আকস্মিক এই চলে যাওয়া যেন পাখির চোখে বালুকণারও অসামান্যতা দেখতে
দেখতে চলে যাওয়া। যমুনার হাত ধরে স্বর্গের বাগানে এখন তাঁর ছুটোছুটির সময়।
শঙ্খ ঘোষ |
কী রকম ভাবে বেঁচে ছিলেন তিনি, নতুন দিনের পাঠকেরা এখন থেকে তা জানবেন শুধু তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে।
কেমন হতে পারে নতুন দিনের কবিতা, এ নিয়ে তরুণ সুনীলকে এক বার কয়েকটা কথা লিখেছিলেন তাঁর সদ্য-পাওয়া বন্ধু অ্যালেন গিনসবার্গ, ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে। ‘হাউল’ দিয়ে জগৎসংসার মাতিয়ে গিনসবার্গ তখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন কলকাতা-বারাণসী, একাকার মিশে গেছেন ‘কৃত্তিবাস’-এর কবিদলের সঙ্গে। সেই সময়টায় তিনি লিখছেন সুনীলকে, যা কিছু তুমি অনুভব করো তাকে ঠিক-ঠিক বলে যাওয়াটাই হল কবিতার কাজ, যেখানে থাকবে তোমার সমস্ত রকম স্বীকারোক্তি সমস্ত রকম অসন্তোষ সমস্ত রকম উচ্ছলতা। ‘কী তোমার হওয়া উচিত’ সে দিকে কিছুমাত্র লক্ষ না রেখে কবিতা আজ জানতে চায় তুমি ঠিক কেমন।
নিজেরই মধ্য থেকে তেমন এক অভিমুখে এগোতে চাইছিলেন সুনীল, তবু ওই চিঠিটি বোধ হয় সাহায্য করেছিল তাঁর শেষ দ্বিধাটুকু ভেঙে দিতে। ‘একা এবং কয়েকজন’-এর কবি তাই এক ঝটকায় এগিয়ে এলেন ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’-র বৃত্তান্তে। আর, এই বৃত্তান্ত শুধু যে তাঁর ওই একটিমাত্র বইয়েরই নাম হয়ে রইল তা নয়, এইটেই হয়ে দাঁড়াল তাঁর আদ্যন্ত সমস্ত কবিতার সাধারণ পরিচয়। তাঁর কবিতা তাঁর বেঁচে থাকার ধারাবিবরণ। এমনই ভাবে সে বিবরণ তিনি বলে যান নতুন কালের ভাষায় যে অনেক পাঠকই তাতে দেখতে পান তাঁদেরও আত্মপ্রতিচ্ছবি, নিজে নিজে যা তাঁরা দেখতে পাননি, হয়তো বা দেখতে চাননি। এই ভাবে, আত্মস্বীকারোক্তি দিয়েই সুনীল তৈরি করে তুলতে পেরেছিলেন বড় একটা পাঠকসমাজেরও স্বীকারোক্তি। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৩৪-২০১২ |
আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি, সেটা দেখতে গেলে কেবল যে আমিটুকুতেই আটকে থাকে মানুষ, তা কিন্তু নয়। আমার সেই বেঁচে থাকার মধ্যে আমার নিজস্ব দৈনন্দিন যেমন আছে, তেমনি তো আছে আমার চারপাশের মানুষজনও, চারপাশের পৃথিবীও। সেও তো আমি-রই অভিজ্ঞতা, আমার বেঁচে থাকারই। তখনই ভূমধ্যসাগরের ওপর দিয়ে ধাবমান উড়োজাহাজের মধ্যে নিজেরই ক্ষুৎকাতর চিৎকারের পাশাপাশি জেগে উঠতে পারে গোটা জগতের বুভুক্ষুরা, তখনই দেখা যায় ‘পিছনে জ্বলন্ত ইউরোপ, সামনে ভস্মসাৎ কালো প্রাচ্যদেশ’। তখনই চে গুয়েভেরার মৃত্যু এসে অপরাধী করে দিতে পারে আমাকে, তখনই পথের পাশে বসে থাকা অবহেলিতাকে