|
|
|
|
হলদিয়া ছাড়ছে, এবিজি-র সিদ্ধান্তেও হেলদোল নেই |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
আশঙ্কাই সত্যি হল। শেষ পর্যন্ত হলদিয়া ছেড়ে চলেই যাচ্ছে এবিজি।
বুধবার এবিজি কলকাতা বন্দর-কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিল হলদিয়ায় সম্প্রতি যে সব ঘটনা ঘটেছে, তার পরে কাজ গুটিয়ে চলে যাওয়া ছাড়া রাস্তা নেই।
এবিজি-র এই চরমপত্র নিয়ে রাজ্য সরকারের কোনও হেলদোল দেখা যায়নি। মঙ্গলবারেই রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, এবিজি কোনও শিল্প সংস্থা নয়। একটা ঠিকাদার সংস্থা মাত্র। এ দিন এবিজি হলদিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পরে পার্থবাবু বলেন, “রাজ্য সরকারের সঙ্গে এবিজি-র কোনও চুক্তি ছিল না। বন্দরের সঙ্গে ছিল। তাই ওদেরই জিজ্ঞাসা করুন।”
কলকাতা বন্দর-কর্তৃপক্ষ অবশ্য এবিজি-র নোটিস আনুষ্ঠানিক ভাবে গ্রহণ করেনি। তাদের বক্তব্য, এবিজি-কে কাজ করতে হবে হলদিয়ায়। চুক্তি ভেঙে চলে যেতে চাইলে জরিমানা দিতে হবে। কলকাতা বন্দরের চেয়ারম্যান মণীশ জৈন বলেন, “আমরা এবিজি-কে চিঠি দিয়ে আমাদের বক্তব্য জানিয়েছি। আমরা ওদের নোটিস গ্রহণ করছি না। আমরা হলদিয়া বন্দর থেকে ওদের মালপত্র বার করতে দেব না।” হলদিয়ার এই পরিস্থিতির জন্য এবিজি-কেই দায়ী করেছেন তিনি। চেয়ারম্যান বলেছেন, “ওদের ধরে রাখার জন্য আমরা সব চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওদের আচরণে বন্দরের মুখ পুড়েছে, আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। কাজ না করলে সেই ক্ষতিপূরণের টাকা এবিজি-কে মিটিয়ে দিতে হবে।” জানা গিয়েছে, বন্দরে এবিজি-র ৬টি মোবাইল হারবার ক্রেন, ৫০টি ডাম্পার, ২৬টি পে লোডার, ২টি ডোজার, ২টি করে রোড ও রেল ওয়েব্রিজ রয়েছে। যার মূল্য ১৫০ কোটি টাকা। এবিজি কাজ শুরু না করলে কী করবেন? বন্দর চেয়ারম্যান জানান, রিস্ক পারচেজ পলিসি মেনে নতুন করে টেন্ডার ডাকা হবে।
বন্দর-কর্তারা যাই বলুন, হলদিয়ায় কর্মরত এবিজি-র ৩৭৫ জন কর্মী বুঝে গিয়েছেন, তাঁদের কাজ আর থাকছে না। গত তিন দিন কাজ হারানোর আশঙ্কায় তাঁরা আন্দোলন করছেন। এ ক’দিন তাঁরা শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। এ দিন তাঁরা মুখ খুলেছেন মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও।
হলদিয়া বন্দরের পরিস্থিতি যে স্বাভাবিক নয়, তা এ দিন হাইকোর্টের কাছে স্বীকার করেছে কলকাতা বন্দরও। এবিজি কাজ না করায় তাদের যে ক্ষতি হচ্ছে, সে কথাও কবুল করেছে তারা। হলদিয়া ছাড়তে চেয়ে ২৩ অগস্ট এবিজি নোটিস দিয়েছিল বন্দর-কর্তৃপক্ষকে। সেখানে তারা জুলুমবাজির পাশাপাশি, নিজেদের ব্যবসায়িক ক্ষতির কথাও উল্লেখ করেছিল। পরে হাইকোর্টের মধ্যস্থতায় কাজ করতে রাজি হয় তারা। এ দিনকার নোটিসে এবিজি আইনশৃঙ্খলার অভাবকেই দায়ী করেছে। নোটিসের কপি হাইকোর্টেও দিয়েছে তারা। সংস্থার মুখপাত্র বলেন, “বল আদালতের কোর্টে। হাইকোর্ট যা বলবে, সেই মতো চলব।” |
|
বিক্ষোভের ছবি: আরিফ ইকবাল খান |
হলদিয়ার আইনশৃঙ্খলা দেখার দায়িত্বে যাঁরা, সেই জেলা পুলিশ কী করছে? এবিজি-র তরফে এ দিন পূর্ব মেদিনীপুর পুলিশের কাছে তিন অফিসারের বক্তব্য সম্বলিত একটি নোট পাঠানো হয়। ২৭ অক্টোবর রাতে কী ভাবে তাঁদের অপহরণ করা হয়, কোন কোন সময়ে তাঁরা পুলিশকে ফোন করেন, দুষ্কৃতীরা কখন আবাসনে হানা দেয় ৩ অপহৃত অফিসার ভূষণ পাটিল, জগদীশ বেহেরা এবং মনপ্রীত জলি ওই নোটে তা পুলিশকে জানান। পূর্ব মেদিনীপুরের এসপি সুকেশ জৈন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “বিচারাধীন বিষয় নিয়ে মন্তব্য
করব না।” জেলাশাসক পারভেজ আহমেদ সিদ্দিকি-র দাবি, “এবিজি ফ্যাক্স মারফত চিঠি দেয়। যা করার করেছি। ওঁরা কখনও সাক্ষাতে বা ফোনে কথা বলেননি। তা থেকেই বোঝা যায়, ওঁদের কাজ করার মানসিকতা ছিল না।”
