সম্পাদকীয় ১...
সৌজন্যের কৌশল
সৌজন্য’ শব্দটি বাঙলাভাষায় নেহাত অপরিচিত নহে, যদিও অধুনা শব্দটি ব্যবহারের বিশেষ অবকাশ মিলে না। শব্দটির অর্থ: সুজনের ভাব। অর্থাৎ, কেহ প্রকৃত সুজন হইলে তাঁহার আচরণ হইতে সৌজন্যকে বাদ দেওয়া অসম্ভব হইবে। আশঙ্কা হয়, এই বঙ্গে সুজনের সংখ্যা অতি দ্রুত হারে হ্রাসমান। একটি উদাহরণ খুঁজিলে হাজারটি পাওয়া যাইবে, ফলে একটি সাম্প্রতিক ঘটনারই উল্লেখ থাকুক। বর্ধমানে সি পি আই এম-এর সাংসদ শেখ সইদুল হক অভিযোগ করিয়াছেন, তাঁহার নির্বাচনী কেন্দ্রে রেলের এক অনুষ্ঠানে তাঁহাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় নাই। তিনি লোকসভার স্পিকারের নিকট সরকারি প্রোটোকল ভঙ্গের অভিযোগ দায়ের করিয়াছেন। নিমন্ত্রণ না করিবার দায় কাগজে-কলমে রেলবোর্ডের। কিন্তু, কে, কাহার মন রাখিতে সি পি আই এম-এর সাংসদকে আমন্ত্রণ করিতে নিষেধ করিয়াছিলেন, তাহা বুঝিতে রাজা রায়চৌধুরী হওয়ার প্রয়োজন নাই। তৎকালীন রেলমন্ত্রী মুকুল রায় দাবি করিয়াছেন, ঘটনাটিতে প্রোটোকল ভঙ্গ হয় নাই। যদি না-ও হয়, তাহাতেও কি অসৌজন্যের তীব্র কটু গন্ধ দূর হয়? এই রাজ্যে বিরোধীদের সহিত জল-অচলের যে সংস্কৃতির প্রচলন হইয়াছে, তাহার তুচ্ছতা কি প্রোটোকলে মাপিবার প্রয়োজন পড়ে?
তবে, এই অসৌজন্যই হয়তো পশ্চিমবঙ্গের চূড়ান্ত অভিজ্ঞান হইবে না। যে কবি-সাহিত্যিকের প্রয়াণে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ শোকস্তব্ধ হইয়াছে, সেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শেষযাত্রায় মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিই একটি আশার আলোকশিখা। সুনীল ঘোষিত ভাবেই ‘পরিবর্তনপন্থী’ ছিলেন না। রাজ্যের প্রাক্তন বামশাসকদের সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠতা সুবিদিত ছিল, তাঁহার মন কোন দিকে, তাহাও তিনি গোপন রাখেন নাই। এই পত্রিকাতেই তিনি লিখিয়াছিলেন, বাম শাসনের অবসান ঘটিলে যাঁহারা ক্ষমতায় আসিবেন, তাঁহাদের কথা ভাবিলে তাঁহার বিবমিষা হয়। ফলে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বজন’ বলা মুশকিল। ব্রাত্য বসু যে সিপিএমত্ব-তৃণমূলত্বের ভাগ করিয়া দিয়াছেন, শ্রীগঙ্গোপাধ্যায় সেই ভাগের ‘ভুল প্রান্তে’ই ছিলেন। কাজেই, মুখ্যমন্ত্রী যদি তাঁহার শেষযাত্রায় উপস্থিত না থাকিতেন, পশ্চিমবঙ্গবাসী বিস্মিত হইতেন না। কেহ বলিতেন না, এই আচরণ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে মানায় না। মানাইত যে না, তাহা অস্বীকার করিবার নহে— কিন্তু রাজনৈতিক অসৌজন্যে রাজ্যবাসী এমনই অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন যে ঘটনাটি কাহারও চোখে বেমানান ঠেকিত না। মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু সেই সুযোগ নেন নাই। কেহ তাঁহার অসৌজন্য চোখে আঙুল দিয়া দেখাইবে না জানিয়াও তিনি সৌজন্য বজায় রাখিয়াছেন। প্রয়াত কবির মরদেহে মাল্যদান করিতে তিনি দ্বিধা করেন নাই। দেখিয়া ভরসা হইতেছে, হয়তো অসৌজন্যের পারাবারের অপর পার্শ্বে কী আছে, তাহা দেখিবার সুযোগ পশ্চিমবঙ্গবাসীরও হইবে।
একটি কূটপ্রশ্ন অনিবারণীয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রয়াত হইবার পর তাঁহাকে কেন্দ্র করিয়া বাঙালির আবেগের যে বিস্ফোরণ ঘটিয়াছিল, তাহাকে অবজ্ঞা করা কোনও রাজনীতিকের পক্ষে নির্বুদ্ধিতা। শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় নির্বোধ নহেন, অতএব সুনীলের শেষ যাত্রায় প্রবল ভাবে উপস্থিত থাকিয়াছেন। ইহা সৌজন্য নহে, কৌশল। সম্ভব। কিন্তু গণমানসে প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবিয়াও যদি রাজনীতিকরা অসৌজন্যের রাজনীতি হইতে দূরে থাকেন, তাহাও গণতন্ত্রের পক্ষে সুসংবাদ বইকী। আবার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেই তো তাঁহার রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে তৃণমূল সরকার শিশু কিশোর আকাডেমির সভাপতি পদ হইতে সরাইয়া দিয়াছিল। শেষ যাত্রার সৌজন্য হয়তো নিছক একটি মধ্যবিত্ত সংস্কারপ্রসূত— মৃতের সহিত আর ঝগড়া রাখিতে নাই। যদি তাহাই হয়, তবু মন্দ কী? যে বিশ্বাস বাঙালি রাজনীতিকদের অসৌজন্যের পথ হইতে ফিরাইয়া আনিবে, তাহাই বঙ্গজনের নিকট আশীর্বাদ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জানিলে খুশি হইতেন, সারা জীবন যে সৌজন্যকে তিনি সর্বাগ্রগণ্য জ্ঞান করিয়াছিলেন, তাঁহার প্রয়াণকে কেন্দ্র করিয়া পশ্চিমবঙ্গে হয়তো সেই সৌজন্য ফিরিতেও পারে। তবে আপাতত ইহা আশামাত্র। যেখানে সৌজন্যের ‘রাজনৈতিক প্রয়োজন’ নাই, সেখানেও তাহা মিলিবে কি? আপাতত প্রতীক্ষা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.