|
|
|
|
অমরত্বকে তাচ্ছিল্য করতেই চাইতেন তিনি |
গৌতম চক্রবর্তী |
অষ্টমীর সন্ধ্যায় শরীর খারাপ। বন্ধুরা তাঁকে হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, পুজোর পরে যাবেন। পুজো শেষ হল না, ২২ অক্টোবরের সেই রাতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
বয়স হয়েছিল ৭৮, রেখে গিয়েছেন স্ত্রী স্বাতী ও একমাত্র পুত্র শৌভিককে। বৃহস্পতিবার সকালে পিস হেভ্ন থেকে বার করা হল তাঁর বরফশীতল দেহ। আর কোনও দিন বন্ধুকে ডেকে বলবেন না তিনি, ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ।’ দুপুরে কেওড়াতলা শ্মশানে হয়ে গেল অন্ত্যেষ্টিও।
খবরের দুনিয়া এত নিষ্প্রাণ? বাঙালি জানে, নীললোহিতের মৃত্যু হয় না। তার বয়স ২১ ছাড়ায় না! নীললোহিত, বন্দনাদি, মুমু আর কোনও পুজোসংখ্যায় দেখা দেবে না। আসবে না সন্তু, কাকাবাবুরাও। কবিতায় হবে না অমোঘ উচ্চারণ, ‘যমুনা, আমার হাত ধরো। স্বর্গে যাবো।’
কবি? লেখক? কৃত্তিবাস যুগের প্রাণপুরুষ? কী লেখা যায় তাঁকে? ‘কলমটা ছুড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছা হয়। এই সব সময় মনে হয়, মানুষের ভাষা এখনও কত দীন!’ ১৯৭৪ সালের ১৯ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসুর মৃত্যুর খবর এই ভাবেই শুরু করেছিলেন সুনীল। তখনকার কবি, লেখকদের ‘বুদ্ধদেবের সন্তান’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। আজ সুনীলের উত্তরাধিকার অস্বীকার করে কোন বাঙালি শব্দশিল্পী? |
|
বুদ্ধদেব বসুর শেষযাত্রায় সুনীল। —ফাইল চিত্র |
প্রস্টেট ক্যান্সারের কামড়ে কয়েক মাস ধরেই শরীরটা ঠিক যাচ্ছিল না তাঁর। মুম্বইয়ে চিকিৎসার শেষে মহালয়ার দিন কলকাতায় ফিরেছিলেন। খাওয়া কমে গিয়েছিল, বাঁধানো দাঁতেও সমস্যা হচ্ছিল। মাছ, মাংস চিবোতে পারছিলেন না। ‘সুনীল মাছ খেতে এত ভালবাসে, অথচ দিন কয়েক ধরে খেতে পারছে না,’ কয়েক জন বন্ধুর কাছে আক্ষেপ করেছিলেন স্ত্রী স্বাতী।
সপ্তমীর সন্ধ্যায় অবশ্য সুনীল একটা জিনিস চেয়েছিলেন। পরদিন তিনি মাছের তেল খাবেন। অতএব, অষ্টমীর দুপুরে তাঁর বাড়িতে খাওয়াদাওয়া এবং আড্ডা। ‘কবিতাই আমার প্রথম প্রেম। গদ্য লেখার খাতিরে তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে হয়’ বলে কত বার যে দুঃখ করেছেন সুনীল। জীবনের শেষ দিন, অষ্টমীর দুপুরে আড্ডাটা ছিল কবিতা নিয়েই। এ বারের শারদীয় দেশ এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় দু’টি কবিতাই স্ত্রী স্বাতী ও পুত্র শৌভিককে নিয়ে। ‘পারিবারিক জীবন নিয়ে আগে কখনও কবিতা লিখিনি, এ বার ইচ্ছে হল,’ বন্ধুকে বলেছিলেন।
অষ্টমীর রাতে দুই চামচের বেশি খেতে পারেননি। মধ্যরাতে স্ত্রীকে বললেন, টয়লেটে যাবেন। সেখানে গিয়ে মেঝেতেই বসে পড়েন। বাড়িতেই ছিলেন এক বন্ধু। ডাকাডাকিতে তিনি এবং ‘কুক কাম হেল্পিং হ্যান্ড’ ধনঞ্জয়ও তত ক্ষণে চলে এসেছেন। কিন্তু সুনীলকে নড়ানো যায়নি। আর নিঃশ্বাস ফেলছেন না তিনি। ‘শরীরটা আমার আর স্বাতীদির হাতেই ঝিমিয়ে পড়ল,’ বলছিলেন সেই বন্ধু দীপ্তেন্দু চক্রবর্তী। মেঝেতে শুয়েই দিকশূন্যপুরে পাড়ি দিলেন নীললোহিত।
