকারি পরিবহণেও তো সেই সুযোগ রয়েছে। তবে কেন সরকারি পরিবহণে ভাড়া বাড়াল রাজ্য? পরিবহণ দফতরের অফিসাররা বলছেন, “অর্থনীতির যুক্তি না মেনে সরকারি নীতি তৈরি করা হলে তাতে সাধারণ মানুষের ক্ষতি হবেই। রাজ্য সরকার জেদ করে পরিবহণ শিল্পে ভয়ঙ্কর সঙ্কট ডেকে এনেছে। এখন তা থেকে বেরিয়ে আসতে ভাড়া বাড়ানো ছাড়া তাদের সামনে আর কোনও উপায় ছিল না।”
লক্ষ্মীপুজোর পরে বাস-ট্যাক্সির মালিকদের পক্ষ থেকে চাপ আরও বাড়ছে বুঝেই বুধবার সকালে পরিবহণমন্ত্রী, পরিবহণ সচিব ভগবতীপ্রসাদ গোপালিকা, মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, পরিবহণ দফতরের মন্ত্রিগোষ্ঠীর সদস্য অমিত মিত্র এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানেই ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাবে সিলমোহর দেন মুখ্যমন্ত্রী। বৈঠকে একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত হয়, বাম আমলে ভাড়ার যে ধাপ তৈরি করা হয়েছিল, তার পরিবর্তন করা হবে। মুখ্যমন্ত্রীর সিলমোহর পেয়ে মহাকরণে সাংবাদিক বৈঠক করে ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
নতুন ভাড়ার যে তালিকা প্রকাশ হয়েছে, তাতে সরকারি এবং বেসরকারি বাসে প্রথম ৪ কিলোমিটারের ভাড়া ছিল ৪ টাকা। এখন ৩ কিলোমিটার পর্যন্ত ভাড়া হবে ৫ টাকা। মিনিবাসে প্রথম ২ কিলোমিটার লাগত ৫ টাকা। এখন সর্বনিম্ন ভাড়া ৬ টাকা, তবে ৩ কিলোমিটার পর্যন্ত। এর পর থেকে দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়ার ধাপ পাল্টে যাওয়ায় বৃদ্ধির হার হচ্ছে ১ টাকা থেকে ৩ টাকা পর্যন্ত। দূরপাল্লার সাধারণ বাসে ৬ কিলোমিটার পর্যন্ত ভাড়া হচ্ছে ৬ টাকা। এক্সপ্রেসে ৮ টাকা। এর পরে প্রতি কিলোমিটার ১০ পয়সা হারে ভাড়া বাড়বে। ভিন্ রাজ্যের বাসের ক্ষেত্রে প্রথম ৬ কিলোমিটার পর্যন্ত ন্যূনতম ভাড়া থাকছে ১০ টাকা।

সরকারি এবং বেসরকারি বাস
ছিল
দূরত্ব
০-৪
৪-৮
৮-১২
১২-১৬
১৬-২০
২০-২৪
ভাড়া
৪.০০
৬.০০
৬.০০
৭.০০
৭.০০
৮.০০
হল
দূরত্ব
০-৩
৩-৬
৬-১০
১০-১৬
ভাড়া
৫.০০
৭.০০
৮.০০
৯.০০
* এর পর প্রতি তিন কিলোমিটারে
১.০০ টাকা করে বাড়বে

মিনিবাস
ছিল
দূরত্ব
০-২
২-৬
৬-১০
১০-১৪
১৪-১৮
১৮-২২
২২-২৬
ভাড়া
৫.০০
৬.০০
৭.০০
৮.০০
৯.০০
১০.০০
১১.০০
হল
দূরত্ব
০-৩
৩-৬
৬-১০
১০-১৬
ভাড়া
৬.০০
৭.০০
৮.০০
৯.০০
* এর পর প্রতি তিন কিলোমিটারে
১.০০ টাকা করে বাড়বে

