সুবীরদের বাড়ির সামনের লাল রোয়াকে ভোরবেলায় কাকেরা আড্ডা দিত, বেলা ন’টার পর বুড়োরা। এর পর বেকার ছোঁড়াগুলো। বিকেলে কিছু চ্যাংড়া চেটো, সন্ধের পর বুড়োরা আবার। আড্ডায় একটাই খবরের কাগজ। পাতা ভাগ হয়ে যেত আড্ডাধারীদের মধ্যে। পাকিস্তানকে কী করে ঠান্ডা করা যায়, জ্যোতি বসুর সঙ্গে টক্কর দিতে হলে অজয় মুখার্জির কী করা উচিত— সব অমোঘ নিদান শোনা যেত। খবরকাগজে তত দিনে চলিত ভাষা চলে এসেছে। যুগান্তরই প্রথম চলিত ভাষা চালু করে। এর পরে আনন্দবাজার। রকে বিলোনো কাগজটার মালিক ছিলেন সুবীরের জ্যাঠামশাই। ফলে বিশেষ এবং বেশি মন্তব্য করার অধিকার তাঁরই। তিনি ছিলেন ও-পাড়ার বাঙাল। বাগবাজারে বাঙালরা সংখ্যালঘুই। উনি একটি স্কুলের বাংলার মাস্টারমশাই। বলতেন, খবরের কাগজ আর পড়ন যায় না। ছি ছি। কী হইছে। এক্কারে রকের ভাষা? আমাগো বিদ্যাসাগর বঙ্কিমচন্দ্রের বাংলার কী দশাডা হইল কন দেহি...।
এর পরে লাইনো এসে গেল। লাইনো কম্পোজ করতে যুক্তাক্ষরগুলি বোধহয় ঠিকমত ম্যানেজ করা যেত না। খবরকাগজে লেখা হত লনডন, পলটন, সারক (সার্ক), জারক (জার্ক)— এ সব নিয়েও খুব হাসাহাসি। গালাগাল দিতেন বাঙাল জ্যাঠা। রেগে গেলে বাঙাল বাক্যে সাধু-অশ্লীলের মিশেল ঘটত, এবং এই সব পত্রিকাওলাদের তাৎক্ষণিক শাস্তিঘোষণাও হয়ে যেত। ওঁর পরিকল্পিত শাস্তিদান পদ্ধতিও ছিল অভিনব। কয়েকটা প্রকল্প মনে পড়ছে। ল্যাংটা কইরা বৃক্ষশাখায় ঝুল্যমান কইরা চিকন বেত্র দিয়া আপাদমস্তক পিটাইয়া নামাইয়া, প্যাটের উপর উপর্যপরি লম্ফ দিয়া চোখ দিয়া প্যাটের নাড়িভুড়ি বাইর কইরা দেওন লাগে। কিংবা— বাংলা ভাষা বিনাশী এই সব বরাহগুলির মলদ্বারে আইচ্ছা কইরা বিছুটি পাতা ঘইস্যা হাত বাইন্ধা দেয়ন লাগে য্যান না চুলকাইতে পারে। ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি এই সব খবর খুব একটা উত্তেজিত করত না। ভাঙা যুক্তাক্ষর দেখলেই যেন ‘দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে’-র জীবন্ত আইকন। দেখতাছেন, ভাষার ওপর কী ধর্ষণ চলতাছে! সবাই
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
অপেক্ষা করত বাঙাল জ্যাঠার মন্তব্যের জন্য। এক বার ওই পাড়ার কাউন্সিলর কী যেন একটা নারীঘটিত গণ্ডগোল করেছিল। জ্যাঠা শাস্তি ঘোষণা করলেন— ‘অরে রোজ দুই গ্যালাস কইরা মদন কবিরাজের জোলাপ দিনে দুই বার কইরা এক মাস ধইরা খাওয়াইয়া খাওয়াইয়া হাগাইয়া হাগাইয়া এমন দুর্বল কইরা দেওন লাগে যেন...’
