শস্য-শ্যামলা প্রকৃতি বন্দনাকে ঘিরে একাদশী তিথি থেকে ডুয়ার্সের রাজবংশী সমাজে শুরু হল অন্য শারদোৎসব। যা কি না উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় ভাণ্ডানি আরাধনা হিসেবেই পরিচিত। সঙ্কটাপন্ন কৃষি ভিত্তিক জীবনে বিলুপ্তপ্রায় আদি সংস্কৃতিকে আঁকড়ে আত্মকেন্দ্রিকতার বাঁধন ছেঁড়ার অদম্য ইচ্ছাই ওই উৎসবের উৎস। কোথাও একাদশী তিথি থেকে তিন দিনের মধ্যে ভাণ্ডানি পুজো হয়। আবার কোথাও লক্ষ্মী পূর্ণিমার দিন দেবীর কাছে সমাজের সার্বিক মঙ্গল কামনা করবেন চাষি থেকে সাধারণ মানুষ। বৃহস্পতিবার তিস্তা ও সঙ্কোশ নদী পাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দারা সকাল থেকে মেতে ওঠেন। ভাণ্ডানি আরাধনায় এ দিন সবচেয়ে বড় পুজোর আয়োজন হয় ময়নাগুড়ির বার্নিশ এলাকায়। জলপাইগুড়ি জেলা ছাড়িয়ে শিলিগুড়ি, কোচবিহার এবং উত্তর দিনাজপুর থেকে প্রচুর ভক্ত সেখানে ভিড় করেন। সকাল থকে রাত পর্যন্ত মেলা চলে। স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দা নরেশ রায় বলেন, প্রতি বার ভিড় বাড়ছে। এ বার সকাল থেকে ভিড় ঠেলে এগোতে হয়েছে।” সকালে স্নান সেরে শুধু যে রাজবংশী পরিবারের মানুষজন পুজো প্রাঙ্গণে হাজির হয়েছেন তা নয়, শহরের মানুষেরা দেবী মণ্ডপে পৌঁছে শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়েছেন। অনেকে প্রথমবার এসে দেবীর রূপ দেখে অবাক হয়েছেন। নৈবেদ্য সাজিয়ে দিয়েছেন দেবীকে। |
শুরু হল ভাণ্ডানি পুজো। ময়নাগুড়িতে দীপঙ্কর ঘটক-এর ছবি। |
ভাণ্ডানী দেবী মূলত দ্বিভূজা ব্যাঘ্র বাহিনী। রক্তিম বর্ণ। তিনি পশ্চিম মুখে বসেন। সময়ের সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় দেবীর গড়নে পরিবর্তন এসেছে। বাহন বাঘ হয়েছে সিংহ। দ্বিভূজা দেবী হয়েছেন চতুর্ভুজা। তাই ভাণ্ডানিকে কোথাও দুর্গা, কোথাও বনদুর্গা কল্পনা করে পুজোর প্রথাও চালু হয়েছে। দশমীর রাতে পুজোর সমস্ত প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হয়ে যায়। রাজবংশী সমাজের পুরোহিত দেউসি একাদশীর ভোরে দুধ, দই, চিনি, বাতাসায় নৈবেদ্য সাজিয়ে পুজো শুরু করেন। উত্তরবঙ্গে ওই দেবী ভাণ্ডারনি এবং ভাণ্ডলী নামেও পরিচিত ব্যাঘ্র বাহিনী দেবী সম্পকে রকমারি গল্প প্রচলিত রয়েছে। অনেকে মনে করেন, দেবী দুর্গা দশমীতে কৈলাসে ফিরে যাওয়ার পথে গ্রামের পর্ণ কুটিরে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি একাদশীতে ভাণ্ডানি রূপে পূজিত হন আবার অনেকে মনে করেন। ভাণ্ডানি দেবী দুর্গার মালপত্রের দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক জন। পুজোর পরে কোচবিহারের রাজবাড়ি থেকে দেবী শ্বশুরালয়ে ফিরে যাওয়ার পথে ভাণ্ডানি অসুস্থ হয়ে পড়েন। দেবী বাধ্য হয়ে আরও তিনদিন থেকে যান। ওই সময় ফের তাঁর পুজোর আয়োজন হয়। গবেষকদের একাংশ মনে করেন, ভাণ্ডানি আদতে মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভুত। কৃষি ভিত্তিক সমাজের শস্যের দেবী শস্যের প্রাচুর্যের আশায় ওই দেবী আরাধনার সূত্রপাত। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক দীপক রায় জানান, ভাণ্ডানি কৃষির দেবী। কিছু গবেষক অবশ্য মনে করেন, ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছিল শ্বাপদসঙ্কুল ঘন জঙ্গলে ভরা মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভুত নানা গোষ্ঠীর বসতি এলাকা। এখানে ভালুকের উপদ্রব ছিল। স্থানীয় সমাজে ভালুক ভাণ্ডি নামে পরিচিত। ওই ভাণ্ডির হাত থেকে রক্ষার জন্য তাঁরা যে দেবীর আরাধনা শুরু করে সেটাই ভাণ্ডানি নামে পরিচিতি পায়। |