রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১...
হাওড়ার পিরামিড

দিঘার সি বিচ
নিউ মার্কেট। হালে তৈরি পার্কোম্যাট। গাড়ি এলেই ক্রেনে করে নীচে পাঠিয়ে দেয়। ঢেউ নেই, কিন্তু পাতাল আছে। পাশে বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে খাঁ খাঁ প্রান্তর। কয়েকটা কানাওয়ালা ডিভাইডার। তার ওপর চড়ে বসুন। আশপাশের দেদার মানুষ পা দোলাচ্ছে হেলেদুলে আড্ডা দিচ্ছে। আশ্চর্য বস্তু বিক্কিরি হচ্ছে। চা, ছোলাভাজা, ঘটিগরম নিয়ে ঘুরছে। একটা বাচ্চা ডাবওলা অনেক সন্ধে পর্যন্ত থাকে। ডাব খেলে রঙিন প্যাকেটের চিপ্স কিনে দিতে বলে। ছ’টা বাজলেই কে এক জন এসে মাটিতে রঙিন খড়ি দিয়ে তরতর করে কী সব আঁকে আর একটা উর্দি পরা লোক তাকে ‘হিঁয়া পর ফিরসে কাইকু আয়া’ বলে ভয়ানক চোখ রাঙায়। সে পাততাড়ি গোটালে মাথায় আলো জ্বলা শিং আটকানো লোকটা এসে আকাশে গুলতি ছোঁড়ে, অমনি আলোতে ট্রাপিজ খেলতে খেলতে একটা পুতুল মেয়ে নেমে আসে। এখানেই আপনি চিংড়ির গন্ধমাখা চিপ্স কিনে, চোখ দু’টো বন্ধ করুন। কানে শব্দতরঙ্গ লাফাবে। টিংটিংরিংরিং...চানা পাঁচ রুপাইয়া...এইসান পুঁতির মালা চল্লিশ টাকায় কুথায় পাবেন দিদি...আরও অজস্র মানুষের খিলখিল বকবক গুলতানি-সিম্ফনি। আরে তাই তো! নোংরা, কাদা, পাথর আর মধ্যবিত্ত ভিড়ে ভরা নাইনটি পার্সেন্ট দিঘা সি বিচে পৌঁছে গেছেন মনে হচ্ছে না? বাকি দশ পার্সেন্টের ব্যবস্থা নিজে দেখে নিন। জাস্ট ইমাজিন ওই দিকটা থেকে সমুদ্রের গোঁগোঁ শুনতে পাচ্ছেন।

করবেট ন্যাশনাল পার্ক
মোহর কুঞ্জ। যদি না সেখানে মাচা বেঁধে গালে পেন্সিল ঠেকিয়ে আলাপ আলোচনা হয়, পড়ন্ত বেলায় ঢুকুন। যেখানে সেখানে ঝোপ, গাছগুলো যা-তা করে বেড়েছে। আলো জ্বালানোর নাম নেই। শহরের মাঝমধ্যিখানে বিশাল গা-ছমছমে জঙ্গল। চার দিকটায় আস্তে করে চোখ বোলান। ডালেরা খোঁচা খোঁচা, ঘাসেরা বুড়ো খড়। পাখি গম্ভীর স্বরে ট্যারার্যা করে কী সব বলছে। আর গেটের বাইরে আর একটা ইন্টারেস্টিং পার্ক দেখা যাচ্ছে। ভেতরে কী আছে ভগবান জানেন, চারটের পর ঢুকতে দেয় না। যেন জঙ্গলের কোর এরিয়া। তার পাশ দিয়ে একটা রাস্তা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, রেসকোর্স-এর দিকে চলে গেছে। ও পথে বড় একটা কেউ হাঁটে না। যেন ডাকাত আর হাতির ভয়ে তটস্থ হাইওয়ে। গাড়ির মতো দেখতে জন্তুরা রুদ্ধশ্বাসে পালাচ্ছে। এ সবের মধ্যে যদি সূর্য ডুবে একটা নখের ফালির মতো চাঁদ উঠল তো কেয়া বাত! ওই জিনিসেই হায়না উউউউ করে ডেকে ওঠে আর চিতারা শিকারে বের হয়। কেমন শিউরে উঠলেন না? মুডটা তো ধরেই ফেলেছেন। এ বার পাঁচিলের পাশের ঝুপসি আগাছার মধ্যে দেখুন। দু’টো হলদে সবুজ কাচের গুলি, আপনার সঙ্গে চলছে।

