গজল-এ-ভেটকি।
সেই কৈশোরে বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের গণশা-ঘোঁৎনা-গোরাচাঁদ’কে গুপ্তর গল্পগুলো (সকলেই লেখকের মতো শিবপুরের লোক) পড়তে পড়তে জেনেছিলাম:
‘নাচগানসুর
তিনে শিবপুর’।
শিবপুর, বিশেষ করে বাজে শিবপুর মানেই গানবাজনা। বাজে কথাটি সেই কারণেই নাকি বসেছে। ‘খারাপ’ অর্থে নয়। বেজে উঠছে, বেজে চলেছে, বাজছে এই অর্থে ‘বাজে’। বাজনা যেমন বাজে। সংগীত যেমন বাজে।
কে শিবপুর, বাজে-শিবপুর হরিদাস পাল। কে তুই, তোরা? কান পেতে শোন। এখন বাজে-কলকাতা। খবরের কাগজে জানলাম, কলকাতায় এখন গজল-এ-ভেটকি। ‘ইয়ে ন থি হমারি কিস্মত’। বেগম আখতার গাইছেন? ইস, গজল বললেই সারা দুনিয়ার রসিক শ্রোতাদের মনে যাঁর নাম সেতারের তরফের তারগুলোর মতো রিনরিন করে উঠেছে কয়েক দশক ধরে, তিনি কী বঞ্চিতই না থেকে গেলেন! কলকাতা আর বাঙালিদের সঙ্গে বিলক্ষণ পরিচয় ছিল তাঁর। ভেটকি মাছের সঙ্গেও হয়তো। কিন্তু গজল-এ-ভেটকি তাঁর অভিজ্ঞতার বাইরে থেকে গেল।
আমরা, যারা পাকিস্তানের তুখোড় ‘গজল-শিল্পী’ মেহদি হাসান ও গোলাম আলি এবং তাঁদের ভারতীয় অনুকরণকারী ও অনুগামীদের গাওয়া ‘গীত’গুলোকে ‘গজল’ বলে জানলাম (গজল ও গীতের সুরতালগত কাঠামো এক নয় বলেই গজলের সনাতন শ্রোতারা জানেন), আমাদের জন্য এসে গেল গজল-এ-ভেটকি। এ কি সেই ট্র্যাডিশনাল তাল-তালছাড়া-তাল এই কাঠামোর গজল, না কি একটানা তালে বাঁধা গীত আঙ্গিকের? সাতের দশকের গোড়াতেও যে আঙ্গিকের গজল ভারতে শোনা যেত, যে আঙ্গিকে গান প্রথমে শুরু হত তালে, তবলার ঠেকা সহযোগে এবং মাঝখানে তাল ছেড়ে লিরিকের ভিত্তিতে ইমপ্রোভাইজ করতেন শিল্পী গলাটা খেলিয়ে খেলিয়ে, আর তার পর আবার তালে ফিরতেন, সেই আঙ্গিকটি কোথায় যেন হারিয়ে গেল। এসে পড়ল গীত আঙ্গিকটির চূড়ান্ত প্রভাব। এই আঙ্গিকে মাঝখানে তাল ছেড়ে ইমপ্রোভাইজ করার বাধ্যবাধকতা নেই।
স্ট্রাকচারাল অ্যানথ্রোপলজিস্ট ক্লোদ লেভি স্ত্রাউস-এর এক সাক্ষাৎকারে অনেক কাল আগে পড়েছিলাম, তিনি বলছেন: তাঁর জীবনের একটা বড় আফশোস হল, মানুষ ছাড়া অন্য কোনও প্রাণীর সঙ্গে কথা বলা গেল না। ভেটকি মাছের সঙ্গেও না। ভেটকি কি জানেন গজল কাকে বলে? গজল কি জানেন ভেটকি কী, কোথায় পাওয়া যায়? ‘দিলে নাদান তুঝে হুয়া কেয়া হ্যায়’। আমি উর্দু হিন্দি কিছুই জানি না, বুঝি না। অনেক বছর আগে মেহদি হাসানের গাওয়া এই গানটি শুনে মনে হয়েছিল কথাগুলি এই রকম।
|
হয়তো ভুল লিখলাম। মানে জানি না। সেই সাতের দশকে কোলোন শহরে বন্ধুবর আবদুল্লাহ্ আল্ ফারুকের সৌজন্যে যে রেকর্ডিংটি আমি শুনেছিলাম, তাতে মেহদি হাসান শুদ্ধ সারং রাগে গাইছিলেন গানটি। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল অতীতে ধ্রুপদ ও খেয়ালে প্রশিক্ষিত আমাদের উপমহাদেশের সেই রত্নটি শান্ত ভাবে, প্রায় ধ্যান করার মতো খেয়াল আঙ্গিকে স্বরবিস্তার করছেন।
বন্ধু ফারুক বলেছিলেন বাহাদুর শাহ্ জাফরের লেখা। বঙ্গসন্তান ফারুক বিলক্ষণ জানতেন ভেটকি কাকে বলে। এ গানের গীতিকার কি জানতেন? মেহদি হাসানের কণ্ঠ ও গানও তিনি শোনেননি। তিনি জানতে পারেননি তাঁর ওই লেখাটি এক দিন কেউ পরম মমতা, সংযম ও সাংগীতিক মেধার সঙ্গে শুদ্ধ সারং রাগে বাঁধবেন ও গাইবেন। শুদ্ধ সারং রাগের বাঁধুনি, ধীর চলন থেকে শুরু করে ভেটকি পর্যন্ত কিছুই জানতে পারেননি তিনি। আজ তিনি কলকাতায় থাকলে আর কিছু না হোক গজল-এ-ভেটকির রস পেতেন।
মির্জা গালিব, আপনি না এক কালে কলকাতায় এসেছিলেন, এখানে বসত নিয়েছিলেন? আপনার লেখা লিরিকে সুর দিয়ে গজল বানানো হয়েছে না? রাজারাজড়াদের কাছে থেকে-থেকেই টাকা চাওয়া আপনার বোহেমিয়ান সত্তা কি কখনও রসনায় পেয়েছিল ভেটকির স্বাদ?
