|
|
|
|
ভাঙা কপ্টারের আড়ালে |
এখনও তাজা যুদ্ধ-স্মৃতি |
রাহুল রায় • কলকাতা |
ধু ধু রোদ্দুরে কমলাকান্ত তখন একটু আড়াল খুঁজতে চেয়েছিলেন।
যে আড়ালে একটু স্বস্তি আছে, ক্ষীণ হলেও বাঁচার সম্ভাবনা আছে। এমন একটা আড়াল।
কয়েক হাতের মধ্যে বুনো ঝোপে মুখ গুঁজে বায়ুসেনার চপারটা তখনও ডানা ঝাপটে চলেছে। তীক্ষ্ণ ব্লেডের
|
কমলাকান্ত কামাং |
আঁচড়ে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে চার দিকে ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ি আগাছা। সর্বাঙ্গে ধূলো মাখা ক্লাস টেনের কিশোর মরিয়া হয়ে পাথরের আড়ালে আপ্রাণ আড়াল খুঁজছে।
পঞ্চাশ বছর আগের পাহাড়ি গ্রামের সেই দুপুরটা এখনও ‘তাজা’ তাঁর কাছে।
—
“আভি ভি তাজা হ্যায় সাব!” বাঁচতে চাওয়ার সেই দুপুরটা এখনও মাঝে মাঝে মনে পড়ে কমলাকান্ত কামাঙের।
দু-হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে মধ্য-ষাটের বৃদ্ধ এখনও ঝড়ের মতো ফিরে যেতে পারেন পাক্কা অর্ধ শতাব্দী দূরের সেই ২০’শে অক্টোবরে। যে ভোরে, সীমান্ত-সমস্যার ‘জবাব’ দিতে নর্থ ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি সংক্ষেপে নেফা, অধুনা অরুণাচল প্রদেশের বোমডিলা সীমান্ত উজিয়ে তাওয়াঙের দিকে নেমে এসেছিল চিনের সেনাবাহিনী।
কমলাকান্তের মনে আছে, প্রথম সকালটা। বলছেন, “ভোর বেলায় ভারি বুটের আওয়াজ শুনে ভেবেছিলাম সরকারিবাবুরা সার্ভে করতে গ্রামে এসেছেন। দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছিলেন বাবা। আমিও মুখ বাড়াচ্ছিলাম। আমাদের দেখেই এগিয়ে এসেছিল এক জওয়ান। ভাষা কিছুই বুঝিনি। শুধু বুঝেছিলাম কেউ যেন ঘরের বাইরে পা না রাখি।”
পঞ্চাশ বছর আগের সকালটা এ ভাবেই শুরু হয়েছিল কমলাকান্তের। কাঠের বাড়ি। আলকাপার ছাউনির উপরে চুড়ো করে কাঠেরই তৈরি ছাদ। ঠান্ডা রুখতে আপাদমস্তক কাঠের দেওয়ালের এক টুকরো ফাঁক দিয়ে সারা দিন তাঁরা উদ্বিগ্ন চোখে দেখেছিলেন সেনাবাহিনীর টহলদারি। কিন্তু এরা কোন দেশের সেনা? চেহারার আদল, কথাবার্তা কেমন অন্যতরো যেন! বেয়নেট উঁচিয়ে ঘুরে বেড়ানো চেরা চোখের সেই সেনাদের সাহস করে সে কথা জিজ্ঞাসা করবে কে?
