চমকপ্রদ ভাবে ভোল পাল্টে বৃহস্পতিবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শেষকৃত্যের দখল নিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই মমতা, যিনি ক্ষমতায় এসেই সৌজন্যের পরোয়া না করে শিশু-কিশোর অ্যাকাডেমির সভাপতি পদ থেকে সুনীলকে সরিয়ে বসিয়েছিলেন নিজের ঘনিষ্ঠ এক বিশিষ্টকে। সেই মমতা, যাঁর চালু করা সরকারি খেতাব ‘বঙ্গবিভূষণ’-এর প্রাপক হিসেবে বিবেচিত হয়নি সুনীলের নাম। সেই সুনীল, যিনি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বের পরেও ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শিল্পনীতির অবিচল সমর্থক। এ দিন সুনীলের জনপ্রিয়তার কাছে শেষ পর্যন্ত নতিস্বীকার করতেই হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে।
অষ্টমীর রাতে সুনীলের মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টা পরেও মমতার সরকার কিন্তু কিছুটা উদাসীনই ছিল। ব্যক্তিগত ভাবে শোকবার্তা জানাতেও রাজি ছিলেন না মুখ্যমন্ত্রী। উল্টে তিনি মনে করছিলেন, সংবাদমাধ্যমের একাংশ সুনীলকে নিয়ে সহানুভূতির বাতাবরণ তৈরি করতে চাইছে। রাজ্যের মন্ত্রীরাও কেউ তখন স্পষ্ট করে বলতে পারেননি, লেখকের অন্ত্যেষ্টির ব্যাপারে সরকার কী করবে! সুনীল-ঘনিষ্ঠদের একাংশের বক্তব্য, “এ ব্যাপারে সরকারের কোনও আন্তরিক প্রয়াস আমরা প্রথমে লক্ষ করিনি।”
পট পরিবর্তন হয় তার পরেই। সমবেদনা জানাতে সুনীল-জায়া স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়কে ফোন করেছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাতেই টনক নড়ে তৃণমূল নেতৃত্বের। মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অন্ত্যেষ্টির বিষয়টি দেখভাল করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী আমাকে ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে দায়িত্ব দিয়েছেন। উনি নিজে শোক প্রকাশ করেছেন।”
তৃণমূল নেতাদের একাংশের অভিমত, সিপিএম বিষয়টি ‘হাইজ্যাক’ করতে পারে, সেই আশঙ্কা থেকেই সরকার সৎকারের যাবতীয় দায়িত্ব নেয়। কিন্তু তখনও পর্যন্ত নিজেকে সে ভাবে জড়াননি মমতা। এ দিন সকালেও সুব্রতবাবু বলেন, “মহাকরণে যাওয়ার পথে রবীন্দ্রসদনে সুনীলবাবুকে শেষ শ্রদ্ধা জানাবেন মুখ্যমন্ত্রী।” কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে রবীন্দ্রসদন থেকে কেওড়াতলা পর্যন্ত মুখ্য ব্যবস্থাপকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন মমতা, সেটা এক দিকে যেমন নিজস্ব রাজনৈতিক তাগিদে। অন্য দিকে তেমনই সুনীলের জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে প্রচারের আলো নিজের দিকে টানার তাগিদে।
অতীতে ঠিক এই কারণেই কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অন্ত্যেষ্টির যাবতীয় দায়িত্ব নিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা। এ দিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সে দিনের মতো এ দিনও অন্ত্যেষ্টির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন শিল্প-সাহিত্য জগতের সঙ্গে সম্পর্কহীন অনেকেই। সংস্কৃতির ক্ষেত্রকে রাজনীতি দিয়ে কলুষিত করার এই চেষ্টা বহু মানুষের কাছেই অশোভন, দৃষ্টিকটূ মনে হয়েছে। |
