শেষ নমস্কার
সমস্ত কলকাতা বড় দুঃখে...
ভালবাসা তাঁর জন্মকবচ। নিজেই লিখে গিয়েছিলেন কবি। শেষ যাত্রায় সেই ভালবাসাই প্রহরীর মতো ঘিরে থাকল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে।
মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলার স্কুলশিক্ষক মহম্মদ নাজমুল বৃহস্পতিবার কাকভোরে কলকাতার ট্রেনে চেপেছিলেন। আর ওপার বাংলার নাটোরের আফতাব আমিন বুধবার রাত থেকেই এ শহরে ঘাঁটি গেড়েছেন। রবীন্দ্র সদন চত্বরে ধৈর্য ধরে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পরে দু’জনেই প্রিয় লেখককে শেষ দেখা দেখতে পেয়েছেন।
রবীন্দ্র সদনেই কবিকে শ্রদ্ধা জানানোর পরে সুনীলজায়া স্বাতীকে দেখে কান্না আটকাতে পারেননি শ্রীরামপুরের স্কুলশিক্ষক ফাল্গুনী রানা। স্বাতী নিজেই শোকাকুলা তরুণীকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
প্রয়াত সাহিত্যিককে শেষ বারের মতো দেখতে জনতার ঢল। বৃহস্পতিবার, রবীন্দ্র সদনে।
তমলুকের শৌভিক ভট্টাচার্যের কাছে পুজোসংখ্যার আকর্ষণ রাতারাতি ফিকে হয়ে গিয়েছে। রবীন্দ্র সদনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তিনি বলছিলেন, “কাকাবাবু ও নীললোহিত এক সঙ্গে উধাও! ধুর, আর কী পড়ব বলুন তো!” পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়া, ভবানীপুরের ঋভু বসুও কাকাবাবুর ভক্ত। পাশেই ফুল হাতে মায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল সে।
সুনীল নেতা বা অভিনেতা ছিলেন না। গ্ল্যামার বা খেলার দুনিয়ারও কেউ নন তিনি। কিন্তু লেখক সুনীল আমবাঙালির চোখে কত বড় তারকা, সেটাই এ দিন স্পষ্টতর হল।
রবীন্দ্র সদন চত্বরে প্রিয় লেখককে এক ঝলক দেখার অপেক্ষায় দীর্ঘ লাইন সাত-সকালে সর্পিল আকার নিয়েছে। কেওড়াতলা মহাশ্মশানে শেষকৃত্য চলার সময়েও হঠাৎ শুরু হয়েছে সুনীল-স্মরণে চেনা-অচেনা কবি-লেখকদের স্বতঃস্ফুর্ত সাহিত্যসভা।
তাল কাটছিল মোবাইলে ঘন ঘন ‘শুভ বিজয়া’ বার্তার ঢল। তা উপেক্ষা করেই রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে ও সুনীলের কবিতা বলতে বলতে এগিয়েছে শোকমিছিল। আমেরিকা থেকে পুত্র শৌভিকের আসার অপেক্ষায় দু’টি দিন সুনীলের দেহ পিস হেভ্নে রাখা ছিল। এ দিন সকালে সেখান থেকে প্রথমে তাঁর দেহ আসে এবিপি-র দফতরে। আনন্দবাজার পত্রিকা, আনন্দ পাবলিশার্স ও দেশ পত্রিকার তরফে সুনীলকে ফুল দেওয়া হয়। সাহিত্য অকাদেমির দফতরে সভাপতি সুনীলকে কুর্নিশ জানাতে তাঁর লেখা বইয়ের সম্ভার সাজানো হয়েছিল।


সাহিত্য অকাদেমির বাইরে
মৃণাল সেন ও স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়

আনন্দবাজার দফতরে শ্রদ্ধা
জানাচ্ছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

