|
|
|
|
রেলের অনুষ্ঠানে বাদ বাম সাংসদ |
বাংলা থেকে আমরা-ওরা মীরা কুমারের এজলাসে |
অনমিত্র সেনগুপ্ত ও প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
আমরা-ওরার লড়াই আচমকা স্পিকারের এজলাসে। আর তাতেই ফাঁপড়ে পড়ে গিয়েছে রেল।
মুকুল রায়ের রেলমন্ত্রিত্বে বর্ধমানে রেলের এক অনুষ্ঠানে স্থানীয় সিপিএম সাংসদকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এ নিয়ে সরকারি প্রটোকল ভঙ্গের অভিযোগ তুলে স্পিকারের দ্বারস্থ হয়েছেন ওই সিপিএম সাংসদ। রেল মন্ত্রককে এই অভিযোগ খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন স্পিকার মীরা কুমার।
আর এতেই উভয় সঙ্কটে পড়েছে রেল। তৎকালীন রেলমন্ত্রীর দফতরের নির্দেশ মেনে সিপিএম সাংসদকে আমন্ত্রণ
|
মুকুল রায় |
|
শেখ সইদুল হক
|
জানানো হয়নি, এ কথা স্বীকার করে নিলে প্রোটোকল ভাঙার অভিযোগ প্রমাণ হবে। সেই অপরাধে স্পিকারের সামনে জবাবদিহি করতে হবে রেলবোর্ডকে। আবার স্থানীয় সাংসদকে আমন্ত্রণ না জানানোরও কোনও সদুত্তর মিলছে না। ঠেলায় পড়ে রেল এখন বিষয়টিকে আপসে মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। রেলের যখন এ হেন ‘সিপিএম রাখি না তৃণমূল রাখি’ অবস্থা, তখনও দুই দলের আকচাআকচি থামছে না। সিপিএম বলছে, রেলের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই তৃণমূল শিষ্টাচারবিধি ভাঙছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে কলকাতায় মেট্রো রেলের অনুষ্ঠানে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আর তৃণমূল নেতৃত্ব বলছেন, এই রাজনীতির শুরু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমল থেকেই। তাঁদের দাবি, বাম-জমানায় দক্ষিণ কলকাতায় রাজ্য সরকারের কোনও অনুষ্ঠানেই স্থানীয় সাংসদ মমতা ডাক পেতেন না।
ঘটনার সূত্রপাত গত ২৮ জুলাই। ওই দিন বর্ধমান স্টেশনে বর্ধমান-বলগোনা রেললাইন ব্রডগেজে রূপান্তরের পর ট্রেন পরিষেবা চালু হয়। বর্ধমানের কাটোয়া রোডের উপরে ওভারব্রিজেরও শিলান্যাস হয়। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা সেই অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন। ছিলেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়ও। এ ছাড়াও রাজ্যের মন্ত্রী রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, মলয় ঘটক ও জেলার দুই তৃণমূল বিধায়ককে ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজারের তরফে অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র ছাপানো হয়। বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়। কিন্তু স্থানীয় বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রের সাংসদ, সিপিএমের শেখ সইদুল হককে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। জেলার অন্য দুই সাংসদও সিপিএমের। তাঁদেরও আমন্ত্রণ জানায়নি রেল। আমন্ত্রণ জানানো হয়নি জেলার সিপিএম বিধায়কদেরও।
পরের মাসেই রেল মন্ত্রকের উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে মুকুল রায়ের সামনেই এ নিয়ে সরব হন সইদুল হক। যুক্তি দেন, তিনি নিজে সংসদে রেলের ওই প্রকল্পগুলি নিয়ে দাবি তুলেছিলেন। অথচ স্থানীয় সাংসদ হওয়া সত্ত্বেও রেল তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর সৌজন্য দেখায়নি। বৈঠকের পরেই স্পিকারকে চিঠি দিয়ে রেল মন্ত্রকের বিরুদ্ধে প্রোটোকল ভঙ্গের অভিযোগ জানান সইদুল। রেলকে রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ জানিয়ে তিনি