মমতার সমর্থক কোনও দিনই ছিলেন না সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানার বিরুদ্ধে তৃণমূলের আন্দোলনের সময় খোলা গলাতেই তার বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। আনন্দবাজারের পাতায় লিখেছিলেন, “আমি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শিল্পনীতির একশো ভাগ সমর্থক।” সুনীলের কাছের মানুষদের মতে, তিনি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা নিছক শাসন ক্ষমতার নয়। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, নতুন নতুন শিল্প দেশকে উন্নত করবে, এই ছিল তাঁর বিশ্বাস। যে পরিবর্তনে মমতার ঘোর অনীহা।
মমতার নানা কাজের সমালোচকও ছিলেন সুনীল। যেমন, মমতা রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মেট্রো রেলের বিভিন্ন স্টেশন মনীষীদের নামে করার বা রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে রাস্তার নাম বদলের। কার্টুন-কাণ্ডে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে গ্রেফতারের বিরুদ্ধেও সরব হয়েছিলেন তিনি।
তাই ক্ষমতায় আসার পরে সুনীলের প্রতি বিরাগই দেখিয়েছে মমতার সরকার। প্রথম ধাক্কাতেই শিশু-কিশোর অ্যাকাডেমির সভাপতি পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে বসিয়েছে মমতাপন্থী নাট্যকর্মী অর্পিতা ঘোষকে। রাজ্যের বহু শিল্পী, সাহিত্যিক, অভিনেতাকে বঙ্গবিভূষণ সম্মান দিলেও ভাবা হয়নি সুনীলের নাম। শুধু তা-ই নয়, সুনীলের বিরুদ্ধে এক মহিলা কবির তোলা শালীনতা লঙ্ঘনের অভিযোগ তৃণমূল ঘনিষ্ঠ একাধিক সংবাদপত্র যে ভাবে প্রচার করেছে, তাতে উপর মহলের নির্দেশের ছবিটাই স্পষ্ট হয়।
এ সব নিয়ে অবশ্য সুনীলের কোনও তাপ-উত্তাপ ছিল না। অবজ্ঞা-অভিযোগ গায়ে মাখেননি কিছুই। সাম্প্রতিক কালে, তাঁর জন্মদিনে মমতার পাঠানো শুভেচ্ছা বার্তাও উপেক্ষা করেছেন। কোনও প্রত্যুত্তর দেননি। যা নিয়ে ঘনিষ্ঠ মহলে আক্ষেপ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
তবু এ দিন সকাল থেকে মমতার আসরে নামার আসল উদ্দেশ্য, নিজস্ব কায়দায় ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’! দেখানোর চেষ্টা যে, তাঁর সরকার আমরা-ওরা বিভাজনের ঊর্ধ্বে। রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর কথায়, “লেখক হিসেবে, কবি হিসেবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা আমরা অস্বীকার করব কী করে! সাহিত্যিক হিসেবে তাঁকে যে শ্রদ্ধা করি, তা মানুষকে আমরা বোঝাতে চেয়েছি।”
সেই বোঝানোর চেষ্টাতেই এ দিন বেলা সাড়ে ১১টা থেকে রবীন্দ্রসদন চত্বরে রবীন্দ্রনাথের মূর্তির তলায় সদলবল বসে রইলেন মুখ্যমন্ত্রী। কখনও পাশে দাঁড়ানো সৌগত রায় বা পুলিশ অফিসারদের নির্দেশ দিলেন। কখনও বা নিজেই উঠে এসে ভিড়ের চেহারা দেখলেন। হ্যান্ড মাইক নিয়ে ঘোষণা করলেন। তাতে তৈরি হল ছোটখাটো বিশৃঙ্খলাও। মমতার নির্দেশেই এ দিন সকাল থেকে রবীন্দ্রসদন চত্বরে হাজির ছিলেন মন্ত্রী সুব্রতবাবু, পার্থবাবু ও প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়-সহ তৃণমূল নেতারা। ছিলেন শিল্পী শুভাপ্রসন্ন, নাট্যশিল্পী অর্পিতা-সহ সরকার ঘনিষ্ঠ বিশিষ্ট জনেরা। তাঁরাই পুলিশের পাশাপাশি ভিড় নিয়ন্ত্রণ করছিলেন।
বেলা ১১টা নাগাদ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু ও বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এসে শ্রদ্ধা জানিয়ে যান। পরে আসেন বিমান বসু-সহ প্রথম সারির বামনেতারা। শ্রদ্ধা জানিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রাজ্যের এক প্রাক্তন সাংসদের কটাক্ষ, “প্রয়াত সুনীলকে হয়তো ভয় পেয়েছে সরকার! তাই শেষ যাত্রায় বিপুল উদ্যমে নামতে হয়েছে!”
