|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
হিংসা, সন্ত্রাস, অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে শিল্পীর প্রতিমাকল্প |
সম্প্রতি বিড়লা অ্যাকাডেমির সম্মেলক প্রদর্শনী ‘ডিস্ট্যান্ট থান্ডার’ দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ। |
সম্প্রতি বিড়লা অ্যাকাডেমি উপস্থাপিত করল ১২ জন তরুণ শিল্পীর সম্মেলক প্রদর্শনী। এদের দু’জন ভাস্কর। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘ডিস্ট্যান্ট থান্ডার’। সুদূরের বজ্রধ্বনি বিচলিত করছে শিল্পীদের। চার দিকে যে হিংসা, সন্ত্রাস, অবক্ষয় তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকে জেগে উঠছে শিল্পীর প্রতিমাকল্প। এটা আধুনিকতারই ধর্ম। উন্নয়নের পাশাপাশি মানবিক অবক্ষয়ও জড়িয়ে থাকে আধুনিকতার মধ্যে। শিল্পীর প্রতিবাদীচেতনায় তার প্রতিফলন ঘটে নিরন্তর। আমাদের দেশে ১৯৪০-এর দশক থেকে এটা ঘটে আসছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজবাস্তবতা পাল্টায়। প্রযুক্তি জটিলতর হয়। তার প্রতিক্রিয়ায় পরিবর্তিত হয় জীবনযাপনের ধরন। সেই পরিবর্তনের প্রতিফলন ঘটে দৃশ্যকলাতেও। আজকের শিল্পীরা সেই জটিলতাকে কী ভাবে আত্মস্থ করছেন, কী ভাবে তাকে রূপান্তরিত করছেন প্রতীকে ও প্রতিমাকল্পে, তারই কিছু আভাস উঠে এল এই প্রদর্শনীতে। শিল্পীদের তন্নিষ্ঠ সন্ধান ও রূপায়ণপ্রয়াস প্রদর্শনীটিকে সমৃদ্ধ করেছে।
অরুণাংশু রায় কলকাতার ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজ থেকে ২০০০ সালের স্নাতক। তাঁর চারটি অ্যাক্রিলিকের ক্যানভাসে বজ্রধ্বনির ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ ভাবে তেমন নেই। কিন্তু লৌকিক অলঙ্করণধর্মী প্রতিমাকল্পের ভিতর দিয়ে তিনি কৌতুকদীপ্ত ভাবে গ্রামের রূপান্তরকে যে ভাবে ধরেছেন, তাতে অতীত ও বর্তমানের সংঘাত থেকে প্রচ্ছন্ন এক ট্র্যাজিক চেতনাও জেগে ওঠে।
কৃষ্ণা ত্রিবেদী লখনউ-এর আর্ট কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন ২০০৮ সালে। কাগজের উপর মিশ্রমাধ্যমে আঁকা তাঁর দু’টি ছবির বিষয় গ্রামের রূপান্তর। আদিবাসী চিত্রকলার আঙ্গিক পদ্ধতিকে কৌতুকদীপ্ত কল্পরূপাত্মক ভাবে খুব সুন্দর ব্যবহার করেছেন। নতুন নির্মাণ হচ্ছে। মানুষেরা উৎসবে মেতে আছে। পতাকা উড়ছে। সমস্তই যেন শান্তিকল্যাণ। ভারতবর্ষের আবহ এমন হলে ভাল হত। কিন্তু তা হয় না।
|
|
শিল্পী: সুদীপ সাহা |