ট্যাক্সি
প্রথম ২ কিলোমিটার
পরে প্রতি ২০০ মিটারে
অপেক্ষা: প্রতি ২ মিনিট ১২ সেকেন্ডে
২০ কিলোগ্রামের বেশি মাল বইতে
ছিল হল
২২.০০
২.০০
১.০০
৩.০০
২৫.০০
২.৪০
১.২০
৪.০০
* এখন ভাড়া = মিটারে যা ২.৪ + ১ টাকা
• দূরত্ব কিলোমিটারে • ভাড়া টাকায়
কেমন দাঁড়াচ্ছে ট্যাক্সির ভাড়া? পরিবহণ কর্তারা জানান, এত দিন ট্যাক্সিতে উঠলেই প্রথম ২ কিলোমিটার পর্যন্ত লাগত ২২ টাকা। বৃহস্পতিবার থেকে তা ২৫ টাকা হচ্ছে। এর পরে প্রতি ২০০ মিটারে ২ টাকার বদলে ২.৪০ টাকা হারে ভাড়া বাড়বে। প্রতি ২ মিনিট ১২ সেকেন্ড অপেক্ষার জন্য ভাড়া ১ টাকা থেকে বেড়ে হচ্ছে ১ টাকা ২০ পয়সা। ২০ কিলোগ্রামের বেশি মাল নেওয়ার জন্য ভাড়া ৩ টাকা থেকে বেড়ে ৪ টাকা করা হয়েছে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ট্যাক্সির ক্ষেত্রে ভাড়া এর উপরে ২০ শতাংশ হারে বাড়ানো হয়েছে। ১ টাকা থেকে ১.৫০ টাকা ভাড়া বাড়ছে জলপথ পরিবহণেও। পরিবহণ দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, বাড়বে ট্রামের ভাড়াও। দু’এক দিনের মধ্যেই তা ঘোষণা করা হবে।
আপাত ভাবে রাজ্য সরকার ঘোষিত অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হলেও ভাড়া বৃদ্ধির এই হার কি পরিবহণ শিল্পের সঙ্কট কাটাতে পারবে? বাস এবং ট্যাক্সি মালিকরা স্পষ্টই বলছেন, সঙ্কট মিটবে না। জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেটের নেতা সাধন দাস বলেন, “খরচ যে হারে বেড়েছে, তার সঙ্গে ভাড়াবৃদ্ধি আদৌ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তবে কিছুটা ভার লাঘব হল।” সরকারি পরিবহণ নিগমের কর্তারাও বলছেন, নয়া ভাড়ায় ডিজেলের দামবৃদ্ধির ফলে তৈরি হওয়া সঙ্কট মিটলেও সার্বিক ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া যাবে না। বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেটের নেতা দীপক সরকার বলেন, “ভাড়া বৃদ্ধির ফলে বাস মালিকরা সাময়িক ভাবে খানিকটা অক্সিজেন পেল, এ কথা বলাই যায়। কিন্তু নতুন করে কেউ এই ভাড়ায় পরিবহণ শিল্পে আসতে উৎসাহী হবে না।” মিনিবাস কো-অপারেটিভ কো-অর্ডিনেশন কমিটির নেতা অবশেষ দাঁর-ও দাবি, “সঙ্কট কিছুই কাটল না। কারণ, এই বৃদ্ধিতে ক্ষতি সামাল দেওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না।”
অখুশি ট্যাক্সি মালিকদের বিভিন্ন সংগঠনও। আইএনটিইউসি-র ট্যাক্সি ড্রাইভারস অ্যাসোসিয়েশনের নেতা বিমল ঘোষের কথায়, “আমরা এই বৃদ্ধিতে অখুশি। আমাদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী আলোচনা করলে ভাল হত।”
সরকারের এই সিদ্ধান্তে অবশ্য জনগণের উপরে বোঝা বাড়বে বলেই মনে করছে সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন সিটু। সংগঠনের নেতা সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী সেই ভাড়া বাড়ালেন। তবে এত দিন ধরে কেন লোক হাসালেন! এর থেকে ডিজেলের উপরে রাজ্য সরকার যে সেস পায়, তা কমিয়ে দিলে জনগণের উপর থেকে বোঝা কমানো যেত।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.