|
|
|
|
স্মরণ ২... |
শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
(১৯৩৪-২০১২) |
দেখো দেখো, দেশ পত্রিকায় কবিতা বেরিয়েছে এক জনের। তাঁর নামও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
১৯৫০ সালে যে কিশোরী কথাগুলো বলেছিল, তার সামনে দাঁড়ানো ষোলো বছরের ছেলেটিই সুনীল। আর সেই কবিতা, ‘একটি চিঠি’ লেখা হয়েছিল ওই মেয়েটির কথা ভেবেই। সে জানতে পারেনি। পরে ‘কৃত্তিবাস’ নিয়ে মেতে ওঠার পর্বে তার সঙ্গে সুনীলের সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়।
ছাপার অক্ষরে প্রথম কবিতা আর দ্বিতীয় কবিতার মধ্যে তিন বছরের ব্যবধান। লেখা বন্ধ ছিল না, কিন্তু ছাপতে দেননি কিছু। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্য জীবনে ওই তিনটে বছরই নীরবতার বছর। ওই প্রথম, ওই শেষ। ১৯৫৩ সালেই দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ কবিতা বেরোল। চতুর্থটি বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় বেরোল আর অচিরেই আবু সয়ীদ আইয়ুবের সম্পাদনায় ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’ সংকলনে নির্বাচিত হল। ওই বছরই ছাপা হল প্রথম ছোট গল্প, ‘বাঘ’। এবং আত্মপ্রকাশ করল ‘কৃত্তিবাস’। সম্পাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সঙ্গে দীপক মজুমদার এবং আনন্দ বাগচী। নিজেকে যে কত ভাবে ছড়িয়ে দেবেন সুনীল, ওই উনিশ বছর বয়স থেকেই তার দিকচিহ্নটি ছিল স্পষ্ট।
উনিশ থেকে আটাত্তর। এর মধ্যে সুনীলের শুধু বইয়ের সংখ্যাই আড়াইশোর বেশি। সম্পাদিত গ্রন্থ পঞ্চাশের অধিক। কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণসাহিত্য, নাটক, চিত্রনাট্য, শিশুসাহিত্য এতগুলি শাখায় সাবলীল বিচরণের রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকারটি সুনীলের জন্যই তোলা ছিল। যৌবনে রবীন্দ্র-বিরোধী বলে তকমা জুটেছিল যদিও। সুনীল কিন্তু পরে বলেছিলেন, ওঁর বিদ্রোহ রবীন্দ্রনাথের প্রতি ছিল না। ছিল, রাবীন্দ্রিকতার নামে বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে।
আরও দু’টি দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরি ছিলেন সুনীল। বাঙালি মধ্যবিত্তসুলভ কূপমণ্ডূকতা ওঁর স্বভাবে ছিল না কোনও দিন। সুনীল মানেই পায়ের তলায় সর্ষে। আর, সুনীল মানেই দরজা-জানলা খোলা একটা তরতাজা মন। অজস্র বিষয়ে আগ্রহ, পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে সদা সচেতন। স্পষ্টবাক, প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে নিজস্ব মতামত তা সে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়েই হোক বা রাজ্যে পরিবর্তনের হাওয়া নিয়েই হোক। নীরা কে, এই প্রশ্নটি ছাড়া আর কোনও ব্যাপারে প্রশ্নকর্তাকে কখনও নিরাশ করেননি সুনীল।
