|
|
|
|
|
|
|
এ বার আপনি জিতলেন |
এলসিন অ্যান গ্রাফাম
আমেরিকা |
আলোগুলো এতই টিমটিমে যে কিছুই প্রায় দেখা যায় না। সারা ঘরে, আমার বউ যে বিশ্রী ধরনের পারফিউমটা মাখে, সে রকম একটা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। কোনও ক্রমে হাতড়ে হাতড়ে মাঝখানের একটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। চোখটা একটু ধাতস্থ হওয়ার পর ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশের কাউকেই চিনতে পারলাম না। কী আর করি, আমার স্ত্রী জর্জিয়া-র বড়দিনের উপহার দেওয়া জঘন্য চওড়া টাইটা ঠিকঠাক করতে লাগলাম। রেগে ভাবলাম, একটা গাড়ল আমি, আসাটাই উচিত হয়নি। ব্যাপারটার শুরু হয়েছিল গত সপ্তাহে পাওয়া একটি চিঠি দিয়ে।
চিঠিটা আমার বউ খুলেছিল। আমাকে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘পাশের ব্লকের ওই চমৎকার ভদ্রলোক দিলেন। কীসের একটা মিটিং আছে। তোমাকে যেতে হবে।’
‘মিটিং-এ যেতে হবে? কোথায়?’ চিঠিটা নিয়ে দেখি, লেখা: ‘আগামী ৮ জানুয়ারি রাত ৮টার সময় আর্ল রেস্তোরাঁর রাম’স রুমে ব্রায়ারউড মেন’স ক্লাবের বার্ষিক অধিবেশনে আপনার আমন্ত্রণ।’ নীচে সই করা ‘সৌভ্রাতৃত্ব সহ গ্লেন রেনল্ডস’। |
|
‘গ্লেন রেনল্ডসটা কে? আর ক্লাবটাই বা কীসের?’
‘গেলেই তো বুঝবে। আর এতে তোমার সঙ্গে বরং আশেপাশের লোকজনের একটু চেনাশোনাও হবে। পাক্কা দু’মাস হয়ে গেল এখানে এসেছি, একটা লোকও আলাপ করতে এল না!’ জর্জিয়া বলে উঠল।
‘সেটা আশ্চর্য নয়’, আমি মনে মনে বললাম, ‘হাটে-বাজারে তোমাকে দু-এক বার দেখেই সবাই বুঝে নিয়েছে তুমি কী ঘ্যানঘ্যানে চিজ!’ মুখে বললাম, ‘এখানকার লোকেরা হয়তো ততটা মিশুকে নয়।’
জর্জিয়া ভেংচে বলল, ‘হয়তো ওরা তোমার আগের চেনাশোনাদের মতো অত গায়ে-পড়া নয়।’
‘ওঃ জর্জিয়া, ছাড়ো তো! তোমার জন্যে তো চলে আসতে হয়েছে, জন্ম হওয়া ইস্তক যেখানে বড় হয়েছি, সে জায়গা ছেড়ে। আসিনি?’
‘সেটা আমার দোষ? চল্লিশ বছরের বুড়ো ভাম! তোমার ভাগ্যি ভাল যে আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাইনি।’
‘ঠিক আছে, জর্জিয়া’
‘আমার বাবার টাকাগুলো না থাকলে কী করতে শুনি, মাথামোটা কোথাকার? আমি না থাকলে কোথায় যেতে?’
‘আচ্ছা, হয়েছে হয়েছে।’
‘কথাটা যেন মনে থাকে!’ হেসে আর কলপ করা কমলা চুল নাড়িয়ে জর্জিয়া বলল, ‘তুমি ওই মিটিংয়ে যাচ্ছ। শোনো, তোমার বাদামি রঙের স্যুটটা পরবে, আর আমি তোমাকে যে নতুন টাইটা দিয়েছি ’ জর্জিয়া বলে চলল, ঠিক যে ভাবে গত চোদ্দ বছর ধরে আমার জীবনের প্রতিটি মিনিটে কী করব না-করব সে ঠিক করে দিয়েছে।
তাই ৮ তারিখ সন্ধেয় হাজির ছিলাম ওই ক্লাবের অধিবেশনে। বিরক্ত লাগছিল। এটা কী ধরনের ক্লাব, যে বছরে একবারই মিটিং হয়? প্রায় আটটার সময় লোক ঢুকতে শুরু করল। একসঙ্গে এত গোমড়ামুখো লোক কখনও দেখিনি। সবাই যেন চরম হতাশাগ্রস্ত। এরা কি শবযাত্রার পরিচালক? না কি সবাই আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফের চেষ্টার জন্য তৈরি হচ্ছে?
