|
|
|
|
|
|
শিল্প যখন ঠোঁটকাটা থাপ্পড়বান |
আজকের হিরো: ডগমে ৯৫
|
শিশির রায় |
|
১৩ মার্চ, ১৯৯৫। প্যারিসে এক সম্মেলনে জড়ো হয়েছিলেন দুনিয়ার তাবড় চলচ্চিত্র নির্মাতা আর বাঘা সমালোচক উদ্দেশ্য: চলচ্চিত্রের শতবর্ষ উদ্যাপন, আর কেমনই বা হবে আগামীর সিনেমা, সে নিয়ে কথাবার্তা। অনেকের হাত ঘুরে যখন পালা এল ডেনমার্কের উঠতি পরিচালক লার্স ফন ট্রায়ার-এর, তিনি করলেন এক আজব কাণ্ড। গোটা সভাকক্ষ জুড়ে উড়িয়ে দিলেন লাল-রঙা হাজারো প্যামফ্লেট, বললেন, এতেই বলা আছে ভাবী কালের সিনেমার রূপরেখা। পাতার ওপরে লেখা ‘ডগমে ৯৫’, তারপর দশখানা উদ্ভট, মাথা-ঘোরানো পয়েন্ট। পড়ে তো সবার মাথায় হাত। এও কি সম্ভব? এমন যৎসামান্য ব্যয়ে অথচ বৈপ্লবিক উপায়ে, এইটুকু ঘর কি লন কি রাস্তা বা স্রেফ গাড়ির মধ্যে অত কম দিনের মধ্যে মনের গোপন কোটরে লুকোনো অপ্রিয় অস্পৃশ্য ভাবনাগুলো গল্প আর অভিনয়ের যুগলবন্দিতে এমন চরম, চূড়ান্ত ভাবে দেখানো যায়? হলিউডি বিগ-বাজেটের দাদাগিরি আর চোখ-ধাঁধানো কারিগরি-প্রযুক্তির দেখনদারির গালে থাপ্পড় মেরে উঠে আসে নতুন এক চলচ্চিত্র-ভাবনার, আন্দোলনের ম্যানিফেস্টো।
টমাস ভিন্টারবার্গ আর লার্স ফন ট্রায়ার দুই ছবি-করিয়ে বন্ধুর মিনিট-পঁয়তাল্লিশের নির্ভেজাল আড্ডার ফসল এই দশ-দফা ম্যানিফেস্টো। দুজনেরই লেখা, সই-করা। ম্যানিফেস্টোর আরেক নাম ‘বিশুদ্ধতার শপথ’ (ভাউ অফ চেস্টিটি)। এ হল সিনেমার শরীর থেকে সব বাহুল্য (স্পেশাল এফেক্ট, বাড়তি আলোকসম্পাত, ক্যামেরা বা শিল্প নির্দেশনায় কায়দাবাজি, এমনকী খাওয়াদাওয়া, গাড়ি-খরচার পেল্লায় খরচ) ঝরিয়ে তাকে পরিস্রুত, নির্মেদ করার শপথ, ছবির মূল হাতিয়ার চিত্রনাট্য আর অভিনয়কে ব্যবহার করে মূল কথাটা উচ্চারণের শপথ, আর সবচেয়ে বড় : বুর্জোয়া শিল্প-ধারণায় যে নান্দনিক বিলাসিতাগুলো বাধ্যতামূলক, সেগুলো বর্জনের শপথ। দশটা পয়েন্ট ছিল এ রকম :
১. ছবি হবে লোকেশন-এ, কোনও রকম ‘সেট’ বা ‘প্রপ’ (লোকেশনে আনা জিনিসপত্র) ব্যবহার করা যাবে না। বরং লোকেশন হিসেবে বাছতে হবে সেই জায়গাকে যেখানে জিনিসগুলো আগে থেকে এমনিতেই আছে।
২. ছবিতে শট-এ যা দেখছি, সেখানে এমনিতেই যে শব্দ ছিল, শুধু তা-ই ব্যবহার করা যাবে। বারান্দা দেখালে, বাইরে দিয়ে যে ফেরিওলা ওই সময় হেঁকে যাচ্ছিল, তার স্বর ব্যবহার করা যাবে, কিন্তু মুড তৈরির জন্য পরে ফেরিওলার ডাক সংযোজন করা যাবে না। চিত্রনাট্যে আগে থেকে ঠিক থাকলে, ফেরিওলাকে শুটিঙের সময় হাঁকানো যাবে। সঙ্গীতের ব্যবহারের বেলায়ও একই কথা। যদি দৃশ্যে কোনও বাজনা বাজাতে হয়, শুটিং-কালীন তা বাজাতে ও রেকর্ড করতে হবে। |
|
‘দি ইডিয়টস’ ছবির এক দৃশ্য |
৩. ক্যামেরা সব সময় থাকবে হাতে-ধরা অবস্থায়, ও ভাবেই যতটা পারা যায় ঘুরিয়ে বা স্থির রেখে শট নিতে হবে।
৪. ছবি হবে রঙিন, কিন্তু থাকবে না কোনও বিশেষ আলোকসম্পাত। যে আলো আছে, যতটা আছে, তাতেই শট নিতে হবে।
৫. ক্যামেরার কাজের চেকনাই বাড়াতে ফিল্টার বা অন্য কোনও অপটিক্যাল জিনিসপত্রের ব্যবহার চলবে না।
৬. খুন-জখমের মতো ‘সুপারফিশিয়াল অ্যাকশন’ দেখানো এড়াতে হবে।