ছাত্র বয়স থেকেই হুটহাট বেরিয়ে পড়তেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত সেই বাউন্ডুলেপনা কোনও দিন থামেনি। সাঁওতাল পরগনা থেকে প্যারিস, নিউ ইয়র্ক থেকে শান্তিনিকেতন, সুনীলের উৎসাহ সমান। নিজেই বলতেন, লেখক হওয়ার কোনও দুরাকাঙ্ক্ষা তাঁর ছিল না। কলেজজীবনে সুনীলের স্বপ্ন বলতে একটাই, জাহাজের খালাসি হয়ে সাত সমুদ্র পাড়ি দেওয়া। খালাসির চাকরি সুনীলকে করতে হয়নি, কিন্তু বাংলা সাহিত্য নীললোহিতকে পেয়েছে। বাঙালির অভিধানে দিকশূন্যপুর শব্দটা চিরকালের মতো ঢুকে গিয়েছে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। সাবেক পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলায় মাইজপাড়া গ্রামে ছিল ওঁদের পৈতৃক বাড়ি। বাবা কালীপদ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন কলকাতার টাউন স্কুলের শিক্ষক। সেই সূত্রে ১৯৩৮ সাল থেকেই উত্তর কলকাতায় বসবাস শুরু। চার ভাইবোনের মধ্যে সুনীলই বড়। সংসারে অনটন ছিলই। সেটা আরও বাড়ল দেশভাগের পর। বিশাল পরিবারে কালীপদর রোজগারই ভরসা তখন। উপার্জনের চেষ্টাতেই ব্যস্ত থাকতেন। ফলে বাবার সঙ্গে সুনীলের তেমন যোগাযোগ গড়ে ওঠার সুযোগ হয়নি। সুনীলকে বই পড়ার নেশাটি ধরিয়েছিলেন মা, মীরা দেবী।
কবিতা লেখার ক্ষেত্রে কিন্তু অনুঘটকের ভূমিকাটা বাবারই ছিল। সুনীল তখন টাউন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক দিয়েছেন। ছুটির ক’মাসে ছেলে যাতে বখে না যায়, বাবা হুকুম দিলেন সময়টা ইংরেজি চর্চার কাজে লাগাতে হবে। টেনিসনের কবিতা অনুবাদ করে দেখাতে হবে। কিছু দিন চলল। সুনীল লক্ষ করলেন, ইদানীং বাবা আর অনুবাদ আক্ষরিক কি না, মিলিয়ে দেখছেন না। সুতরাং নিজের ঈশ্বরীকে উদ্দেশ করে নিজেই লিখতে শুরু করলেন কিছু লাইন আর সেগুলোই দেখতে দিলেন বাবাকে। এই ভাবেই কবিতায় হাত মকসো করা শুরু। সুনীল পরে লিখেছেন, “আমার সৌভাগ্য এই, আমার প্রথম বয়েস থেকেই আমি কোনও সাহিত্যিক গোষ্ঠীর পাল্লায় পড়িনি। আমি পূর্ববঙ্গের গণ্ডগ্রাম থেকে আগত কিশোর, কলকাতার ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। কোনও লেখককে চোখে দেখিনি, কোনও সম্পাদককে চিনতাম না...।” ডাকযোগে লেখা পাঠানো ছাড়া অন্য উপায় তাঁর জানা ছিল না।
সিটি কলেজে অর্থনীতির ছাত্র সুনীলের বন্ধু তখন দীপক মজুমদার। কফি হাউস, দেশবন্ধু পার্কে আড্ডা জমে উঠছে। কমলকুমার মজুমদারের নেতৃত্বে হরবোলা ক্লাবে নাট্যচর্চাও চলছে। তারই মধ্যে সিগনেট প্রেস তথা দিলীপকুমার গুপ্তের সঙ্গে যোগাযোগ। ডি কে-র পরামর্শ এবং সহায়তা নিয়েই ‘কৃত্তিবাসে’র পথ চলা শুরু (শ্রাবণ, ১৩৬০)। কলকাতার রাজনৈতিক আবহ তখন উত্তাল। প্রথম সম্পাদকীয়তে
সুনীল লিখলেন, ‘‘বিভিন্ন তরুণদের বিক্ষিপ্ত কাব্য-প্রচেষ্টাকে সংহত করলে বাংলা কবিতায় প্রাণছন্দের উত্তাপ নতুন আবেগে এবং বলিষ্ঠতায় লাগতে পারে এবং সকলের মধ্যে প্রত্যেকের কণ্ঠস্বরকেই আলাদা করে চেনা যেতে পারে।”
সম্পাদকের স্বপ্ন সত্য হয়েছিল। এক মলাটে সুনীলদের সঙ্গে লিখতে লাগলেন সমর সেন, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তরা। সপ্তম ও অষ্টম সংখ্যা উপহার দিল আরও কয়েকটি নাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, তারাপদ রায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়...। দ্বাদশ সংখ্যায় সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। এই তরুণ ব্রিগেড শুধু মধ্যরাতের কলকাতাই শাসন করেননি, বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরে গিয়েছে এঁদেরই লেখনীতে। সুনীল-শক্তির এক একটা পংক্তি বাঙালির কাছে প্রবাদে পরিণত হয়েছে।
সুনীলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েক জন’ প্রকাশ পায় ১৯৫৮-য়। ১৯৬২ সালে কলকাতায় এলেন মার্কিন কবি অ্যালেন গিনসবার্গ। সুনীলের সঙ্গে গভীর সখ্য গড়ে উঠল তাঁর। পরের বছরই আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পল এঙ্গেলের আমন্ত্রণে আন্তর্জাতিক লেখক কর্মশালায় যোগ দিলেন সুনীল। নিউ ইয়র্কে সালভাদর দালির সঙ্গে পরিচয় হল তখনই। ফেরার পথে ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণে বিলেত স্টিফেন স্পেন্ডার এবং টি এস এলিয়টের সঙ্গে পরিচয়। ফরাসি বান্ধবী মার্গারিটের সঙ্গে প্যারিস ভ্রমণ। তার পর একা একাই সুইৎজারল্যান্ড, রোম, কায়রো হয়ে দমদম বিমানবন্দরে যখন নামলেন সুনীল, পকেটে দশ টাকা পড়ে আছে। এবং বেকার।
বেশ কয়েক বারই ছোটখাটো চাকরি করেছেন, ছেড়েছেন। ’৭০ সাল থেকে পাকাপাকি ভাবে আনন্দবাজার পত্রিকার বার্তা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হলেন। তার পরে দেশ-আনন্দবাজার মিলিয়ে একাধিক বিভাগের দায়িত্ব সামলেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকার হয়ে চাসনালা খনি দুর্ঘটনা, ইন্দিরা গাঁধী হত্যা, বার্লিন প্রাচীরের পতনের মতো ঘটনা কভারও করেছেন। দু’-দু’বার আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন। চুনী গোস্বামী যেমন মোহনবাগানের, সুনীল তেমনই আনন্দবাজার সংস্থার ঘরের মানুষ। প্রথম কবিতা দেশ-এ, প্রথম উপন্যাসও তাই। ‘আত্মপ্রকাশ’ বেরোয় ১৯৬৬-তে। তার পর একে একে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘অর্জুন’, ‘জীবন যে রকম’, ‘যুবক-যুবতীরা’...। সন্তু-কাকাবাবু সিরিজ শুরু হয়ে গিয়েছে একাত্তরে, ‘ভয়ংকর সুন্দর’। আশির দশকে হাত দিলেন বৃহৎ উপন্যাসে। জন্ম নিল ‘সেই সময়’। ক্রমান্বয়ে আসবে ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘প্রথম আলো’...।
কী পদ্য, কী গদ্য ঝরঝরে সুখপাঠ্য ভাষা, ঘরোয়া কথনভঙ্গি আর অব্যর্থ জনপ্রিয়তা, সুনীলের অভিজ্ঞান চিনে নেওয়া যায় সহজেই। দেশি-বিদেশি অজস্র ভাষায় অনুবাদ হয়েছে তাঁর লেখা। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, গৌতম ঘোষের মতো পরিচালকরা সুনীলের কাহিনি অবলম্বনে ছবি করেছেন। তাঁর গল্প থেকে একাধিক টেলি-ধারাবাহিক হয়েছে। সুনীলের নিজের চিত্রনাট্যে তৈরি ছবি ‘শোধ’ জাতীয় পুরস্কার পায়। ‘সিটি অফ জয়’ ছবির মুখ্য পরামর্শদাতাও ছিলেন সুনীলই। ভালবাসতেন কবিতা পড়তে, গান গাইতে। ক’দিন আগেও মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন। কলকাতার শেরিফ হয়েছিলেন এক বার। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপকও। বর্তমানে সাহিত্য অকাদেমির সভাপতির দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন। সুনীলের মতো মজলিসি মানুষ কম দেখা যেত।
অকাতরে লিখতেন। বেশি লেখা ভাল কি না, এ নিয়ে খুব একটা ভাবতেন না। নিজেকে বেশি গুরুত্ব দিতেও চাইতেন না। প্রিয় বই কী, জিজ্ঞেস করলে বলতেন, মহাভারত। সেই মহাভারত লেখাতেই হাত দিয়েছিলেন। শেষ হল না। সুনীলও কথা রাখলেন না। জীবনটা অর্ধেকই রয়ে গেল। |
|
|
|
|
|