২০১০ সালে হলদিয়ায় কাজ করতে আসার পর থেকেই কয়েকটি নির্দিষ্ট মহল থেকে বাধা পেয়ে আসছিল এবিজি। তাদের কর্মীদের হুমকি দেওয়া হয়েছে, জোর করে পদত্যাগপত্র লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে, প্রয়োজনের থেকে বেশি কর্মী নিতে বাধ্য করা হয়েছে। এই সব নিয়েই চলছিল। কিন্তু শনিবার রাতে যে ভাবে বন্দুক ঠেকিয়ে তাদের অফিসারদের অপহরণ করা হল, তার পরে হলদিয়ায় কাজ চালিয়ে যাওয়া নিরাপদ বলে মনে হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছে এবিজি। সংস্থার সিইও গুরপ্রীত মালহি জানিয়েছেন, কর্মীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে না পেরেই তাঁরা চলে যাচ্ছেন। তবে কর্মীদের যে বকেয়া আছে, তা তাঁরা মিটিয়ে দিয়ে যাবেন।
লক্ষ্মীপুজোর দু’দিনের মাথায় গুরপ্রীতের বক্তব্য শুনে এক নিঃশ্বাসে ২০০৮ সালের ৩ অক্টোবরের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে শিল্প মহলের। ওই দিন সিঙ্গুর প্রকল্প গুটিয়ে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার রতন টাটা। বলেছিলেন, দু’বছর ধরে তাঁরা আন্দোলন ও নিগ্রহের সম্মুখীন হয়েছেন। তাঁদের কর্মীদের ভয় দেখানো হয়েছে। কর্মী, ঠিকাদার, ভেন্ডারদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই তাঁদের সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। ২০০৮ সালের ওই সময়টাও ছিল পুজোর মরসুম, ৩ অক্টোবর ছিল ষষ্ঠী।
দু’টি পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য একটাই। রতন টাটা দায় চাপিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে। আর এবিজি-র সিইও গুরপ্রীত মালহি দায় চাপিয়েছেন বর্তমান সরকারের উপরে, যার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে পুলিশের উপরে অনাস্থা জানিয়ে এবিজি হলদিয়া ছাড়তে চলেছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সেই দায়ও পড়ছে এসে মমতার উপরেই। গুরপ্রীত এ দিন বিবৃতিতে বলেন, “কর্মীদের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার বিষয়টি আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসায়িক স্বার্থের চেয়েও। আমরা এমন পরিবেশে কাজ করতে পারি না, যেখানে প্রশাসন আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব নিতে অপারগ।”
এবিজি-র এক মুখপাত্র বলেন, “তিন অফিসারকে বন্দুক দেখিয়ে অপহরণের পরে ভেবেছিলাম রাজ্য সরকারের মনোভাব হয়তো বদলাবে। কিন্তু মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য এবং তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য আমাদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। হলদিয়া বন্দরের সাম্প্রতিক অশান্তির জন্য যিনি মূলত দায়ী, সেই শুভেন্দু অধিকারীর মাথাতেই কার্যত হাত রেখেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এমতাবস্থায় আমরা কাজ করব কী করে?” বিরোধী বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুও একই সুরে বলেন, “ঘটনা পরম্পরা থেকে এটা পরিষ্কার যে, এবিজি-কে তাড়ানোয় তৃণমূল সরাসরি যুক্ত... মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, কিছুই ঘটেনি!”
|
৩১ অক্টোবর
২০১২
গভীর হতাশার সঙ্গে জানাচ্ছি, হলদিয়া থেকে চলে যাচ্ছি।
সাম্প্রতিক ঘটনার পর এ ছাড়া রাস্তা ছিল না। সিদ্ধান্ত কলকাতা বন্দরকেও জানিয়েছি। হলদিয়ায় যে পরিস্থিতির শিকার হয়েছি, তাতে নিজেদের প্রতারিত মনে হচ্ছে। এমন পরিবেশে কাজ করতে পারি না, যেখানে প্রশাসন আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব নিতে অপারগ।
গুরপ্রীত মালহি
সিইও, হলদিয়া বাল্ক টার্মিনালস
(এবিজি-র অংশীদারি সংস্থা) |
|
৩
অক্টোবর
২০০৮
বিরোধী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে
যে হিংসাত্মক আন্দোলন চলছিল, তার জন্যই ন্যানো প্রকল্প সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। গভীর বেদনার সঙ্গে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি। বলেছিলাম, বন্দুক ঠেকালেও যাব না। কিন্তু মমতা তো ট্রিগার টিপে দিলেন! সিঙ্গুর কাণ্ড থেকে যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে।
রতন টাটা
কর্ণধার,
টাটা গোষ্ঠী |
|
|
|
|
|
|
|
|