রাজা বা অবস্থাবিশেষে রানির সহিত মন্ত্রীর পার্থক্য কী? প্রথম জনের ক্ষেত্রে রাজ্যটি আক্ষরিক অর্থেই সম্পত্তি পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত হইলে বাপের সম্পত্তিও বলা চলে কিন্তু দ্বিতীয় জনের ক্ষেত্রে নহে। রাজ্য শাসন করা মন্ত্রীর চাকুরিমাত্র। উঁচু দরের চাকুরি, সন্দেহ নাই, কিন্তু চাকুরিই। পূর্বে যখন রাজাদের আমল ছিল, তখন তাঁহারাই মন্ত্রী নিয়োগ করিতেন, কাজকর্ম অপছন্দ হইলে অর্ধচন্দ্র দিয়া সেই মন্ত্রীদের বিদায়ও করিতেন। গণতন্ত্রের যুগে খাতায়-কলমে আম-আদমিই রাজা। কাহাকেও মন্ত্রী পদে বসানো, এবং প্রয়োজনে তাঁহাকে অর্ধচন্দ্র দেওয়ার অধিকার সাধারণের। অন্যদের তুলনায় বেশি ভোট জোগাড় করিতে পারিলেই মন্ত্রিত্বের চাকুরি জোটে। ২০১১ সালে যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জুটিয়াছে। কিন্তু নির্বাচনে জয়ী হওয়া ইস্তক তাঁহার, এবং দলের, কথামৃতে মনে হইতেছে, যত মানুষ ভোট দিয়াছেন, সকলেই বুঝি ঘাসফুলে বোতাম টিপিয়াছেন। ফলে সকলেই তাঁহার প্রজা। তিনি সর্বশক্তিমান। এবং তিনি সব জানেন। ফলে, কোনও পরামর্শ, কোনও উপদেশে তাঁহার রুচি নাই, বিরোধিতার প্রতি সহনশীলতার তো প্রশ্নই নাই। বাস্তব অবশ্য ভিন্ন। পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের অর্ধেকেরও কম তাঁহার দলকে ভোট দিয়াছিলেন। যদি সত্যই তিনি ১০০ শতাংশ ভোট পাইয়া মন্ত্রিত্বের চাকুরিতে বহাল হইতেন, তবুও তাঁহার আচরণ একই পরিমাণ নিন্দনীয় হইত। কিন্তু তাহা ভিন্ন প্রশ্ন। আপাতত, তিনি সর্বজনের নেত্রীই নহেন।
তিনি যে নিছকই মন্ত্রী, এই কথাটি বিস্মৃত হইয়া নিজেকে রানি ভাবিয়া বসিলে এক ধরনের প্রমত্ততা অবশ্যম্ভাবী। অ্যালিস-এর দেখা হরতনের বিবির কথা স্মরণ করিতে পারেন। তাঁহার অপছন্দ বলিয়া লাল গোলাপকে সাদা রঙ করিয়া রাখা হইত। বিবি ইচ্ছামত লোকের মুণ্ডচ্ছেদের আদেশ করিতেন। সত্য বটে, আক্ষরিক অর্থে মুণ্ডচ্ছেদের আদেশ এই রাজ্যে এখনও প্রকাশ্যে শোনা যায় নাই। রানির যখন যাহা মনে হইয়াছে, বলিয়াছেন। কখনও বিচারব্যবস্থাকে কটাক্ষ করিয়াছেন, কখনও প্রধানমন্ত্রীকে ভেঙচি কাটিয়াছেন। ধর্ষণ হইলে তাহাকে ‘সাজানো ঘটনা’ বলিয়াছেন, অপ্রিয় প্রশ্ন করিলেই প্রশ্নকর্তাকে মাওবাদী বলিয়া দাগাইয়া দিয়াছেন, ব্যঙ্গচিত্র পাঠাইলে তো কথাই নাই। হলদিয়ায় যে কোনও গণ্ডগোল নাই, এবং রাজ্য সরকার জমির কোনও ব্যবস্থা না করিলেও যে শিল্পকর্তারা পশ্চিমবঙ্গে আসিতে লাইন লাগাইবেন তিনি এই রকম হরেক রূপকথায় বিশ্বাস করেন, এবং অন্য কেহ বিশ্বাস না করিতে চাহিলেই বকিয়া দেন। মাঝেমধ্যে মস্তিষ্কপ্রক্ষালন যন্ত্রের অভাব অনুভব করেন নিশ্চয়ই। বঙ্গেশ্বরীর মন্ত্রিসভায় লোক অনেক, কিন্তু সিদ্ধান্ত করিবার অধিকার কাহারও নাই। মন্ত্রীর ঘাড়ে উপদেষ্টা চাপিয়াছেন, কিন্তু পরিস্থিতি বদলায় নাই। সব সিদ্ধান্তই কালীঘাটের মুখাপেক্ষী। বস্তুত, শুধু সরকারি সিদ্ধান্ত নহে, মুখ্যমন্ত্রী সবই স্বনিয়ন্ত্রণে রাখিতে চাহেন। একটি দল একটি ঘরোয়া ক্রিকেট প্রতিযোগিতা জিতিলে সরকারি অর্থে যে মোচ্ছব হয়, তাহাতেও মুখ্যমন্ত্রী ভিড় সামলান; আবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শেষ যাত্রায়ও তিনিই ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকায়। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণদিবসে ‘রবীন্দ্রজয়ন্তী’ পালনেও তিনি, পূজার উদ্বোধনেও তিনি, হজ যাত্রীদের শুভেচ্ছা জানাইতেও তিনি।
মুখ্যমন্ত্রীর প্রচারের আলোয় থাকিবার মোহ অতৃপ্তিসম্ভব। সব কৃতিত্বেই যাহাতে তাঁহার মুখটি ফুটিয়া থাকে, মুখ্যমন্ত্রী তাহা নিশ্চিত করিতে বধ্যপরিকর বলিয়াই বোধ হয়। সেই কারণে সকল সরকারি বিজ্ঞাপনে তিনি, সকল সমাবেশে তিনি, সকল মিছিলে তিনি, সকল শোকেও তিনি। রাজ্য সরকারের হাতে নোট ছাপাইবার অধিকার থাকিলে কী হইত, বলা দুষ্কর। অত্যন্ত নিকটজনকেও তিনি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতে পারেন, মুখ্যমন্ত্রীর এমন খ্যাতি নাই। নিজেকে সর্বশক্তিমান জ্ঞান করা, কাহাকেও বিশ্বাস না করিতে পারা, নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনে যথেচ্ছাচারী হওয়া এই সকল লক্ষণবিশিষ্ট চরিত্র ইতিহাসে বা সাহিত্যে বিরল নহে। সেই চরিত্ররা দিবারাত্র নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিতেন, এবং তাহা ঢাকিতে আরও বেশি যথেচ্ছাচার করিতেন। বঙ্গেশ্বরীও কি সেই পথেই হাঁটিতেছেন? |