এ বারের অ্যানুয়াল পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ড হাতে পেয়ে চমকে উঠল সোহম। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। অঙ্কে ৩৬ ও বিজ্ঞানে ৩৭। সোহমের এ বার সিক্স থেকে সেভেন হল। অথচ স্কুলের স্যরদের কাছে সোহম বেশ ভাল ছাত্র হিসেবেই পরিচিত। এই তো সে দিন স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে নাটকে অভিনয় করে সোহম কত জনের প্রশংসা পেল। আবার বিজ্ঞান প্রদর্শনীতেও সে প্রথম হয়েছিল। কিন্তু ক্লাস সিক্সে উঠে সোহম কিছুতেই অঙ্ক আর বিজ্ঞানে মন বসাতে পারছিল না। অঙ্কের খাতা আর বিজ্ঞানের বই খুললেই রাজ্যের বিরক্তি ও ক্লান্তি যেন তাকে চেপে ধরে। সোহম মনে মনে ভাবে সারা দিন স্কুল, তার পর খেলার মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলে আর কি মন দিয়ে পড়া সম্ভব? সোহম আশ্চর্য হয় যে, কী ভাবে তার ক্লাসের বন্ধু অর্ক, আকাশ, সায়ন এরা হাসিমুখে ক্লাসের প্রত্যেকটি হোমওয়ার্ক করে নিয়ে আসে। আবার ক্লাসে স্যরেরা ক্লাসওয়ার্ক দিলে কী তাড়াতাড়ি এবং নির্ভুল ভাবে সেগুলো করে ওরা স্যরের কাছে নিয়ে যায়। সোহমের কেমন যেন কুঁড়েমি পাই, উৎসাহের অভাব বোধ করে।
কিন্তু বিজ্ঞানের মডেল তৈরির সময় বা স্কুলের নাটকে অভিনয়ের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন করতে সোহমের বেশ লাগে।
সে দিন স্কুলে এসে একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল সোহমের। নতুন ক্লাসে ক্লাসরুম থেকে পাশের রাস্তা দেখা যায়। পিচ রাস্তার উপরে বাসস্টপের গায়েই সোহমদের স্কুল। জায়গাটার নাম গোপালপুর। কলকাতার খুব কাছেই একটা মফস্সল। সময়টা এপ্রিলের মাঝামাঝি। গরমের ছুটি পড়তে আরও তিন সপ্তাহ। সামনেই দ্বিতীয় ইউনিট টেস্ট। ক্লাসের সব বন্ধুদের মধ্যে একই সঙ্গে একটা ছুটি ছুটি ও পরীক্ষা পরীক্ষা ভাব। কৌশিকস্যরের ফার্স্ট পিরিয়ডেই সোহমের চোখ গিয়েছিল জানলা দিয়ে বাইরের দিকে। দেখছিল কী সুন্দর পলাশগাছ ভর্তি লাল ফুল। আর আম গাছগুলো ফলে পাতায় চমৎকার সবুজ হয়ে আছে। রাস্তার উল্টো ফুটেই রাজুদার স্টেশনারি দোকান। |
বেশ ঝাঁ-চকচকে দোকান। স্কুলের ছেলেদের খাতা, পেন, পেন্সিল এ সব তো পাওয়া যায়ই। এ ছাড়াও পাওয়া যায় আইসক্রিম, আর হরেক রকম মজার মজার জিনিস। ছেলেরা ফাঁক পেলেই সেখান থেকে এই সব জিনিস কেনে। আর রাজুদার দোকানের পাশেই আছে তার বাবার একটা সুপ্রাচীন ও মান্ধাতা আমলের সাইকেল মেরামতির দোকান। বিশাল এক কদম গাছের নীচে দোকানটা। রাজুদার বাবাকে এলাকার সব বয়সের মানুষই ফুর্তি বলে ডাকে। উচ্চতা মেরেকেটে পাঁচ ফুট। বয়সের ভারে বেঁকে যাওয়া দোমড়ানো-মোচড়ানো চেহারা। বয়স ষাটও হতে পারে, আবার সত্তরও হতে পারে। পরনে একটা তেলচিটে লুঙ্গি। খালি গা বা গায়ে কখনও একটা গামছা। মুখে খোঁচা খোঁচা কাঁচা-পাকা দাড়ি। কিন্তু সর্বদা হাসিমুখে ও প্রসন্ন চিত্তে থাকে। এখন এই সাড়ে এগারোটার সময় মহা উৎসাহে সাইকেল সারাই চলছে। চালা নামানো দোকানে কোথাই যে কী পার্টস আছে, ফুর্তি ছাড়া মনে হয় আর কারও পক্ষে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। চার দিকে ছড়িয়ে আছে বিস্তর ভাঙা ও বাতিল হয়ে যাওয়া সাইকেলের পার্টস, চালের মধ্যে গোঁজা অগুনতি টায়ার আর টিউব।
এ বারে তাপসস্যরের থার্ড পিরিয়ডে সোহম দেখল, ফুর্তি তড়াক করে এক লাফ মেরে দোকানের পাশের পাঁচিলে উঠে পড়ল। তার পর সেখান থেকে তার দোকানের চালে সন্তর্পণে উঠে এল। টালির চালের উপর আছে চালকুমড়ো। সেগুলো ঠিকঠাক করে নীচে নেমে এল। এর পর দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা পোষা নেড়ি কুকুরকে কিছু এঁটোকাঁটা খাওয়াল। পোষা ছাগলটাকে ঘাসপাতা খাওয়াল। এ বারে পাশের পুকুর থেকে স্নান সেরে এল। সোহমদের ফোর্থ পিরিয়ড শুরু হল। সোহম দেখল ফুর্তি তাদের স্কুলের গেটের সামনে মোড়ার উপর বসে টেবিলের উপর ঝালমুড়ির সরঞ্জাম, লুচি তরকারি ও তৈরি চাউমিন সাজিয়ে রেডি হয়ে গেল। কারণ, এর পরেই টিফিন। স্কুলে কিছু দিন আগে মিড-ডে মিল চালু হলেও ফুর্তির বিক্রিতে কোনও প্রভাব পড়েনি। কারণ, ছাত্রদের রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী সে খাবারে বৈচিত্র আনে। সারা টিফিন পিরিয়ড জুড়ে গেটের লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে ছেলেদের খাবার দিয়ে গেল ফুর্তি।
এ বারে ফিফ্থ পিরিয়ড শুরু হল। সোহম লক্ষ করল ফুর্তি কোন ফাঁকে দোকান লাগোয়া বাড়ি থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে এসে একটা ভাঙা বেঞ্চে গড়িয়ে নিচ্ছে। সিক্সথ পিরিয়ডে সোহম দেখল ফুর্তি খবরের কাগজ পড়ছে আর রাস্তার লোকের সঙ্গে হাসিমুখে গল্প করছে। লাস্ট পিরিয়ডে দেখল সাইকেলের দোকানের পাশে একটা টেবিলে লস্যির স্টল চালাচ্ছে ফুর্তি। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে সোহমের স্বভাবের মধ্যে একটা অদ্ভুত একটা পরিবর্তন ঘটে গেল। অঙ্ক ও বিজ্ঞান সহ সবেতেই সে আনন্দ খুঁজে পেল। কোনও সময়ই সোহম আর মনমরা হয়ে থাকে না। |