বিকেল পাঁচটা নাগাদ ওই রোয়াকে আসত এক শোনপাপড়িওলা। এসেই সুর করে হাঁকত— আমি এসে গেছি গো...এসো এসো নন্দের দুলাল। কদমতলায় আর বাঁশরি বাজিও না। যমুনার জলে আর থেকো না। ঠান্ডা লেগে যাবে। এই মথুরাপুরীতে এসে শোনপাপড়ি খেয়ে যাও। এসো বলরাম, গোপাল, নিত্যানন্দ, গৌরাঙ্গ, রূপসনাতন, এসো ললিতা, বিশাখা, শকুন্তলা, হৈমবতী, খনা, লীলাবতীগণ...
ওর নাম জানতাম না। ডাকতাম নন্দের দুলাল। সুবীরের জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে ওর খুব ভাব ছিল। সম্ভবত ওর খরিদ্দার-আহ্বানে ভারতীয় ঐতিহ্য মেশানো ছিল বলে। জ্যাঠামশাই মাঝে মাঝে ওকে ঘরে ডেকে নিয়ে চা খাওয়াতেন, গল্প করতেন।
হঠাৎ নন্দের দুলালের রকে আসা বন্ধ হয়ে গেল। এক মাসের ওপর হয়ে গেল ও আসে না। ওর ঠিকানা জানা ছিল না, নামটাও নয়। জ্যাঠামশাই ওকে নন্দ নামেই ডাকতেন।
ইতিমধ্যে আমাদের হায়ার সেকেন্ডারি হয়ে গেছে, কলেজে। কাব্যরোগেও ধরেছে। আমার বন্ধু শিবব্রতদের একটা প্রেস ছিল। ঠিক করলাম পত্রিকা করব। সাহিত্য পত্রিকা। প্রেসের খরচ লাগবে না। লেখক ও কবি তো চার পাশে গিজগিজ। কাগজ?
সুবীরের জ্যাঠামশাই ব্যাচেলর। সরস্বতী পুজোয় দশ টাকা চাঁদা দেন, সবাই যখন এক টাকা। তাঁর কাছে কাগজের টাকাটা চেয়েই ফেললাম মুখ ফুটে।
জ্যাঠামশাই বললেন, একটা কথা কই নাই। নন্দ আমার কাছে টাকা জমা রাখত। ও যখন আর আইলই না, সিদ্ধান্ত হইতে পারে সে দ্যাহ রক্ষা করছে। শ’দ্যাড়েক টাকা আছে। এক বার ভাবলাম দরিদ্রনারায়ণ সেবা দিই। কিন্তু নিজে তো পারমু না। ক্লাবরে দিয়া করান লাগব। ওরা অর্ধাংশ গ্যাঁড়া কইরা দিব। সাহিত্য পত্রিকা করবা, ভাল কাম, কিন্তু সব ল্যাখা সাধুভাষায় হওয়া চাই, আর কবিতার লাইনে লাইনে য্যান মিল থাকে। পত্রিকার নাম কী করবা?
বলি, ধূসর পাণ্ডুলিপি কিংবা কাটাকুটি খেলা।
— টাকা পাইবা না। সাহিত্য পত্রিকার নাম লইয়া ইয়ার্কি?
— তা হলে কী নাম হবে আপনিই বলুন...
— আর্যপত্র, জ্যোতির্ময়, সদ্গময়...
— আচ্ছা আচ্ছা, তা-ই হবে।
ঠিক করলাম শুরু তো করি, পরে দেখা যাবে। সাধু বাংলাতেও ‘আধুনিক’ লেখা লিখব আমরা।
আমি কবিতা লিখলাম—
নাসিকাতলে গোঁপের চিহ্ন
ইঙ্গিত দেয় অপরাহ্ণ
আসিতেছে হায় হিরো সাইকেলে...