কারাকোরাম টু
লঞ্চভ্রমণের একটা প্লাস পয়েন্ট হল হাওড়া ব্রিজের তলা দিয়ে যাওয়া। বিক্রিবাটা নিয়ে বেজায় চিন্তিত ঝালমুড়িওয়ালা, অক্টোবরে সোয়েটার পরিহিত দাদু, নাক সিঁটকে বসা অফিসকাকু আর লাল ফিতে সাদা মোজার স্কুলবালিকারা, হাওড়া ব্রিজ আসা মাত্র হঠাৎ পিনড্রপ সাইলেন্স। সব একযোগে মাথা উঁচিয়ে দেখছে। ঠিক যেমনটা ছোটবেলায় আঁকতাম, একটা নদী, একদম জ্যামিতিক তেকোনা তেকোনা সুউচ্চ পর্বতমালা থেকে বেরিয়েছে। এ তো বোঝাই যাচ্ছে, তরঙ্গায়িত নবীন ভঙ্গিল পর্বতের দু’টো যমজ শৃঙ্গ মাথা উঁচিয়ে আছে। যদি তাতে রাজি না হন, বেশ। ওগুলো পিরামিড। দু’টো পাশাপাশি। একটা হয়তো তুতেনখামেনের, একটা তার মা’র। হল? সিধে মিশর পৌঁছে গেলেন। নীল নদের ক্রুজে যাচ্ছেন। পিরামিডের তলায় যে নেড়ি বসে আছে, সে স্ফিংস। হ্যাঁ, সে-ও পাশাপাশি অনেকগুলো আছে। মিশরেরও প্রগতি হচ্ছে তো, না কি?

সাংহাই
ট্যাংরার লাশকাটা গন্ধওলা জায়গাটা পেরোলেই একটা টিমটিমে আলোওয়ালা গলি। সার সার ট্যাক্সি, তার মধ্যে আধখোলা শার্ট পরা লোকরা প্রচণ্ড ঘুমোচ্ছে। ভাঙা ভাঙা বাড়ির ওপরে বিশাল বিশাল তোবড়ানো সাইনবোর্ড। সাংহাই নুন, দ্য পিকিং সার্কাস। আর কয়েকটার নামেই রহস্যের গন্ধ। দ্য ব্লু লোটাস, ড্রাগন এম্পায়ার। অবিকল টিনটিনের ‘নীলকমল’ কমিক্সের হলদে হওয়া পাতা। ভাঙা সাইকেলের ওপর হেলান দিয়ে টুপি পরা ছোট্ট চোখ-নাক সিড়িঙ্গে মানুষ, মুখে গলগল ধোঁয়া। পাশেই ইয়া মোটা চিনা বউ, খবরকাগজ পড়ছেন। তার অক্ষরগুলো চিনে। না ম্যান্ডারিন, কে জানে কী বলতে হয়। আরও ভাল করে এই মৌতাত চাইলে, ২৬ বা ২৭ ডিসেম্বর সিধে চলুন টেরিটি বাজার। চার দিকে আধছেঁড়া ক্রিসমাস ট্রি পড়ে রয়েছে, খাকি জামা পরা বেঁটেখাটো লোকজন চিনে খাবারের কাউন্টারে বসে কত কী ভাবছে। পলেস্তরা খসা আর্মেনিয়ান নকশার পুরনো বাড়ি, তার মধ্যে থেকে অন্য রঙের লোকজনদের জীবনের আওয়াজ উঠছে।

