|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৩... |
একটাভয়কষ্টলজ্জা [ঘেন্না]
|
|
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় |
শোন, প্রতি বার খাওয়ার সময় প্রতিটি গ্রাস মুখে তোলার সময় তোর হাতে নখে যদি পায়খানার গন্ধ লেগে আছে মনে হয়, যদি মনে হয় প্রতিটি গ্রাসের সঙ্গে একটু একটু পায়খানা তোর পেটে যাচ্ছে, তখন ঘেন্না ছাড়া আর কোনও অনুভূতি কাজ করে না, বুঝলি? তাই যা ফেস করিসনি, তাকে এগারোশো শতাব্দীর ন্যাকা কনসেপ্ট দিয়ে জাস্টিফাই করিস না।’
রুকসানার সঙ্গে সে দিনই আমার বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যেতে পারত। তখন আমরা দুজনেই কর্পোরেট অফিসে চাকরি করি। রুকসানা বেশ সুন্দরী ও টিপটপ, ওকে দেখলে বেশ একটা অ্যাসপিরেশন তৈরি হত। শনিবারের কোনও এক জমজমাট অফিস-আড্ডায় ওর হিন্দু মা আর মুসলমান বাবার হিট প্রেম-কহানি শুনেছিলাম আমরা। মা ডাকসাইটে সুন্দরী, বাবা সাক্ষাৎ শশী কপূর। রূপকথা ভাঙতে অবশ্য বেশি সময় লাগেনি। পিঠোপিঠি চার ভাইবোন রুকসানার বাবার অন্য লাভ- স্টোরিতে এন্ট্রি। রুকসানার মা নিত্যি নার্সিং হোম যাত্রী সুগার, প্রেশার... এবং দারিদ্র, চার ছেলেমেয়ে, অপমান, শ্বশুরকুলের শরিকি সংসার। রুকসানা বড় মেয়ে, গুরুদায়িত্ব পারফেক্ট পালন করল। এই সময়টায় রুকসানা আমাদের সঙ্গে চাকরি করে, আর কখনও নার্সিং হোম ছোটে, কখনও বাড়িটাই নার্সিং হোম হয়ে যায়।
ঘেন্নার দলাটা হঠাৎই এক দিন আমাদের মাঝখানে পড়ে ফেটে গেল। ওর মা তখন বাড়িতে, এবং পার্মানেন্টলি বিছানায়। ছোট বোন কেরিয়ার বানাতে ব্যাঙ্গালোর পাড়ি, ভাই দু’জন, কেবল ছেলে হওয়ার দৌলতে, কলার তুলে ফ্যা-ফ্যা। রুকসানার রুটিন তখন সকাল-বিকেল বেডপ্যান, অফিস বেরোনোর আগে ডাঁই নোংরা কাপড় কাচা, মায়ের পায়ে বজবজে পচপচে ফোঁড়ার পুঁজরক্ত পরিষ্কার করা। ভাল আয়ার পিছনে খরচা করার সামর্থ্য ছিল না। সব কিছু সামলে চান করে যেই রুকসানা খেতে বসত, তখুনি আওয়াজ শুনেই বুঝতে পারত, ও-ঘরে মা ছ্যারছেরিয়ে আবার পায়খানা করে ফেলছে, দৌড়ে গিয়ে ভাঙা বালতিতে জল ঢেলে বমি পায়খানা ধরত, সেগুলো ফের সাফ, ফের চান, তার পর আবার খেতে বসে মনে হওয়া, দলা দলা পায়খানা গিলছি।
রুকসানা বলেছিল, ‘হ্যাঁ, আমি পুরো জিনিসটাকে ঘেন্না করি। মা’কে ঘেন্না করি, বাবাকে ঘেন্না করি, এই নোংরা ঘাঁটাকে ঘেন্না করি। কেন আমাকেই রোজ এই কাজগুলো করে যেতে হবে? কেন? আমার জীবন বলে কিছু নেই? আমি যে টাকা রোজগার করি তা দিয়ে একটা সাধের জিনিস কেনার অধিকার আমার নেই? যে জন্যে এগুলো নেই, সেই জিনিসগুলোকে মনপ্রাণ দিয়ে ঘেন্না করি। তবে সবচেয়ে ঘেন্না করি, রোজ রোজ ওই রগড়ে রগড়ে ছুঁচিয়ে দেওয়াকে, অন্যের পায়খানা ঘাঁটাকে, বমি হাত দিয়ে আকচে আকচে তোলাকে।’
আমি স্তম্ভিত। বলেছিলাম, ছি, নিজের মা’কে কেউ... বাক্যটা শেষ করতে পারিনি। তার উত্তরে প্রথম কয়েকটা বাক্য জান্তব গোঙানির মতো ওর গলা চিরে বেরিয়ে এসেছিল, আমার কানে অ্যাসিডের মতো আছড়ে পড়েছিল।
এর ক’দিন বাদেই রুকসানার মা মারা যান। রুকসানা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। খুব কষ্ট পেয়েছিল। বলেছিল, ‘জানিস তো, একটা জিনিস খুব ভাল্লাগছে, আমায় আর ওই ঘেন্নাটা বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে না। এ বার আমি মা’কে খুব ভালবাসতে পারব।’ |
|
|
|
|
|
|