সাধু বাংলাতেই লিখতে হল। না হলে বরাদ্দ শাস্তি কী হবে ঠিক নেই।

• ছেলেকে পইপই করে ‘সদা সত্য কথা বলিবে, অমনি যাহা চাহিবে, পাইবে’ শেখানোর পর পার্ক স্ট্রিটে
বেড়ানোর সময় এক ভিখিরি এসে বলবে, ‘একশো টাকা দেবেন? একটু সোনাগাছি যাব!’
• ঠিক ভারত-পাকিস্তান টি-টোয়েন্টি ম্যাচটার আগে
রিমোট হারিয়ে যাবে। কমোডের পাশে, লক্ষ্মীর ঝাঁপির
ভেতর— কোত্থাও নেই! গতর নাড়িয়ে টিভি
অবধি গিয়ে তো আর অন করা যায় না!
• যে ‘নিজে করো’গুলো একলা থাকার সময়
বিনা রিহার্সালে অনায়াসে পারবেন, সুন্দরী মেয়ের
সামনে সেইগুলো করতে গিয়েই ৪৪০ ভোল্ট
এবং সকল স্মার্টনেস পপাত চ।
এ রাজ্যের বিশিষ্ট নাট্যকার-অভিনেতা-নির্দেশক তথা রাজ্যের উচ্চশিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু একটি সাম্প্রতিক সভায় প্রদর্শন করলেন তাঁর কণ্ঠপেশির আস্ফালন: কোনও নাট্যকর্মী যদি আমাকে তাঁর সিপিএমত্ব দেখান, তা হলে আমি তাঁকে আমার তৃণমূলত্বই দেখাব। ইহুদি বাইবেলের স্পর্ধিত বাক্যবন্ধ ‘অ্যান আই ফর অ্যান আই’-এর প্রতিধ্বনি শুনতে পেলেন কি কেউ? তুমি যদি একটা চোখ উপড়ে নাও, আমিও গেলে দেব আর একটা? অথবা, অন্য একটি দৃশ্যে: কেউ যদি দুষ্কর্ম করে, তা হলে দে উইল বি পেড ব্যাক ইন দেয়ার ওন কয়েন? হা হা, চলা বদলায়, বলা বদলায়, গলা বদলায় না। গাঁধীজি কবেই সাবধানবাণী শুনিয়ে গেছেন: ‘চোখের বদলে চোখ’ এই মতবাদ আখেরে গোটা বিশ্বকেই অন্ধ করে। অবশ্য মহাত্মার কোটেশনের অভাব নেই। সে সব উদ্ধৃতি সম্বল করে টেলিভিশনে শৌখিন বিতর্ক হয়, রাজনীতি হয় না। ‘আমরা-ওরা’র বিভাজন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে চিল্লিয়ে ভোট চাওয়া যায়, কিন্তু ভোটে জিতে গেলে সেই বিভাজনের সমীকরণই জয়ী বাইসেপে চলকায়, ‘সিপিএমত্ব’, ‘তৃণমূলত্ব’ ও অন্যান্য বাজখাঁই ‘ত্ব’ বাতাসে ওড়ে, এই কথার ভঙ্গিতে যে ‘মস্তানত্ব’ ও ‘অসভ্যত্ব’ নেচেকুঁদে সৌজন্য আর শিক্ষার ময়দান দখল করে নিচ্ছে, সে বোধ বেমালুম পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়।

সাহিত্যে এ বছর নোবেলজয়ী চিনে সাহিত্যিক মো ইয়ান চিনের কমিউনিস্ট পার্টির ‘ঘরের লোক’, সরকারি লেখক সঙ্ঘের ভাইস প্রেসিডেন্ট, এই সে দিনও দক্ষিণপন্থীদের চক্ষুশূল হয়েছেন মাও জে দং-এর চরম স্বৈরতান্ত্রিক বক্তৃতাংশ জনসমক্ষে উদ্ধৃত করার জন্য। এক দল লোক চেঁচাচ্ছেন, এ তো চিন-তোষণ, পাশ্চাত্যে অ্যাদ্দিন চিনের রাষ্ট্রবিরোধী শিল্পীদের তোল্লাই দেওয়ার পর ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। চিন বলছে, এই আমাদের দেশের ‘প্রথম’ নোবেল-প্রাপ্তি, এ দেশে প্রায় গোটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া সাহিত্যিক পার্ল বাক ‘বিদেশিনি’, দু’বছর আগের নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী লিউ জিয়াওবো ‘সরকারবিরোধী দেশদ্রোহী’। মো নিজে সাফাই গাওয়ার ভঙ্গিতে বলছেন, কেন, আমি তো অনেক কিছু লিখেছি, যা সরকার নিষিদ্ধ করেছে! অর্থাৎ, সাহিত্যমূল্য ছেড়ে আলোচনা ঝাঁপ খাচ্ছে স্রেফ দ্রোহ-কালচারে। শিল্পী কি একমাত্র রাষ্ট্রবিরোধী হলেই ভাল শিল্পী? কর্তৃপক্ষের প্রতি তাঁর আনুগত্য বা তার অভাব দিয়েই কি মাপা হবে এক জন লেখকের মহত্ত্ব? মো-র সাহিত্যের মূল ভোমরা ‘হ্যালুসিনেটরি রিয়ালিজ্ম’ কী, সে প্রশ্ন কি তবে ভাবনার সিলেবাসেই থাকবে না?
৬১৮
৫০০০০



৫০

৭৩
১৫

৫.৫


সী


রা
য়
ডুকরে কাঁদেন শ্রীমান বিমান, ফুকরে ওঠেন পলিটব্যুরো
স্লোগান সমেত হচ্ছে চুরি বামপন্থার পুচ্ছ-মুড়ো!
পেটেন্ট নেওয়া হুড়ুমবাজির জেরক্স করে হচ্ছে নকল।
শোষণ তোষণ ক্যাডারপোষণ সমস্তটাই জবরদখল!

শিল্পী আমিই শিল্প বুঝি, মিটিংমে সব বোল দিয়া
বন্ধ তো নয়, সাক্ষী সবাই, দিব্যি চলছে হলদিয়া।
একটা টিভি তিনটে কাগজ
অপপ্রচার করছে যা রোজ ফালতু সবই।
লাঞ্চ সেরে নাও ইলিশ মাছের ঝোল দিয়া!



লেটারিং বেটারিং



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.