|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
বাঁচাও, পুজো এসেছে |
বাঁচাতে পারেন পুরস্কারদাতারাই। যে পুজো বাসিন্দাদের জীবন অতিষ্ঠ
করে তোলে, তাকে কোনও পুরস্কার নয়। পরামর্শ দিলেন
অমিতাভ গুপ্ত |
শরৎকাল আমার ঘরপোড়া গরুদের সঙ্গে একাত্মবোধ করার মরসুম। ঠিক করে বললে, শরতের আগে থেকেই। আকাশের ঘোলাটে ভাব কাটার আগেই, খবরের কাগজের ছয়ের পাতায় কাশফুলের ছবি ছাপা আরম্ভ হওয়ার আগে থেকেই বুকের ভিতর ঢাক বাজতে আরম্ভ করে এই রে, পুজো এসে গেল! ক্যালেন্ডারের জুলাই মাসের পাতার দিকে তাকিয়ে যতই সনির্বন্ধ বলি, ফুরায়ো না কে কার কথা শোনে, জুলাই ফুরিয়ে অগস্ট, সেপ্টেম্বর আসবেই। ব্যস, দুর্ভোগের ঋতুতে বাঙালি স্বাগত।
কলকাতার উত্তর শহরতলির যে পাড়ায় আমি থাকি, সেটা এমনিতে চমৎকার চওড়া রাস্তা, গাছপালা, পুকুর, মাঠ, সবই আছে। কিন্তু গত দশ-পনেরো বছরে পাড়াটার একটা মেগা-সর্বনাশ হয়েছে। তিনটে বড়, তিনটে মেজো আর দুটো খুদে এক কিলোমিটার লম্বা পাড়ায় মোট আটখানা বারোয়ারি পুজো। পাড়ায় পুজো হলে কী কী হয়, হতে পারে, আমি যেমন জানি, নির্ঘাত আপনিও জানেন। কলকাতায় তো আর আমি একা থাকি না। কোন একটা পুজো যেন শুনেছিলাম পাড়ার সব বাড়িকে ঘাড় ধরে এক রঙ করিয়ে দেয় প্যান্ডেলের থিমের সঙ্গে যাবে বলে। আমাদের পাড়ায় এতটা হয় না, তবে ফি বছর মাস তিনেকের জন্য ভুলভুলাইয়া তৈরি হয়। নিজের বাড়ি থেকে বড় রাস্তায় পৌঁছতে গেলে কোন রাস্তা দিয়ে যেতে হবে, সেটা জানতে গেলে প্রথমে জানতে হবে কোন রাস্তা দিয়ে যাওয়া যাবে না। তার পর হিসেব করতে হবে, কোন রাস্তা দিয়ে গেলেও যাওয়া যেতে পারে। গেছোদাদা থেকে লয়েড শ্যাপলি, কী চাই আপনার!
আর পুজো-স্পেশাল হল, বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ। আমার বাড়ির সামনেই যেহেতু মেগা পুজো, অতএব তার জন্য বাঁশের ব্যারিকেড বাঁধা হয়েছে। তাতে বাড়ির সদর দরজা বেমালুম আটকে গিয়েছে। ফলে, চতুর্থী থেকেই বাড়িতে ঢোকার জন্য ‘আগত দর্শনার্থীবৃন্দদের’ সঙ্গে লাইন দিতে হয়। প্রতি বছরই। গত বছর তেমনই লাইনে দাঁড়িয়েছি। বাবার হাত ধরা একটা বাচ্চা ছেলে ঠিক আমার পিছনেই দাঁড়িয়ে। মিনিট দশেক এক সঙ্গে লাইন দেওয়ার পর আমি যখন বাঁয়ে বাঁক নিয়ে নিজের বাড়িতে ঢুকছি, সে আকূল বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ও কাকু, ও দিকে কোথায় যাচ্ছ?’ এ বছরও কোনও বাচ্চাকে এই বিস্ময়ের আনন্দটুকু দিতে পারব, ভরসা রাখি। আসলে পুরোটাই আনন্দের নিত্যতা সূত্র, বুঝে নিয়েছি পুজো কমিটি, দর্শনার্থীবৃন্দ এবং সম্ভবত সপরিবার মা দুর্গা-র আনন্দ এনশিয়র করতে এটুকু আমায় মেনে নিতেই হবে। |
|
মেনে অবশ্য আরও অনেক কিছুই নিয়েছি। রাত চারটেয় গাঁকগাঁক লাউডস্পিকারে দর্শনার্থীদের এবং ‘অ্যালাকার সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদের’ শারদীয় অভিনন্দন জানানো মেনে নিয়েছি, বাড়ির সামনে আবর্জনার স্তূপ মেনে নিয়েছি, বিকেল পাঁচটা থেকে বাড়ি ছেড়ে বেরোতে না পারার অনিবার্যতা মেনে নিয়েছি। রাস্তার কোনার যে বাড়িটার সামনে টিনে ঘেরা শৌচাগার তৈরি হয়েছে, তাঁরাও নিশ্চয়ই সেই তীব্র দুর্গন্ধ মেনে নিয়েছেন।
মেনে না নিয়ে আসলে উপায় নেই। আমার পরিচিত এক ভদ্রমহিলা, পেশায় রাজ্য সরকারের অফিসার, বেশ কয়েক বছর আগে পুজোর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁর পরিবার বলতে বৃদ্ধা মা আর দুটো বাচ্চা। তা, প্রতিবাদের পর পাড়ার ক্লাব থেকে তাঁকে ‘বুঝিয়ে’ বলা হল। থানা থেকেও সম্ভবত এক বার বুঝিয়ে গেল। একটা লাউডস্পিকার শুধু তাঁর জন্যই নির্দিষ্ট হল। সেই পুজো চোখ-কান বুজে কাটিয়ে ভদ্রমহিলা পরের বছর থেকে পুজো এলেই কেটে পড়েন। আসলে, পুজো করতে গেলে কোন কোন মন্দিরে নৈবেদ্য চড়িয়ে রাখতেই হয়, কমিটিওয়ালারা বিলক্ষণ জানেন। সেই দেবতারা যতই কাঁচাখেকো হোন, আর অরবিন্দ কেজরিওয়াল যতই চেঁচান, নৈবেদ্য পাওয়ার পরে ভক্তের সুবিধাবিধান করতে এই দেবতারা এখনও ভোলেননি। নয়তো যে পুজোর ছাড়পত্রই জোটার কথা নয়, বছরের পর বছর সেগুলো রমরম করে চলে কী করে? কাজেই, প্রতিবাদ-টতিবাদ না করাই ভাল পুজোর মধ্যে অশান্তি করতে কি আর পুজোওয়ালাদেরও ভাল লাগে?