৭. ছবির ঘটনাটা ঘটতে হবে এখন, এখানে, ঘটমান বাস্তবে। অর্থাৎ মঙ্গলগ্রহের গল্প বলা যাবে না বা মৌর্য যুগের গল্প ফাঁদা যাবে না।
৮. হলিউডি বি-মুভির মতো সস্তা, অযথা-চটুল বা যৌনতা-জারিত থিমগুলো চলবে না।
৯. ৩৫ মিলিমিটার ‘অ্যাকাডেমি ফরম্যাট’-এ ছবি বানাতে হবে।
১০. ছবি একা কারও সম্পত্তি নয়, তাই কোনও ছবিতেই পরিচালকের নাম থাকবে না।
অচিরেই এই দলে যোগ দিলেন সমমনা আরও দুজন ক্রিস্টিয়ান লেভরিং আর সেরেন ক্রাগ-জেকবসেন, তৈরি হল ‘ডগমে ভ্রাতৃত্ব’। ১৯৯৮-এই টমাস ভিন্টারবার্গ বানালেন ডগমে সিরিজের প্রথম ছবি ‘ফেস্টেন’ (ইংরেজিতে ‘দ্য সেলিব্রেশন’), আর ওই বছরেই মুক্তি পেল লার্স ফন ট্রায়ারের ছবি ‘দি ইডিয়টস’। সে বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে সমালোচক-দর্শকেরা মুখর হলেন দু’টি ছবিরই যুগপৎ ভজনা ও নিন্দায়। ‘দি ইডিয়টস’ নমিনেশন পেয়েছিল ‘পাম ডি’অর’-এর, আর ‘ফেস্টেন’ তো জিতেই নিয়েছিল বিশেষ জুরি পুরস্কার। সোনি হ্যান্ডিক্যামে, মিনি ডিভি ক্যাসেটে তোলা ছবি ‘ফেস্টেন’-এ প্রবল প্রতাপী ও ধনী গৃহকর্তার ষাট বছরের জন্মদিনে নানা জায়গা থেকে জড়ো হয় তাঁর ছেলেমেয়েরা, আদর-আলিঙ্গনের পালা শেষে ফ্যামিলি ডিনারে বড় ছেলে ক্রিস্টিয়ান ফাটায় হঠাৎ-বোমা : সে আর সদ্য আত্মহত্যা করা যমজ-বোন লিন্ডা তাদের কৈশোরে দিনের পর দিন পায়ুপ্রহৃত, ধর্ষিত হয়েছে তাদের এই সেলেব্রিটি বাবার দ্বারা, বোনের আত্মহনন আর ক্রিস্টিয়ানের প্রথম সুযোগেই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কারণ ঐ ধষর্র্কামী বাবা। ‘দি ইডিয়টস’-এ এক দল নারী-পুরুষ সমাজের বিরূদ্ধে বৌদ্ধিক বিদ্রোহে ভান করে যেন তারা ন্যালাখ্যাপা বোকা-হাবা, রাস্তায়-রেস্তোরাঁয়-ঘরে পশুর মতো অবাধ স্বেচ্ছাচার-অনাচার-যৌনাচারে মাতে। দুটো ছবিই বিষয়বস্তুর দিক থেকে তাজ্জব-করা, আর সব ইমেজ’ই ডগমে-র নিয়ম মেনে অপরিষ্কার, অস্পষ্ট, আচমকা ঢুকে পড়া আলোর অভিঘাতে অন্য রকম।
ডগমে ম্যানিফেস্টো যে খোদ উদ্ভাবকরাই জীবনভর মেনেছেন, তা নয়। ভিন্টারবার্গ জানিয়েছেন, ম্যানিফেস্টো লঙ্ঘন করে শুটিঙের সময় কেমন করে একটা জানালা ঢেকেছিলেন পর্দায়, বা ফন ট্রায়ার ‘দি ইডিয়টস’-এ শটের সাউন্ডের সঙ্গে কায়দা করে মিশিয়েছিলেন আবহ সঙ্গীত। আর, এই পরিচালকদের সব ছবিই কিন্তু আদতে তাঁদের নামেই বন্দিত বা নিন্দিত হয়েছে, তাঁদেরই গড়া দশ নম্বর নিয়ম ভেঙে। দু’জনেই বলেছিলেন, সিনেমা কোনও নিয়ম-নিগড়ের, বিশেষ কোনও ‘ইজ্ম’-এর মধ্যে যাবজ্জীবন পচবে না, সেই মুক্তির আস্বাদ দিতেই এসেছে ডগমে। ২০০২ সালে ডগমে সিরিজের ৩১ নম্বর ছবির মুক্তির পর থেকেই নিদান : যে পরিচালক ডগমে ফিল্ম বানাচ্ছেন, তাঁকে অনলাইনে একটি ফর্ম ভরলেই চলবে এই বয়ানে: তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন তাঁর ছবি ‘ডগমে ৯৫’-এর সব নিয়ম মেনে বানানো। কোনও কর্তৃপক্ষ বা দল এসে দাবির অভ্রান্ততা যাচাই করবে, বা ‘ডগমে-র নাম করে এমন অ-ডগমে ছবি তুললে কেন’ প্রশ্ন তুলবে, এমন ব্যাপারই নেই। নিজেরা পর পর এমন ছবি বানাতেও শুরু করেন যার সঙ্গে ম্যানিফেস্টোর কোনও সম্পর্ক নেই। মতাদর্শগত শৈথিল্যে, বা হয়তো ইজ্ম-শেকল ছিঁড়তে, ২০০৫-এ ভেঙে যায় আন্দোলন। |
|
|
|
|
|