থিমের পর্দা সরিয়ে হাতের কাজে নজর
বোধনের সন্ধ্যায় দক্ষিণের একটি মণ্ডপে হাঁ করে ‘বৃষ্টি’ দেখছিল এক দল তরুণ-তরুণী। তবে, জলের ধারা নয়, সেখানে ঝরে পড়ছিল কাচ-পাথরের দ্যুতি।
উত্তরের এক পুজোয় সেরামিকের ঠাকুর দেখতে বাঁধভাঙা ভিড়। সরু গলির পুরোটা জুড়েই সেরামিক-ছাঁচে চোখ জুড়োন সূক্ষ্ম কারুকাজ। শিল্পের এই অমোঘ টানেই শনিবার সন্ধ্যায় জনজোয়ারে ভাসল শহরের রাস্তা। ঠাকুর দেখা শুরু হয়ে গিয়েছিল প্রতিমায় প্রাণপ্রতিষ্ঠার দু’-তিন দিন আগেই। উৎসবের লগ্ন সমাগত হতে সেই উন্মাদনা তুঙ্গে উঠল।
গত কয়েক বছর ছিল হরেক রকম তত্ত্বভারী থিম ভাবনার। তার দাপটে সূক্ষ্ম হাতের কাজ যেন চাপা পড়ে গিয়েছিল। এ বার অনেক মণ্ডপেই সেই পর্দা সরিয়ে নজর কেড়েছে নতুন ধরনের হাতের কাজ। উত্তর, পুর্ব থেকে দক্ষিণ, শহরের অনেক মণ্ডপেই চমকে দেওয়ার মতো কাজ করেছেন নানা শিল্পী। কেউ একেবারে নতুন, আবার কেউ বা পুজো ময়দানের উঠতি তারকা। কেউ ব্যবহার করেছেন কাচ-পাথর বা ক্রিস্টাল, কেউ বা মণ্ডপ থেকে প্রতিমা, পুরোটাই তৈরি করেছেন সেরামিক দিয়ে। শুধু তাই নয়, মণ্ডপে ব্যবহার হয়েছে মশলাও।
গত কয়েক বছর ধরেই শহরে নানা ধরনের আকর্ষণীয় পুজো উপহার দিয়েছেন শিবশঙ্কর দাস। ক্রমেই প্রথম সারির শিল্পী হয়ে ওঠার পথে এ বার তিনি দক্ষিণ কলকাতার চক্রবেড়িয়া সর্বজনীনের পুজোয় তুলে এনেছেন বৃষ্টিকে। ছোট ছোট কাচ-পাথরের কাজে সেটাকেই ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। পঞ্চমীর সন্ধ্যা থেকেই জনতার চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে ওই মণ্ডপে। সন্তোষপুর ত্রিকোণ পার্কে শিবশঙ্করের তৈরি মণ্ডপ দেখে বাইরে থেকে মনে হতেই পারে, আস্ত কদম ফুল। ভিতরে ঢুকলেই মিলছে অন্য রূপ।
হাতিবাগানের নলিন সরকার স্ট্রিট এ বার চমক দেখাচ্ছে সেরামিকের কাজে। দীর্ঘ দিনের শিল্পী সুবোধ রায়ের কাছে এ বারের পুজো ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। উত্তর কলকাতার ওই পুজোর মণ্ডপ তৈরি করেছেন তিনটি ধুতুরা ফুলের আদলে। মণ্ডপসজ্জা তো বটেই, প্রতিমাও তৈরি হয়েছে সেরামিক দিয়ে। উদ্ভিদের সঙ্গে প্রাণীজগতের সম্পর্ককে তুলে ধরছেন শিল্পী। শনিবার সন্ধ্যায় লোকের ভিড়ে তখন সামনে রাস্তায় চলাচলই দায়।
পূর্ব কলকাতার কাঁকুড়গাছির মিতালি সঙ্ঘেও এ বার শিল্পের টানে লোক ঢুকছেন। শিল্পী পরিমল পাল সেখানে দুর্গার নানা রূপ তুলে ধরেছেন। মণ্ডপের ভিতরে বাঁশের কাজ। সঙ্গে আলোর কারসাজিও যেমন রয়েছে, চোখ ফেরানো যাচ্ছে না প্রতিমা থেকেও। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় সেখানে হাজার কয়েক লোকের লাইন।