বেলা ১২টায় রবীন্দ্রসদনের ভিতরে ঢোকেন সপার্ষদ মুখ্যমন্ত্রী। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সুনীলকে। বাইরে তখন কাতারে কাতারে মানুষ।
পুলিশকে নির্দেশ দিয়ে সকলের জন্য দেখার ব্যবস্থা করলেন মমতা। সঙ্গে ঘোষণা, “এ বার মরদেহ নিয়ে শোকযাত্রা হবে।” |
সওয়া ১২টা নাগাদ রবীন্দ্রসদন থেকে শোকযাত্রা বেরোনোর সময় পুলিশ নাকাল। এক দিকে মুখ্যমন্ত্রী-সহ সাংসদদের নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করা। অন্য দিকে হাজার হাজার লোকের ভিড় আর যানবাহন সামলানো। শোকযাত্রা প্রথম বার থামল ডি এল খান রোডে সাহিত্য অকাদেমির দফতরের সামনে। সাধারণ জনগণের সঙ্গে বাইরে রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন মমতাও। যা নিয়ে উষ্মাও প্রকাশ করলেন অনেকে। বললেন, মুখ্যমন্ত্রী তো রবীন্দ্রসদনে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। গোটা এলাকার গাড়িঘোড়া বন্ধ করে এখানে আসার কী দরকার ছিল!
কিছু ক্ষণ পরে শববাহী গাড়ি সাহিত্য অকাদেমির দফতর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল শ্মশানের উদ্দেশে। ডি এল খান রোড হয়ে গাড়ি বেলভেডিয়ার রোড ধরার পরেই দু’দিকে মানুষের ঢল। যত না সাহিত্যিককে দেখতে, তার চেয়েও বেশি পুলিশি কড়াকড়ি ও মুখ্যমন্ত্রীকে চাক্ষুষ করার জন্য! পথচলতি এক যুবক তো প্রশ্নই করে বসলেন, “কোন পার্টির মিছিল দাদা?”
বেলভেডিয়ার রোড হয়ে শোকযাত্রা গোপালনগর হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পাড়ার উল্টো দিকে কালীঘাট রোড ধরতেই মিছিলের মধ্যে চাপা গুঞ্জন শুরু হল। সুনীলের মরদেহ কেন কালীঘাটের সরু গলি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, প্রশ্ন তুললেন এক তরুণ কবি-সহ কয়েক জন অনুরাগী। যদিও সুনীলের পরিবার-পরিজনদের অনুরোধে গোলমাল দানা বাঁধল না। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা বেষ্টনী সামাল দিতে গিয়ে কবি-অনুরাগীদেরই ধাক্কা দিতে শুরু করলেন নিরাপত্তারক্ষীরা। সরিয়ে দেওয়া হল ফুটপাথে পথচলতি মানুষকেও। তা নিয়েই আপত্তি করলেন কয়েক জন সাধারণ মানুষ। প্রশ্ন তুললেন, কেন এমন গলি দিয়ে শোকযাত্রা নিয়ে যাওয়া হল?
শেষ ভিড়টা বাঁধ ভাঙল কেওড়াতলা মহাশ্মশানে গিয়ে। আগে থেকেই অবশ্য চেতলা এলাকার প্রভাবশালী এক তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রীকে সেখানে দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সুনীলের মরদেহ কাচ-ঢাকা গাড়ি থেকে বার করার পরে মুখ্যমন্ত্রী এসে বসলেন শ্মশান-চত্বরে। যত ক্ষণ না মরদেহ চুল্লিতে ঢোকানো হল, তৃণমূলের এক জন নেতাও শ্মশান ছাড়লেন না। বাবার অন্ত্যেষ্টি সম্পন্ন করে সুনীল-পুত্র শৌভিক শ্মশান ছাড়ার পরে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় বেরোল কেওড়াতলা থেকে।
তার আগে মমতা সরকারি গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন এক বাম-ঘনিষ্ঠ প্রবীণ চিত্র পরিচালককে। যা প্রত্যাখ্যান করে
তাঁর স্বগতোক্তি, ‘জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা, মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল।’ |