তফাৎটা বুঝতে কমলাকান্তদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও একটা দিন। অরুণাচলের প্রত্যন্ত সেই পাহাড়ি গ্রাম কার্যত দুটো দিন দখলে রেখে দিয়েছিল চিনের সেনা বাহিনী।
“তবে এটা সত্যি, গ্রাম দখল করে রাখলেও চিনের সেনারা গ্রামের মানুষের উপরে কোনও অত্যাচার চালায়নি”, বলেন কমলাকান্ত। তবে সেই দুটো দিন বাড়ির বাইরে পা রাখার অনুমতি দেয়নি ‘বিদেশি সেনা’। খাবার ফুরিয়ে আসছিল ক্রমেই। পানীয় জলও প্রায় শেষ। অক্টোবরের শেষে জাঁকিয়ে ঠান্ডাও নেমে এসেছে। জলের কষ্টটা তাই অতটা বোঝা যায়নি। কিন্তু এ ভাবে আর কাঁহাতক চলে? |
|
ভারত-চিন যুদ্ধে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। শনিবার তাওয়াঙে। ছবি: পি টি আই |
প্রতিরোধটা এসেছিল তৃতীয় দিনে। ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ তাঁর খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়িতে হাত রেখে মনে করতে থাকেন, “দিন দুই পরে পাহাড়ের নীচ থেকে গুলি ছুটে আসতে থাকল। জবাব ফিরিয়ে দিল চিনের সেনাবাহিনীও। বুঝলাম এ বার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।” এই সুযোগেই গ্রামের পিছনে পাহাড়ি পাকদণ্ডি বেয়ে নেমে গিয়েছিল কামাং পরিবার। তাওয়াঙের উপকণ্ঠে তাদের কাঠের বাড়ি, পাহাড়ের খাঁজে প্যাকিং বাক্স দিয়ে গড়া শুয়োরের আস্তানা, রডোডেনড্রন গাছসব পড়ে থাকল পিছনে।
গ্রামে ছেড়ে তাঁরা সপরিবার নেমে এসেছিলেন পাহাড় থেকে নীচে, আরও নীচে, সেলা, ভালুকপং। তারপর অসম সীমান্তের একটি গ্রামে সাময়িক ঠিকানা গেড়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু দিন কয়েকের মধ্যে পাহাড়ের সেই পাদদেশেও নেমে এসেছিল চিনের সেনাবাহিনী। পাহাড়ের ঠাঁইনাড়া আরও অজস্র পরিবারের সঙ্গে অসমের উত্তর লখিমপুরে ঘর বেঁধেছিলেন তাঁরা। তারপরে এক সময়ে ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে পাহাড়ের সঙ্গে সম্পর্ক চিরতরে চুকিয়ে কমলাকান্তের ঠিকানা বদলে যায় মাজুলি দ্বীপে।
এখন বাঁশের গায়ে ছেনি-কাটারির কোপে নকশা তোলেন তিনি। সেই সূত্রে কলকাতা, দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে তাঁর। বছর কয়েক আগে কলকাতার এক পরিচিত পুজো মণ্ডপ তাঁর কারুকার্যে সেজে উঠে ছিনিয়ে নিয়েছিল বেশ কিছু পুরস্কারও। ডাক পড়ে দিল্লির লোকসংস্কৃতি মেলাতেও। শিল্পীর কাজে কি যুদ্ধের স্মৃতিও ছাপ ফেলে? কমলাকান্ত মৃদু হাসেন।
স্বাধীন ভারতে বৈদেশিক শক্তির প্রথম আক্রমণের প্রথম পর্বে কোনও প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি দেশের সেনাবাহিনী। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নেফা আর পশ্চিমে লাদাখ সীমান্তে একই সঙ্গে চিন আক্রমণের প্রাথমিক পর্ব ছিল প্রায় ‘প্রতিরোধহীন’। ‘ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার’, নেভিল ম্যাক্সওয়েলের বিতর্কিত বই কিংবা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক ইতিহাসের শিক্ষক স্বপন রানাড়ের চিন-ভারত সম্পর্ক বিষয়ক লেখায় এমনই উল্লেখ রয়েছে।
আর কমলাকান্ত বলছেন, “তিন দিন পরে গ্রাম থেকে নেমে এলাম আমরা। তাওয়াঙ থেকে অনেক নীচে এক গ্রামে, আত্মীয়ের বাড়িতে। রাস্তার ধারেই ছিল সে বাড়ি। আমরা দেখতাম, ট্রাক বোঝাই ভারতীয় সেনা চলেছে পাহাড়ের দিকে।” সেই সময়েই এক দুপুরে কমলাকান্তের সামনে মুখ থুবড়ে পড়েছিল ভারতীয় বায়ুসেনার ওই হেলিকপ্টার। তিনি বলেন, “মাঝে মাঝেই দেখতাম আকাশ কালো করে ঝাঁক বেঁধে যুদ্ধ বিমানের যাত্রা। ঘড়ঘড় আওয়াজটা শুনে ভেবেছিলাম তেমনই কিছু। কিন্তু মুখ তুলে দেখি একটা হেলিকপ্টার গোঁ গোঁ করে নেমে আসছে। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেটা মুখ থুবড়ে পড়ল পাহাড়ের খাঁজে। পরে শুনেছিলাম চিনের সেনা বাহিনীর গুলি লেগে বিকল হয়ে য়ায় বায়ুসেনার ওই কপ্টারটি।”
পাহাড়ের হাতছানি পিছনে ফেলে অতঃপর অসমের সমতলে পাড়ি দিয়েছিল কামাং পরিবার। কিন্তু সব কী ফেলে আসা যায়? পঞ্চাশ বছর পরেও, তাওয়াঙে তাঁর গ্রামের সেই রডোডেনড্রন গাছটা এখনও হাতছানি দেয় কমলাকান্তকে। |
|
|
|
|
|