কালীঘাট মিলন সঙ্ঘের দায়িত্ব এ বার নিয়েছেন সুজিত দাস নামে এক নতুন শিল্পী। সেখানে কাচের শিশির নানা ধরনের কাজ তো রয়েছেই, দর্শকের চোখ টানছে মণ্ডপের ভিতরে বাঁশের তৈরি পৃথিবী। আনকোরা এই শিল্পীর কাজ দেখতে যে ভাবে ঢল নামছে, তাতে আগামী দিনে সুজিতকে নিয়ে পুজো কমিটির টানাটানি পড়বে বলেই ধারণা উদ্যোক্তাদের। একই কথা বলা যায় সুনীলনগরের পুজো নিয়েও। শিল্পী তাপস কাঞ্জিলালের বাঁশের কাজ দেখতে ঢল নামছে মানুষের। জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’-র থিম ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।
বহু বছর আগে যোধপুর পার্কে রাজস্থানের দিলওয়ারা মন্দির গড়ে চমকে দিয়েছিলেন দীপক ঘোষ। এ বার দেশপ্রিয় পার্কে স্বর্গের অমরাবতী-নন্দন কানন গড়ে সেই স্মৃতিকেই উস্কে দিয়েছেন তিনি। পুজোর শিল্পীদের মধ্যে বিভিন্ন স্থাপত্য গড়তে দীপক অগ্রণী। দেশপ্রিয় পার্কে তাঁর কাজ দেখতে ভরসন্ধ্যায় ঘণ্টাখানেক লাইনে দাঁড়াতেও আপত্তি নেই ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধের।
দক্ষিণ কলকাতার প্রথম সারির পুজোর মধ্যে চিরকালই রয়েছে বাবুবাগান। এ বার নতুন শিল্পী সুতনু মাইতি সেখানে বাঁশের কাজ করেছেন। দর্শকের চোখ টানছে সন্তোষপুর লেকপল্লীতে শিল্পী পূর্ণেন্দু দে-র কাজও। মেহগনি, শিরিষ, কদম কাঠ দিয়ে মণ্ডপের কাজও। সপ্তমীর রাতেও সেখানে লাইন দিয়ে ঠাকুর দেখেছেন দর্শকেরা।
মণ্ডপসজ্জার উপকরণে এ বার চমক দিয়েছে উল্টোডাঙা যুববৃন্দ। চাঁদ সদাগরের থিমে নানা ধরনের মশলা দিয়ে সেজেছে মণ্ডপ। ভাঁড়ের মণ্ডপ গড়ে চমক জাগানো কসবার বোসপুকুর শীতলামন্দিরেও এ বার নতুন শিল্প। বিশ্বনাথ দে সেখানে উল্টোনো রিকশার থিমে মণ্ডপ তুলে ধরেছেন। লোহা ও কাঠের মেলবন্ধনের কারুকাজ দেখতে জনতার ঢল শুরু হয়েছে শুক্রবার থেকেই। লোহার কাজে স্বপ্নারবাগানে নজর কাড়া কাজ করেছেন শুভ বসু। ঘূর্ণায়মান লোহার কাঠামো দেখতে দলে দলে লোক ঢুকছে সেখানে। বাগমারি সংগ্রামীতে তিনি তুলে ধরেছেন পটের কাজ। কাঠের কাজ চোখ টেনেছে হাটখোলা গোঁসাইবাগানের পুজোও। সেখানে দুর্গাকে প্রকৃতির আধার হিসেবে তুলে ধরেছেন শিল্পী শুভাশিস চক্রবর্তী। লোহা দিয়ে মণ্ডপ তৈরিতে দর্শকদের নজর কাড়ছে তেলেঙ্গাবাগান ও খিদিরপুর ২৫ পল্লীর কাজ।
‘যিনি মণ্ডপ করেন, তিনি ঠাকুরও গড়েন’এই বাক্যটিই এ বার যথাযথ হয়ে উঠেছে শিল্পী স্নেহাশিস মান্নার ক্ষেত্রে। গত বার দক্ষিণ শহরতলির একটি পুজোয় লোহার কড়াইয়ে আলপনা তুলে ধরে নজর কেড়েছিলেন তিনি। এ বার তাঁর তৈরি প্রতিমা দেখতে মানুষের ঢল নামছে পল্লীমঙ্গলের মণ্ডপে। প্রতিমায় নজর কাড়া কাজ দেখিয়েছেন বশিষ্ঠ গুহ ও হরিপদ বসু।
দমদম সুভাষনগরের একটি পুজোয় তাঁরা প্রতিমা গড়েছেন থার্মোকল, কাপড়ের মিশ্রণে। দমদম ১৪ পল্লী সর্বজনীনের পুজোয় মীনাক্ষি মন্দির গড়ে চমক লাগিয়েছেন তিন শিল্পী, রামকৃষ্ণ মালো, অভিজিৎ হালদার ও বিশ্বজিৎ মণ্ডল। নজর কাড়া মূর্তিও গড়েছেন তাঁরা। ৫০ বছর পুরনো এই পুজোয় এ বার ভিড় লেগেছে ষষ্ঠীর সন্ধ্যা থেকেই।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.