রবীন্দ্রসদনে
শঙ্খ ঘোষ

তাঁর ‘কবির মৃত্যু’তে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার বধ্যভূমিতে ভিড়ের ছবি এঁকেছিলেন সুনীল। রবীন্দ্র সদনে মরদেহ ঘিরে ভিড়ের ঠেলাঠেলিতে অনেকেরই সেই বর্ণনা মনে পড়ে গিয়েছে। রাজ্যের শাসকদলের এক সাংসদ, দুই প্রথম সারির মন্ত্রী নিজেরাই ব্যারিকেড করে ভিড় সামলাতে নেমেছিলেন।
এক ধারে সংবাদমাধ্যমের আলোকচিত্রীরা। সারি সারি মাথার ভিড় এড়িয়ে শায়িত কবিকে এক বার দেখতে নাকাল অনুরাগীরা। ভিড় দেখে সুনীলের কবিতার লাইন উদ্ধৃত করেই এক তরুণের সরস টিপ্পনি, ‘মাথাটা পকেটে পুরুন দাদা।’
অর্ধশতকের বেশি বাংলা সাহিত্যের উঠোনে যাঁর রাজকীয় বিচরণ, তাঁর প্রয়াণে সংস্কৃতি জগতের দিকপালেরা স্বভাবতই অধীর হবেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উপস্থিতিও তাই হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু কবির দেহ বৈদ্যুতিক চুল্লিতে ঢুকে যাওয়ার পরেও তাঁকে নিবেদিত রজনীগন্ধার মালা কুড়িয়ে নিয়েছেন সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির এক নাতিদীর্ঘ তরুণ।
নিজে লেখেন না। কিন্তু বছরে অন্তত দু’বার বইমেলা বা কোনও কবি-সম্মেলনে সুনীলের সান্নিধ্য পেতে মুখিয়ে থাকতেন দীপঙ্কর সাহা। ঘোর লাগা স্বরে তিনি বলছিলেন, “ওঁকে দেওয়া শেষ মালা, আমার হাতে। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।”
কিছুটা দেরিতে কেওড়াতলায় পৌঁছে মালা হাতে ভিড় ঠেলে এগোনোর চেষ্টা করছিলেন এক প্রৌঢ়। বলছিলেন, “আমার নাম শ্যামল মুখোপাধ্যায়। ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ায় চাকরি করার সময়ে সুনীলবাবু ক্রুকেড লেনে আসতেন। কী চমৎকার ব্যবহার, এমন মানুষ আর হবে না।”


রবীন্দ্রসদনেই
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

পিস হেভনে
সুনীল-পুত্র শৌভিক

পিস হেভনে স্ত্রী
স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়

সকালে এবিপি-র দফতরে সুনীলের দীর্ঘ দিনের সহকর্মী-বন্ধু শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলছিলেন মানুষ সুনীল ও তাঁর ভালবাসবার ক্ষমতার কথা। শববাহী গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে পরের প্রজন্মের কবি শ্রীজাত বলেন, “সুনীলদা আমাদের দূরবীণ। তাঁর চোখ দিয়েই পৃথিবীটা দেখেছি।”
তরুণতম কবিদের মুখপত্র কৃত্তিবাসের সম্পাদনায় একদা নিজস্ব স্বাক্ষর গড়ে উঠেছিল সুনীলের। তরুণ কবি, লিটল ম্যাগাজিনের কর্মকর্তারাই তাঁর শেষ যাত্রার পুরোভাগে থাকলেন। ভবানীপুর গোরস্থান পেরিয়ে শোকমিছিল এগোনোর সময়েই এক তরুণ গড়গড়িয়ে আবৃত্তি শুরু করেন।
‘বিষণ্ণ আলোয় এই বাংলাদেশ...এ আমারই সাড়ে তিন হাত জমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াব
আমি বিষপান করে মরে যাব।’

প্রিয় কবির বারবার পড়া কবিতা যেন অজান্তেই কবির স্মৃতিতর্পণ হয়ে উঠেছে। জনতার মধ্যে রোল উঠল, ‘কেউ কথা রাখেনি’ পড়! ‘উত্তরাধিকার’ হোক। এক অনুজ কবি বলে উঠলেন, “মাথার ওপর থেকে ছাতাটা সরে গেল!”
সাহিত্য অকাদেমি থেকে শ্মশান অবধি শেষ পথটুকু হেঁটেই যান সুনীলের আত্মজ। পাশে হাঁটতে হাঁটতে শ্রীজাতরা গাইছেন, ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।’
কবির শেষ যাত্রা তখন জীবনের উৎসব হয়ে উঠেছে।

ছবি: রাজীব বসু, সুদীপ্ত ভৌমিক ও দেবাশিস রায়
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.