গালিব, চিরদুঃখী, জন্ম-বোহেমিয়ান গালিব সূক্ষ্ম দেহে এক বার ঘুরে যান আমাদের বাজে-কলকাতা। ফিলহারমোনিক ভোজনালয়ে দেখবেন আপনাকে সামনে বসিয়ে রেখে আমরা গজল-এ-ভেটকি খাব আর ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজবে ‘ফিউশন’। মারাত্মক গতিতে দু-একটি যন্ত্র, হয়তো বেহালা, আপনি চাইলে সারেঙ্গিও হতে পারে, তানের মতো কী-সব করে চলেছে; পেছনে গুমগুম করে ছন্দে ছন্দে বেজে চলেছে বেস গিটার, ‘গুম’-এর সঙ্গে ড্রামস; আপনার কপাল ভাল হলে হয়তো শুনে ফেলবেন দক্ষিণী বিশ্বকর্মা রজ্নিকান্ত্ তানবাজি করলে যা হতে পারত, সেই রকম ঘটছে কোনও এক মানবকণ্ঠে শুধু, রজ্নিকান্ত্ও যা পারবেন না, সেই রকম পৌনেসুর-বাকিবেসুরে।
ভেবে দেখুন, মির্জা গালিব, গজল-এ-ভেটকিতে কামড় দিয়ে আমরা, আজকের কলকাতার নাগরিকরা, কী চোখে আপনাকে দেখব। গজল-এ-ভেটকির যুগে আপনিও এক ধরনের ‘শেফ’। বা হয়তো স্রেফ এক জন উপাদান-সরবরাহকারী।
আপনার ইন্টারভিউ নেব আমরা; আপনি কি জানেন, কাজি নজরুল ইসলাম প্রথম আধুনিক বাংলা গানের দেহে গজল আঙ্গিকটি এনেছিলেন, অতুলপ্রসাদ যেমন আনতে চেষ্টা করেছিলেন ঠুংরির চাল আধুনিক গানে? কিচ্ছু ভাববেন না স্যর, তাঁর সঙ্গেও আপনার দেখা হয়ে যাবে পনির-এ-ঠুংরির খদ্দেরদের মধ্যে। সে কী স্যর, এত সহজে বিষম খেলেন? যাঃ, আপনিও তা হলে জানেন যে বড়ে গোলাম আলি খান কলকাতায় থাকতেন?
কী বললেন? তাঁর গাওয়া ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’ বা জংলাভৈরবীতে ‘আ যা বালম পরদেসি’ আমরা শুনিনি, আর শুনলেও মনে রাখিনি? পাহাড়ি রাগে ‘হরি ওম তৎ সৎ’ ঠুংরি আঙ্গিকে গাওয়া? মাননীয় মির্জা গালিব, আপনি মহাকবি হতে পারেন, কিন্তু তাই বলে আজকের যুগে বাঙালির রসবোধ নিয়ে, সংগীতচেতনা ও সংগীতপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও অধিকার আপনার নেই।
স্যর, ভেবে দেখুন, গজল-এ-ভেটকি, পনির-এ-ঠুংরি এই সব খাবারের নামেই কী সুর-তাল-ছন্দ, কী আঙ্গিকবোধ। শিগগিরই দেখবেন বড়ে গোলাম আলি খান সাহেবের সেই বিখ্যাত ঠুংরিটির ‘বাণী’ একটু পাল্টে আমরা গাইছি, বাজে-কলকাতার সৃষ্টিশীল লোক, সংগীতশিল্পীরাও কেউ কেউ গাইছেন: ‘কা করুঁ সজনি
খায় না বালম’!
ভেবে দেখুন স্যর, একটি অক্ষরের ‘দ্বিধা থরোথরো চূড়ে’ কী বৈপ্লবিক, কী শৈল্পিক সম্ভাবনাই না দীর্ঘ প্রতীক্ষায় কেঁপে-কেঁপে উঠছে। ‘আয় না’র ‘আ’-টাকে শুধু ‘খা’ করে দিন।
ডিসপেপসিয়াই হোক আর অভিমানই হোক, যে-কোনও কারণে ‘বালম’ যদি খেতে না চান, না খান, তা হলে এক বার তাঁকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে আসুন বাজে-কলকাতার সুরতাল-ভোজনালয়ে। দেখবেন, সেই যে বিস্ময়কর লং প্লে রেকর্ডখানা এককালে বেরিয়েছিল মির্জা গালিবকে নিয়ে সেই যে, কইফি আজমি পাঠ করছেন গালিব। মহম্মদ রফি আর বেগম আখতার গাইছেন গালিবের গজল! সেই যে এক টুকরো স্বর্গ!
‘আগর ফিরদৌস বরুয়ে জমিনস্ত
হমিনস্তো হমিনস্তো হমিনস্ত’।
ওই সংকলন আর পাওয়া যায় না এ দেশে। তা না যাক।
খাঁটি গজলের ফিরদৌস থাকুক না-থাকুক, আজ গজল-এ-ভেটকি। অভিমানিনী ‘বালম’ যাতে খান, সে জন্য পনির-এ-ঠুংরি। |