দেখে কারও মনে পড়ে যেতে পারে আপন ধাইমাকে, স্বভূমির জন্য আবেগভরা ভালবাসায় তখনই বলা যায় ‘যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াব/ আমি বিষ পান করে মরে যাব’, কেননা বিষন্ন আলোর এই বাংলাদেশের ভূমি ছেড়ে কোথায় আমি যাব! অথচ সর্বস্ব জড়িয়ে নিয়ে এই দেশটাকে এই পৃথিবীটাকে এমন ভাবে ভালবাসেন যে মানুষ, অনেক সময়েই খণ্ডভাবে বা ভুল ভাবে তিনিই চিহ্নিত হয়ে যান নিছক ব্যক্তিকেন্দ্রিক হিসেবে, অতিযৌনতায় কাতর মানুষ হিসেবে, বা নিতান্ত রবীন্দ্রবিদ্বেষী এক কবি হিসেবে।
আলগা আলগা কিছু লাইন সে-ভুলবোঝায় সাহায্য করে অবশ্য। যেমন, এক সময়ে বিস্তর হইহই হল ‘তিনজোড়া লাথির ঘায়ে রবীন্দ্ররচনাবলী লুটোয় পাপোষে’-এর মতো কথাটাকে নিয়ে। ‘এ তো ঈশ্বরদ্রোহিতা’— মনে হয়েছিল সে কালে অনেকের। খাটের ওপর ছিল কয়েকখানা বই, ঘটনাচক্রে রবীন্দ্ররচনাবলিই, ঘুমন্ত তিন বন্ধুর পায়ে লেগে সেটাই পড়ে গিয়েছিল মাটিতে, এইটুকু ছিল ঘটনা। কিন্তু এ ঘটনাকেও কবিতায় না আনলে কী ক্ষতি হত? ক্ষতি কিছুই হত না, শুধু ঘটনাটা বলা হত না, পাওয়া যেত না এই ছবিটি। মনে মনে রবীন্দ্রবিদ্বেষ না থাকলে কি ও লাইন লিখতে পারে কেউ? এ প্রশ্ন মনে উঠলে তাঁকে জানিয়ে দিতে হয় এই মানুষটারই আর একটা উচ্চারণ: ‘কয়েক দিন ধরে মনটা ভারি আনন্দে ভরে আছে। শুধু রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ছি।’
তার মানে অবশ্য এ নয় যে কবিতা জগতে রবীন্দ্রনাথের থেকে অনেকখানি দূরত্ব চাননি এই কবি, বা কবিরা। চেয়েছিলেন নিশ্চয়ই, অনেক রকমভাবেই চেয়েছিলেন সেই দূরত্ব। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে সেই দূরত্বটা ছিল কিন্তু ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’-র বোধের মতোই। একটি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এক বার লিখেছিলেন ‘যেমন-হওয়া-ভালো’র দিকে ‘যেমন-হয়ে-থাকে’র চলার কথা। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত জীবনবোধ আর সাহিত্যবোধ নির্ভর করে ছিল এই চলনটার উপর। আর ঠিক এর বিপরীতেই ছিল গিনসবার্গের সেই পরামর্শ যে ‘what should be’ leads one astray। সেই বিপরীতেই সুনীলের সমস্ত জীবনের ‘আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি’র দলিল। তাই, রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে কয়েক দিন ধরে মনটা ভাল থাকলেও সৃষ্টিমুহূর্তে তাঁকে অনেক দূরবর্তী হয়ে যেতে হয় সেই জগৎ থেকে।