ডায়াস-এ দাঁড়িয়ে রেনল্ডস বলল, ‘তা হলে শুরু করছি। বরাবরের মতো, বর্ণানুক্রমিক ভাবে ডাকা হবে। সবার জন্যই এক মিনিট সময়।’
চিরদুঃখী চেহারার বছর পঞ্চাশেকের এক জন মঞ্চে উঠে দাঁড়াল। ‘আমার নাম হ্যারি অ্যাডামস। সে, সে...’ ঘাবড়ানো মুখে কপালের ঘাম মুছে শুরু করল লোকটা। ‘আপনারা সবাই তাকে দেখেছেন। খুব সুন্দরী। আপনারা ভাবেন, আমার কপাল খুব ভাল। কিন্তু তা নয়, তা নয়। সে সারা ক্ষণ আমার পেছনে লেগে আছে, এটা কিনে দাও, সেটা কিনে দাও। আমি এত টাকা কোত্থেকে পাব? আবার শাসিয়েছে: না দিলে, আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, যাওয়ার আগে সর্বস্ব নিয়ে যাবে। ব্যাঙ্ক থেকে বাড়ির ছাদ সারাইয়ের নাম করে লোন নিয়েছি। কিন্তু তার আশ মেটেনি। মিঙ্ক-কোট চাই, হিরের আংটি চাই। আবার আরেকটা ব্যাঙ্কে গিয়ে ছাদ সারাইয়ের নাম করে টাকা ধার করতে হবে। সব টাকা গেছে, ছাদই বা অত পাই কোত্থেকে?’
‘সময় শেষ, হ্যারি।’ হ্যারির জায়গায় উঠল আর একটা লোক। ‘সে তার মা-কে আমাদের বাড়িতে ঢুকিয়ে নিয়েছে। একা বউয়ে রক্ষে নেই, এখন দোসর বুড়িটাও। বাড়িতে পাগল-পাগল লাগে। অফিস থেকে ফিরতে পাঁচ মিনিট দেরি হলে, দু’জনে মিলে খ্যাঁচাবে। বউয়ের জন্মদিন ভুলে গেলে শাশুড়ি মনে করিয়ে দেয়, শাশুড়ির জন্মদিন ভুলে গেলে, বউ।’ লোকটা রেনল্ডসের দিকে তাকাল। ‘আর কত ক্ষণ আছে?’
‘দশ সেকেন্ড, জো।’
‘আমি আর বাড়িতে থাকতে পারছি না! আমি কচি খোকা নই যে সারাক্ষণ ধরে ট্যাকোর ট্যাকোর’ এ বার আর এক জন। আমি মুগ্ধ হয়ে বসে আছি। কী দারুণ আইডিয়া! বছরে এক বার সবাই মিলে এক জায়গায় জড়ো হয়ে আশ মিটিয়ে বউদের গালাগাল করো। ভেতর থেকে জমা বিষ উগরে দাও। এ রকম একটা জায়গায় কিনা আমি আসব না ঠিক করেছিলাম!