জন্মসূত্রে কেরলের মানুষ বাবু জেভিয়ার স্বশিক্ষিত শিল্পী। খুবই প্রতিষ্ঠিত মধ্যবয়সী এই শিল্পীর নিসর্গধর্মী দু’টি ছবি রয়েছে এই প্রদর্শনীতে ক্যানভাসের উপর অ্যাক্রিলিক রঙে আঁকা। তাঁর এই অভিব্যক্তিধর্মী নিসর্গের মধ্যে প্রকৃতির অন্তর্নিহিত ক্ষয় আভাসিত হয়।
ওড়িশার শিল্পী দিল্লি আর্ট কলেজ থেকে ১৯৯৮তে স্নাতকোত্তর করা প্রতুল দাশ-এর একটিই ছবি রয়েছে। বড় অ্যাক্রিলিকের ক্যানভাস, শিরোনাম ‘স্পিলড ওয়াটার’। অনুপুঙ্খ স্বাভাবিকতা আশ্রিত সুররিয়ালিস্টধর্মী ছবি। শূন্য প্রান্তরে এক স্থাপত্য দাঁড়িয়ে আছে। তাতে জল বিচ্ছুরিত হচ্ছে দু’ভাবে। হাঁড়ি থেকে ছিটকে পড়ছে। আর একটি বালক ছাদ থেকে নীচে মূত্রপাত করছে। আধুনিকতার ঔদ্ধত্যকে এ ভাবেই বিদ্রুপ করেছেন শিল্পী।
মিঠুন দাশগুপ্ত কলকাতার রবীন্দ্রভারতী থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন। তিনটি অ্যাক্রিলিকের ক্যানভাসে স্বাভাবিকতাকে বিশ্লিষ্ট করে অভিব্যক্তিধর্মী কিমাকার রূপারোপ করেছেন। ‘বনসাই’ ছবিতে টুপি মাথায় পাইপ মুখে একজন লোক কাঁচি দিয়ে ছাঁটছে টবের উপর বামন করে রাখা গাছের পাতা। প্রতিটি পাতা এক একটি মানুষের চোখ।
কলকাতার শিল্পী সুদীপ সাহা হায়দরাবাদে স্নাতকোত্তর স্তরে এখনও ছাত্র। তাঁর ‘ইরিটেটিং’ শীর্ষক ছবিটি যেন ‘সুদূরের বজ্রধ্বনি’র সুস্পষ্ট প্রতীক হয়ে উঠেছে। আতঙ্কগ্রস্ত এক তরুণের মুখ। সমস্ত মুখ জুড়ে বসে আছে ঝাঁক ঝাঁক মাছি। চারপাশে বাতাসেও উড়ছে তারা। উপর থেকে একটি কাক ধেয়ে আসছে তাদের দিকে। শান্তিনিকেতনের শিল্পী সনাতন সাহার ‘হিউম্যান অব থার্ড ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক ছবিটি মূর্ত-বিমূর্তের সমাহারে মানবতা-বিমানবিকতার সংঘাতকে প্রতীকায়িত করেছে। জন্মসূত্রে ঝাড়খন্ডের শিল্পী রাজেশ রামের রচনাতে ধরা পড়েছে আজকের গ্রামে বিশ্বায়নের অভিঘাত। প্রদর্শনীর মূল ভাবনার সঙ্গে সাযুজ্যময় কলকাতার তুষারকান্তি প্রধানের ইনস্টলেশনধর্মী ছবি ও মানিককুমার ঘোষের ছাপচিত্রের উপস্থাপনা।
প্রদর্শনীর তরুণতম শিল্পী উত্তর প্রদেশের দেবেশ উপাধ্যায়। টেরাকোটা ভাস্কর্যে এক স্বতন্ত্র রূপভঙ্গি তৈরি করেছেন তিনি। কলকাতার সৈকত হালদারের পাথর ও মিশ্রমাধ্যমের চারটি ভাস্কর্যেও আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক রূপচেতনার সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে একই সঙ্গে ধ্রুপদী বোধ ও প্রতিবাদী অনুষঙ্গ উঠে এসেছে।
এখনকার বিকল্প রূপকল্প বা ‘অল্টারনেটিভ আর্ট’-এর পাশাপাশি আধুনিকতাবাদী আঙ্গিকেও শিল্পীরা যে নতুন দিগন্ত মেলে ধরেছেন, এই প্রদর্শনীতে সেই সফলতার কিছু উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে। |
|
|
|
|
|