অষ্টমীর রাত। তত ক্ষণে তাঁর বাড়ির নীচে একডালিয়া এভারগ্রিনের মণ্ডপে সন্ধিপুজো শেষ। সুনীলের অবশ্য পুজো-টুজো নিয়ে কোনও দিন মাথাব্যথা ছিল না। ‘ধর্ম জিনিসটা পৃথিবীর মধুরতম এবং নৃশংসতম গুজব’, লিখেছিলেন তিনি। কিন্তু অষ্টমীর দুপুরে আড্ডার শেষে খিচুড়ি, বেগুনভাজা, মাছের তেলের বড়া, টক দই খেয়েছিলেন। ‘আজ খেতে ইচ্ছে করছে। ভাল করে খাব,’ বলেছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেও খিচুড়ি এবং মাছের তেল উপভোগ করা ভোজনরসিক বাঙালি।
তার আগে, সপ্তমীর রাতে তাঁকে দেখতে যান যোগেন চৌধুরী। সে দিনও সুনীলের শরীরটা জুত নেই, টিভিতে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ দেখছেন। যোগেন অনেককে চিনতে পারছেন না, কিন্তু সুনীল অক্লেশে বলে দিচ্ছেন, ‘এই তো, এটা নবদ্বীপ হালদার। এটা শ্যামল মিত্র।’ খোলা হল ব্লু লেবেল স্কচ। এক পেগ নিয়েই বসে তিনি। এ রকম আড্ডায় সুনীল রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে লোকসঙ্গীত অনেক কিছু গেয়ে শোনান, সে দিন গাওয়ার ক্ষমতা ছিল না।
কেউ কথা রাখেনি। নাদের আলি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যায়নি, অশক্ত শরীরে সুনীলও ফেলে-রাখা অনেক চিঠির উত্তর দিতে পারেননি। বিবেকানন্দ এবং নিবেদিতাকে নিয়ে একটি উপন্যাসের পরিকল্পনা ছিল, হয়ে উঠল না। ‘অর্ধেক জীবন’-এর পর ‘বাকি জীবন’ লিখবেন ভেবেছিলেন, তা-ও হয়ে উঠল না।
হয়ে ওঠেনি অনেক কিছুই। শববাহী শকট এ দিন আনন্দবাজার পত্রিকার দফতর থেকে রবীন্দ্রসদন, সাহিত্য অকাদেমি হয়ে কেওড়াতলা। নিমতলা শ্মশান এ দিন মানচিত্রে আসেনি। ওই শ্মশানেই তো ছিল অ্যালেন গিনসবার্গ, সুনীল, শক্তির মতো বোহেমিয়ানদের আড্ডা। শ্যামবাজার, নিমতলা, খালাসিটোলা... সব মিলিয়ে এই শহরকেই তো বারংবার তাঁর লেখায় তুলে ধরেছেন সুনীল। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’-র সিদ্ধার্থও বালুরঘাটে গিয়ে শান্তি পায়নি। ‘একদিন আমি ঠিক ফিরে আসব। তারপর সবাইকে মেশিনগানের সামনে দাঁড় করিয়ে র্যাট ট্র্যাট ট্র্যাট!’ প্রেমিকা কেয়াকে লিখেছিল সে। জেমস জয়েসের যেমন ডাবলিন বা দস্তয়ভস্কির সেন্ট পিটার্সবার্গ, সুনীলের কলকাতা। ‘যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াব।’ আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্কশপ ছেড়ে কলকাতায় ফিরে এলেন তিনি। সুনীলের সিদ্ধান্ত, কবিতাটা বাংলাতেই লিখবেন। ’৭০-এর সেপ্টেম্বরে আনন্দবাজার সংস্থায় যোগদান। শেষ দিন অবধি সেই সংস্থার সঙ্গেই যুক্ত।
বাংলা কবিতা লেখার জন্য আমেরিকাকে প্রত্যাখ্যান...এই আত্মবিশ্বাস চার দশক পেরিয়েও বিরল। বরাবর হাফ-হাতা বুশ শার্ট পরেছেন, বুকের বোতাম লাগাননি। লাইটার ব্যবহার করেননি, ‘দেশলাইয়ের কাঠিটা নিভিয়ে ছুড়ে দিতে আমার ভাল লাগে।’
সুনীলের কবিতা তো বৈষ্ণব কাব্যের প্রেম নয়, রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতায় বিশ্বাস নয়। ‘এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ। আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি?’ প্রেমে বাঙালি পুরুষের আত্মবিশ্বাসের ভাষাটাই শিখিয়ে গেলেন সুনীল। |
|
|
|
|
|