এ বার আমার পালা। সত্যি সত্যি পৃথিবীকে জানাতে পারব যে সে আমাকে কী অত্যাচারটা করেছে ওঃ, স্বর্গ! ‘আমি ফ্রেডি নার্ফ। আমার সেক্রেটারির নাম ছিল জেনি আর ওর বয়স তেইশ আর আমি ওকে পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালবাসি আর ভালবেসেও যাব আর আমার পান্তাভাতের মতো ঠান্ডা বউ জানতে পেরে গিয়েছিল সব আর সবাইকে বলে বেড়িয়েছিল আমি জেনির সঙ্গে ফস্টিনষ্টি করছি আর আমাকে বলল ‘ঢলানি মেয়েছেলেটার’ কাছ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে আমাদের চলে যেতে হবে কিন্তু জেনি ঢলানি নয় আর আমি জীবনে ওকে দেখতে পাব না আর আমি ওকে ভালবাসি এখনও আর আমার বউ সব সময় ওই কথাটা তুলে খোঁচা দেয় আর আমি জেনিকে ভুলতে চাই কিন্তু পারবও না যখন বউ বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে’ ‘সময় শেষ, ফ্রেড।’
‘আমার বউকে আমি আর সহ্য করতে পারছি না!’ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে মঞ্চ থেকে নেমে এলাম। চল্লিশ বছর বয়স হতে চলল, এত হালকা আর কোনও দিনও লাগেনি। ব্যাপারটাকে ভেতর থেকে বের করে দিতে পেরে, আনন্দে আটখানা হয়ে, অন্যদের কথা শুনতে লাগলাম। চোখ পড়ল একটা লোকের দিকে, যে কিছু বলেনি, কিন্তু মুখে একটা বিরাট হাসি ঝুলিয়ে রেখে বসে আছে। চেনা-চেনা লাগছিল।
রেনল্ডসের কথায় চমক ভাঙল। ‘এখন ভোট নেওয়া হবে। জর্জ, সবার হাতে কাগজ-পেন্সিল দিয়ে দাও।’
‘ভোট?’ অবাক হয়ে পাশের টেকো লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলাম। ‘নিশ্চয়ই। কার বউ সব চেয়ে খারাপ, ভোট নিতে হবে না?’
হাতে কাগজ আসা মাত্র আমি আমার নামটা লিখে ফেললাম। আমার বউয়ের মতো জঘন্য মহিলা জগৎসংসার ঢুঁড়েও দু’টি পাওয়া যাবে না।
কয়েক মিনিট বাদেই কাগজগুলো নিয়ে, রেনল্ডস ঘোষণা করল, ‘এই প্রথম বার এক নতুন সদস্য বিজয়ী হল। ফ্রেডি নার্ফ। যার স্ত্রী তার চমৎকার বান্ধবীকে ‘ঢলানি মেয়েছেলে’ বলেছে।’
রেনল্ডস আমাকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানাতে ক্যাবলার মতো সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বিমর্ষ, হেরো সব লোক আমাকে ঘিরে দাঁড়াল এবং পটাপট হাত মেলাতে লাগল। পিঠ চাপড়ানোর সময় তো দেখি কয়েক জনের চোখে জল! |
|
বাড়ি ফেরার আগে একটু মদ্যপানের ব্যবস্থা ছিল। লাউঞ্জে গিয়ে একটা গ্লাস তুলে নিয়ে রেনল্ডসের দিকে এগিয়ে গেলাম। ‘দারুণ ব্যাপার! এই ক্লাবের আইডিয়াটা কার?’
‘আমার’, রেনল্ডস বলল, ‘গত পাঁচ বছর ধরে ক্লাবটা চালাচ্ছি। আমিই ঠিক করি কারা সদস্য হবে, আমিই তোমার নামটা এ বছরের লিস্টে ঢুকিয়েছি। সত্যি, তোমার বউ একখানা যন্তর, তাই না?’
‘বিলক্ষণ! যাকগে, তুমি কিছু বললে না কেন? নিজের ক্লাব বলে?’
‘আরে না, আমার বউ তো চার বছর আগেই মরে গেছে।’
‘ওঃ, দুঃখিত।’ থতমত খেলাম। কথা ঘোরানোর জন্য বললাম, ‘আচ্ছা, আমার কয়েকটা চেয়ার পরে একটা লোক সারা ক্ষণ হাসছিল আপন মনে, লোকটা কে?’
‘কে, গ্যারি ম্যাকলেলান? ও তো এখানকার কলের মিস্ত্রি।’
‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ, দেখেছি তো। আচ্ছা, শুনছিলাম ওর বউ গত বছর কী একটা বিচ্ছিরি দুর্ঘটনায় মারা গেছে?’
রেনল্ডস একগাল হাসল। ‘ঠিকই শুনেছ। গত বারের ভোটে তো ম্যাকলেলান জিতেছিল!’
|
(সংক্ষেপিত)
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী
অনুবাদ অমিত দেবনাথ |
|
|
|
|
|