নিজের পোশাক নির্বাচন করিবার অধিকার কি ‘মানবাধিকার’ বলিয়া গণ্য করা উচিত? সম্প্রতি কোচিতে সেই প্রশ্ন উঠিয়াছে। কখনও ধর্ম, কখনও সংস্কৃতি, কখনও নিয়মানুবর্তিতার যুক্তি দেখাইয়া মহিলাদের কোনও একটি নির্দিষ্ট পোশাক পরিতে বাধ্য করিবার প্রচেষ্টা চলিতেছেই, আর তাহা মানিতে অস্বীকার করিয়া মহিলারাও রাষ্ট্রের নিকট দরবার করিতেছেন। সম্প্রতি কেরলের কোচিতে এক স্কুল শিক্ষিকাকে তাঁহার স্কুল কর্তৃপক্ষ নিয়মভঙ্গের দায়ে শাস্তি দিয়াছে, কারণ তিনি সবুজ ওভারকোট অথবা কালো চাদর পরিতে অস্বীকার করিয়াছিলেন। তিনি পরিয়াছিলেন সাদা ডাক্তারি ওভারকোট। কিন্তু তাহাও স্কুল কর্তৃপক্ষের পছন্দ হয় নাই। শিক্ষিকা মানবাধিকার কমিশনের দ্বারস্থ হইয়াছেন, স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁহার এই আচরণকে ‘বাড়াবাড়ি’ বলিয়াছে, কিন্তু কমিশনের এক সদস্য ইহাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলিয়া মত প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহার বক্তব্য, সবুজ রঙ পরিতে বাধ্য করা রাজ্যবাসীর মধ্যে ধর্মীয় বিভাজনকে আরও বড় করিবে। স্কুল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, ইহার মধ্যে ধর্মীয় উদ্দেশ্য নাই। কোনও ব্যক্তিকে একটি বিশেষ পোশাক পরিতে বাধ্য করা কখন যুক্তিযুক্ত হইতে পারে? সেনাবাহিনীর মতো কয়েকটি ক্ষেত্রে পোশাক ব্যক্তিত্বের অভিব্যক্তি নহে। ব্যক্তির পদই তাহার পরিচয়। অপরের নিকট নিজেকে সহজে চিনাইবার জন্যও নির্দিষ্ট পোশাকের ব্যবহার করেন অনেকে। সরকারি দফতরের বাবু, সাহিত্য বাসরের কবি আর নির্বাচনী প্রচাররত ভোটপ্রার্থী, বিশেষত পুরুষ হইলে, এক অলিখিত নিয়মে নির্দিষ্ট প্রকারে সাজসজ্জা করিবেন। আবার খেলার দল ইত্যাদি একতার বোধ আনিতেও এক পোশাক সাহায্য করে।
কিন্তু ব্যবহারিক প্রয়োজন ছাড়াও পোশাকের আরও একটি প্রয়োজন রহিয়াছে— আত্মপ্রকাশ। নিজের রুচি, সৌন্দর্যবোধ এবং ব্যক্তিত্ব পোশাক নির্বাচনের মাধ্যমে যত সহজে প্রকাশিত হয়, এমন আর কিছুতেই নহে। এ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের দিকে তাকাইলেও দেখিতে পাই, তাঁহারা নিজেদের জীবনের মধ্যস্থলের ভাবনাটি তাঁহাদের পোশাকের মাধ্যমে প্রকাশ করিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথের যে লম্বা জোব্বার সহিত আমরা পরিচিত, যাহা তাঁহার স্বনির্বাচিত পোশাক, তাহা বিশ্বের যে কোনও দেশেই মানাইত। তাহা সংযত আভিজাত্যের একটি নান্দনিক প্রকাশ। অপর দিকে গাঁধীজির ত্যাগ, কষ্টসহিষ্ণুতা, দরিদ্রতম মানুষের সহিত তাঁহার একাত্মতা তাঁহার খাটো ধুতি এবং নিরাবরণ ঊর্ধ্বদেহ হইতেই স্পষ্ট হইয়া যাইত। বিবেকানন্দের উজ্জ্বল বর্ণের সন্ন্যাস বেশ কিংবা নেহরুর পরিপাটি কোটের বুকে লাল গোলাপ, সবই তাঁহাদের বিশিষ্টতা বহন করে। তাঁহাদের পরিচয় সকলের নিকট স্পষ্ট করে। অতএব যে সকল পেশায় একই পোশাক পরা আবশ্যক নহে, সেখানে কোনও একটি পোশাক পরাইবার ইচ্ছাটির প্রতিরোধ করাই উচিত। তাহাতে কোনও এক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইচ্ছা অনেকের উপর চাপাইবার প্রচেষ্টাই প্রকাশ পায়। ইহা অগণতান্ত্রিক, ব্যক্তি অধিকারেরও বিরোধী। |