সত্তর দশকের আমেরিকা
টাইম ট্রাভেল অবধি আছে মশায়! শনিবার পার্ক হোটেলে ঢুকে যান। অন্ধকার, ধোঁয়া ধোঁয়া, ডিস্কো লাইট। যত রাত বাড়বে, মাটি ফুঁড়ে কারা সব এসে দাঁড়াবে। তাগড়াই হাতে উল্কি মারা ন্যাড়াগুলোকে দেখলে মনে হয় এই মাত্র ইংল্যান্ডের কোন টানেলে কাউকে বেধড়ক পিটিয়ে এল। তার পর সামপ্লেস এল্স-এ ভাঙা গলায় নতুন গাইয়ে কোন প্রত্যন্ত গ্রামের সলিটারি রিপারের গান ধরল, আর চার পাশে সাত ফুট লম্বা বিনুনি চুলের ক্যারিবিয়ানরা দেখা দিল। যেন, তোড়ায় বাঁধা ক্রিস গেল। তার পর, স্মোকিং জোন-টায় কুমিরের চামড়ার জুতো পরা বীভৎস আলফানসো আলবুকার্ক, শুকনো টিকটিকির মতো দেখতে ছেলে, যার মাথায় গুটিকতক চুল অথচ সোনালি রঙের বিনুনি করেছে, আর সারা শরীরে মাকড়সার মতো ট্যাটু করা মেয়েরা। মাথায় ফেট্টিদের মধ্যে জিনাত আমনকে খুঁজে পেতেও পারেন। পরিষ্কার আর্লি সেভেন্টিজের আমেরিকা। পছন্দ না হলে, পাশেই ‘রক্সি’তে বসুন। দিব্যি উপদ্রবহীন আইরিশ পাব, এক দল নিজের মনে নাচছে আর বাকিরা সোফায় চুপ। কী বাজানো হচ্ছে নিজেরাও জানে না, ডিজেটা ভুরুটুরু কুঁচকে বলবে, ফোক-রিমিক্স। নতুন টাঙানো পর্দায় ভগবান জানেন কোন চ্যানেল ধরেছে, কেব্ল বা সেট-টপ কোনওটাতেই সে মিউজিক চ্যানেল জীবনে খুঁজে পাবেন না। আসলে ওটা তো সেই ডাবলিন-এর নর্থ রিচমন্ড স্ট্রিটের সিগন্যালের সঙ্গে কানেক্টেড। এমনকী আশেপাশের গোঁজ হয়ে বসে থাকা ডিপ্রেস্ড ছেলেগুলোর মধ্যে জেমস জয়েসের অ্যারবি-র সেই খুদে হিরোটার এক্সপ্রেশনও কার্বন কপি দেখবেন। যেন সব্বার ঘাড়ে এপিফ্যানিক মোমেন্ট ভর করেছে।

নিশ্চিন্দিপুর
বার বার সবার লেখায় পড়েছেন, গ্রামের আকাশ আর শহরের আকাশ আলাদা। গ্রামের আনপলিউটেড আকাশে গিজগিজ করছে ঝলমলে তারা। আপনারও নস্টালজিক শখ: দাও ফিরে সে পাড়াগাঁ লও এ নগর। সিডি-তে ঝিঁঝির ডাক খুঁজে খুঁজে হেদিয়ে গেলেন। এ বার টিকিট কেটে বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের অন্দরে সেঁধিয়ে যান। সিটে তো শুয়েই পড়তে দেয়, গোল স্ক্রিনটা মাথার ওপর। আলো নিভলেই ঘুটঘুটে মহাশূন্য। সেই স্কাইলাইনে তিরিশ তলা বিল্ডিং-এর উৎপাত নেই। প্লাস, ইমপ্রুভ্ড পল্লি, মেঘ-কুয়াশারও নো ঝামেলা। নিজে নিজে দৃষ্টির টর্চ মেরে তারাগুলোকে খুঁজে বার করার কষ্টও নেই। একটি মহাজাগতিক কণ্ঠস্বর সব তারাদের এক্কেবারে কাছে নিয়ে গিয়ে গিয়ে চিনিয়ে দিচ্ছেন (কার গলা কে জানে, ম্যায় সময় হুঁ টাইপ)। এ বার গান লিখুন, কবিতা ভাবুন, কিংবা উদাস রাখাল বালকের ন্যায় ভোঁস ভোঁস ঘুমোন।

জুরাসিক পার্ক
বেশ অন্ধকার মেপেজুপে, সায়েন্স সিটির গেটে যান। টিকিটও কাটতে হবে না। যা একখান দাঁড়িয়ে আছে না, বিকট, সবুজ, অ্যাত্তবড় হা। ওটা সত্যি, বিশ্বাস না করলেই গিলে নেবে!

ছবি: সুমন চৌধুরী


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.