এখন যতগুলো পুজো, পুরস্কারের সংখ্যা তার চেয়েও বেশি। যে পুজোর সামনেই দাঁড়াই, শুনতে পাই, লাউডস্পিকারে অভিনন্দনবার্তা উচ্চারিত হচ্ছে কোনও একটি সংস্থা তাদের পুজোকেই সেরা ঘোষণা করেছে। এক দিকে ভাল, বেশ গণতান্ত্রিক মডেল কারও মনখারাপ হওয়ার স্কোপ নেই। খোঁজ নিয়ে জানলাম, শুধু মন ভাল রাখার উপায় নয়, এই পুরস্কারগুলো বারোয়ারি পুজোর অর্থনীতিই বদলে দিয়েছে। চাঁদা তুলে পুজো আর হয় না, অন্তত ওই টাকায় বড় পুজো হয় না একটা বড় পুজোর খরচ নাকি এখন পঞ্চাশ লক্ষ টাকারও বেশি হতে পারে। পুজো হয় বিজ্ঞাপনের জোরে। আর বিজ্ঞাপন আসে পুরস্কার পাওয়া পুজোয়। স্বাভাবিক, যে পুজো দেখতে মানুষের ঢল নামবে, বিজ্ঞাপন সেখানেই যাবে আই পি এল ছেড়ে কেউ হাডুডু চ্যাম্পিয়নশিপে বিজ্ঞাপন দেয়?
আমি, এক পুজোবিধ্বস্ত এবং কাঁচাখেকো দেবতাভীরু নির্ভেজাল বঙ্গসন্তান, পুরস্কারওয়ালাদের উদ্দেশে একটি, মাত্র একটি, কথা বলব বলেই এতখানি লিখলাম। আপনাদের দৌলতে কলকাতার পুজো অনেকখানি বদলেছে। কান জ্বালানো হিন্দি গানের বদলে সমপরিমাণ কান জ্বালানো সানাই বাজে এখন মণ্ডপে মণ্ডপে। কমিটিওয়ালারা রাত আড়াইটের আগে বোতল খোলেন না। মণ্ডপ সাজানোর জন্য ‘পুজোর রূপকার’-রা, শুনতে পাই, নাকি রাত জেগে লেখাপড়াও করেন। সবই ওই পুরস্কারের জন্য।
একটু দেখুন না দাদারা, আমার প্রবলেমটারও যদি কিছু করতে পারেন। যখন প্যান্ডেল দেখবেন, প্রতিমা দেখবেন, আলোকসজ্জা দেখবেন, তখন আর একটু দেখে নেবেন পুজোটা রাস্তা আটকে হল কি না; রাতবিরেতে লাউডস্পিকারে আপনাদেরই স্বাগত জানানো হচ্ছে কি না; কতগুলো বাড়ির জীবন অতিষ্ঠ করে পুজো চলছে, কত দিন ধরে তাঁরা এই নরকে বাস করছেন বাধ্য হয়ে। পারলে, স্থানীয় দু’এক জন মানুষের সঙ্গে কথাও বলুন না জানতে চান, তাঁদের কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো? অবশ্য, একটু আড়ালে জানতে চাইবেন। আপনাদের পিছনে হাসিমুখে পুজোকমিটি দাঁড়িয়ে থাকলে কে আর সাহস করে সত্যি কথাটা বলবে?
শুধু এই বছরটা আমার অনুরোধটুকু রাখবেন, প্লিজ? যতই চমৎকার পুজো হোক, মানুষের অসুবিধে করেছে দেখলে মন শক্ত করে সেই পুজোটাকে আপনাদের তালিকার বাইরে ফেলে দেবেন? একটা বার করুন। জানিয়ে করুন। তা হলে, সামনের বছর পুজোয় একটু কম যন্ত্রণা ভোগ করব। হয়তো। |
|
|
|
|
|