দূরবর্তী সেই জগতে, ছোটমাসির বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে গিয়ে প্রথম যৌন আনন্দ পাওয়ার বয়ঃসন্ধিশোভন নিতান্ত স্বাভাবিক এক অনুভবের কথা বলতে গিয়ে এক দিন কত-না ধিক্কৃত হতে হল এ-কবিকে। সন্দেহ নেই যে তীব্র যৌনতা তাঁর কবিতার অন্যতম বড় ভর। কিন্তু সেইখানেই যে থেমে থাকে না সেটা, এর থেকে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি যে এক ব্যাপ্তমদির ভালবাসার জগতে পৌঁছে দেন তাঁর কবিতাকে, সেটা অনেক সময়ে ভুলে থাকি আমরা, ভুলে থাকি এক কাতর করুণ প্রেমিকের আর্ত-মুখচ্ছবি। যেখানে গিয়ে বলা যায় ‘আয় খুকি, স্বর্গের বাগানে আজ ছুটোছুটি করি’, ভালবাসা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় সেই স্বর্গের বাগান। নীরার প্রেমিক হিসেবেই তাঁর জনপ্রিয় পরিচয়, এবং মিথ্যে নয় সে-পরিচয়। কিন্তু শুধুই নীরা নয়, শুধুই নারী নয়, সুনীলের কবিতায় ভালবাসা ছড়িয়ে আছে দেশের প্রত্যেকটি বিন্দুর জন্য, প্রত্যেকটি মানুষের জন্য। যেমন ব্যক্তিজীবনে, তেমনই কবিতায়, এই ভালবাসাই তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি, বড় পরিচয়। কোনও গণ্ডিবদ্ধ ভালবাসা নয়, সর্বাত্মক সর্বভুক ভালবাসা।
আর এই ভালবাসার কথা বলতে গিয়ে যে ভাষা সুনীল ব্যবহার করেন, যে ভঙ্গি, তাতে একটু একটু করে মুছে আসে কবিতার সঙ্গে গদ্যজগতের দূরত্ব। এই দূরত্বটাকে একেবারে সরিয়ে দেওয়াই ছিল তাঁর কবিজীবনের প্রধান এক কাজ। আজ থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগেকার নিভৃত এক দুপুরে কোনও বন্ধুজনের কাছে তিনি বলছিলেন নতুন কবিতার পথসন্ধানের কথা। আমেরিকার আয়ওয়া শহরের এক বছরের প্রবাসজীবন ছেড়ে ফিরে এসেছেন তখন, গাঢ় পরিচয় ঘটেছে সমকালীন বিশ্বকবিতার সঙ্গে। বলছিলেন তখন: লিরিকের পথ আর আমাদের পথ নয়, ভিন্ন এক গদ্যপন্থায় চলবে আজ কবিতা। অন্তত তাঁর নিজের কবিতা সেই পথ ধরে চলতে চেয়েছে তখন থেকে, অতিরহস্যের মায়াজাল ছেড়ে দিয়ে।
গদ্যপদ্য একাকার হয়ে যায়, যাপন আর সৃষ্টি একাকার হয়ে যায়, জেগে থাকে শুধু এক সত্যমূর্তি, স্বাভাবিক চেহারায়। তাঁর জীবনগত আচরণের স্বচ্ছন্দতা আর স্বতঃস্ফূর্তি চিহ্ন রেখে যায় তাঁর কবিতায় কিংবা তাঁর প্রবহমান গদ্যে। এই সব কিচ্ছুই পাঠকের সামনে বইতে থাকে যেন সাবলীল এক জলধারার মতো। এক দিন সে জলের ছিল পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ার তোড়, তার পর আস্তে আস্তে মৃদুতার দিকে এগিয়ে আসে স্রোত। তীক্ষ্ন ব্যথা হয়ে ওঠে গহন বেদনা।
সেই বেদনা নিয়ে আজ চলে যান সব-কিছু-দেখতে-চাওয়া সব-কিছু-ছুঁতে চাওয়া প্রেমময় এই মানুষ। ভালবাসার হিরের গয়না নিয়ে জন্মেছিলেন যিনি, তাঁর আকস্মিক এই চলে যাওয়া যেন পাখির চোখে বালুকণারও অসামান্যতা দেখতে দেখতে চলে যাওয়া। যমুনার হাত ধরে স্বর্গের বাগানে এখন তাঁর ছুটোছুটির সময়। |