চিঠিতে বলেন, “একাধিক বার এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ইচ্ছাকৃত ভাবে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। রাজ্যের শাসক দলের ব্যক্তিদেরই শুধু ডাকা হয়েছে।” মুকুলের পাল্টা যুক্তি, “আমন্ত্রণের প্রক্রিয়াটা আগে জানা দরকার। সাংসদকে সাধারণত ডাকা হয় ঠিকই। তবে তা বাধ্যতামূলক নয়। বুদ্ধদেবের আমলে দক্ষিণ কলকাতায় যত উড়ালপুল উদ্বোধন হয়েছে, সেখানে স্থানীয় সাংসদকে ডাকা হয়নি। আমি দক্ষিণ কলকাতার ভোটার, রাজ্যসভার সাংসদ। আমাকেও ডাকার প্রয়োজন বোধ করেননি ওঁরা।”
এই কথা কাটাকাটিতেই বিষয়টা আটকে থাকলে রেলের মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু সিপিএম সাংসদ যে সরাসরি স্পিকারের কাছে দরবার করবেন, তা ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেনি রেল মন্ত্রক। মন্ত্রকের একটি সূত্রের দাবি, আমরা-ওঁরার বিভাজন মেনেই সে সময় তৎকালীন রেলমন্ত্রীর দফতর থেকে মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, সিপিএমের কোনও সাংসদকে যেন ওই অনুষ্ঠানে না ডাকা হয়। কিন্তু সমস্যা হল, এ নিয়ে কোনও লিখিত নির্দেশ নেই। ইতিমধ্যে মুকুল রেল মন্ত্রক থেকে বিদায় নিয়েছেন। অপ্রিয় পরিস্থিতি এড়াতে বিষয়টি আপসে মিটিয়ে নেওয়ারও চেষ্টা করে রেল মন্ত্রক। রেল বোর্ডের পক্ষ থেকে সইদুল হককে ফোন করে বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে ক্ষমা চাওয়া হয়। তাঁর কাছে দুঃখপ্রকাশও করা হয়। রেলের এক কর্তার কথায়, “মুখে বললে প্রমাণ থাকে না। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা যা, তা আবার লিখিত ভাবেও দেওয়া যায় না।” রেল মন্ত্রকের একাংশ আবার মনে করছে, গোটা ঘটনায় রেল বোর্ডের কোনও দোষ নেই। রেলমন্ত্রীর দফতরের নির্দেশ মানতে গিয়ে এই সমস্যা। তাই যা সত্য, তা সামনে আসাই উচিত। যদিও সত্যি স্বীকার করে নেওয়ার অর্থ হল, রাজনীতিকদের অঙ্গুলিহেলনেই রেলবোর্ডকে চলতে হয়, এই অলিখিত সত্যে সিলমোহর পড়ে যাওয়া। সে ক্ষেত্রে শুধু রেল বোর্ড নয়, গোটা রেল মন্ত্রকের গরিমাই ক্ষুণ্ণ হবে।
রেলের এই উভয় সঙ্কট দেখে উৎফুল্ল সিপিএম সাংসদ। সইদুল বলছেন, “তৃণমূলের তরফেই যে এমন নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তা বুঝতেই পেরেছি। রেল মন্ত্রকের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই এই ধরনের অভব্যতা করে আসছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। কিন্তু রেলের কর্তারা তো লিখিত নির্দেশ দেখাতে পারছেন না। মৌখিক নির্দেশের মূল্য নেই।” মুকুল রায়ের কটাক্ষ, “এ সব ওঁনার ছেলেমানুষি। প্রথম বার সাংসদ হয়েছেন। আর তো জিতে আসতে পারবেন না। তাই স্পিকারের কাছে নালিশ করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চান।” সিপিএমের লোকসভার দলনেতা বাসুদেব আচারিয়ার বক্তব্য, রেলের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না জানানো নিয়ে স্পিকারের কাছে তাঁদের তরফে নালিশ এই প্রথম। ইউপিএ-র দ্বিতীয় পর্বে তৃণমূলের হাতে রেল মন্ত্রক আসার পর থেকেই এই ধরনের ঘটনা শুরু হয়েছিল। বাসুদেববাবু বলেন, “সইদুল হক তো শুধু প্রটোকল ভঙ্গের অভিযোগ করেছেন। আমার মতে এতে সাংসদের স্বাধিকার ভঙ্গও হয়েছে।” বাসুদেববাবু জানান, মমতা রেলমন্ত্রী থাকাকালীন দলের তরফে প্রধানমন্ত্রীকে লিখিত ভাবে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। কোনও সুরাহা না হওয়ায় এ বার নিয়ম মেনে স্পিকারের কাছে অভিযোগ আনা হয়েছে। |
|
|
|
|
|