টাকার অভাবে কোনও প্রসূতি বা সদ্যোজাতের যাতে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু না-হয় তার জন্যই শুরু হয়েছিল জননী ও শিশু সুরক্ষা কর্মসূচি (জেএসএসকে)। সময়মতো রাজ্যেকে টাকাও পাঠিয়েছিল কেন্দ্র। কিন্তু চলতি বছরে এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত সেই টাকা খরচ করতে রাজ্যের অনেক জেলা ডাহা ফেল করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
আর এই তথ্য সামনে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই ১৯ অক্টোবর কেন্দ্রীয় সরকার ২০১১-১২ সালের স্যাম্পেল রিজার্ভেশন সার্ভে প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, গোটা ভারতে শিশুমৃত্যুর হার অনেকটা কমলেও (হাজারে ৪৬ থেকে কমে হয়েছে হাজারে ৪৪) পশ্চিমবঙ্গে তা বেড়েছে। ছিল হাজারে ৩১, বেড়ে হয়েছে হাজারে ৩২।
জেএসএসকে-এর টাকা খরচ করে ‘ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট’ না-পাঠালে কেন্দ্র পরবর্তী টাকা আটকে দেবে। তাতে মা ও শিশুর নিখরচায় চিকিৎসা আরও ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা। স্বাস্থ্য দফতরের একাংশের মতে, এখন কেন্দ্রে আর বন্ধু সরকার নেই যে রাজ্য টাকা খরচ না-করতে পারলেও কোনও রকমে কথা বলে কেন্দ্রকে পরবর্তী টাকার অনুমোদনের জন্য মানিয়ে নেওয়া যাবে। মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী যখন বারে বারে বলছেন, অর্থের অভাবে বিভিন্ন প্রকল্প এগোতে পারছে না, সেখানে জেএসএসকে-তে টাকা থাকা সত্ত্বেও রাজ্য সময়মতো খরচ করতে না-পারায় স্বাস্থ্যকর্তারা অস্বস্তিতে পড়েছেন।
উত্তর দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, পুরুলিয়া, কোচবিহার, হাওড়া, নদিয়ার মতো অনেক জেলায় কোথাও মাত্র অর্ধেক টাকা খরচ হয়েছে, কোথাও আবার তিন ভাগের এক ভাগও খরচ করা যায়নি। এ দিকে, সরকারি হিসাবে এই জেলাগুলিতে শিশু ও প্রসূতি মৃত্যুর হার যথেষ্ট। গত ১৩ অক্টোবর, শনিবার স্বাস্থ্যভবনে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য-অধিকর্তাদের ডেকে ভর্ৎসনা করেছেন স্বাস্থ্য-কর্তারা।
জেএসএসকে-তে গর্ভবতী হওয়ার পর থেকে প্রসূতির এবং শিশুর জন্মের পর থেকে ২৮ দিন বয়স পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালে তাদের যাবতীয় চিকিৎসা নিখরচায় হওয়ার কথা। কিন্তু রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারাই জানাচ্ছেন, টাকা পড়ে থাকা সত্ত্বেও ওই সব জেলায় সরকারি হাসপাতাল থেকে প্রসূতি ও নবজাতকের বাড়ির লোককে বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে গত কয়েক মাস ধরেই অভিযোগ আসছিল।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, কী কারণে জেএসএসকে-র টাকা খরচ হচ্ছে না, এ ব্যাপারে কোন জেলা কী ব্যবস্থা নিচ্ছে তা আগামী ১ নভেম্বরের মধ্যে লিখিত জমা দিতে বলা হয়েছে জেলা মুখ্যস্বাস্থ্য অধিকর্তাদের। স্বাস্থ্যঅধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপতীর কথায়, “সরকার কিছু আর্থিক সুবিধার কথা ঘোষণা করেছে। তার জন্য টাকাও দিয়েছে। সেটা খরচ করাটা আমাদের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন না করলে জবাবদিহি চাইতেই হবে, সেটাই চেয়েছি। টাকা পড়ে থাকবে আর প্রসূতি-শিশু ওষুধ পাবে না, এটা চলতে পারে না।”
কেন খরচ করা যায়নি টাকা? রাজ্যের পরিবারকল্যাণ অফিসার জ্যোতির্ময় চাকীর বক্তব্য, “নতুন কর্মসূচি হওয়ায় কী পদ্ধতিতে টাকা খরচ করা হবে, তা অনেক জেলা বুঝতে পারেনি। তারা শুধু রাজ্যের তহবিল থেকেই টাকা খরচ করেছে। তা ছাড়া, ‘ডিস্ট্রিক্ট রিজার্ভ স্টোর্স’গুলিতে ওষুধের হিসাব রাখতে একটা নতুন সফটওয়্যার বসানো হচ্ছিল। তখন টাকা খরচের হিসাব নথিভুক্ত করা যেত না বলে অনেকে খরচই করছিলেন না।” তিনি আরও বলেন, “অনেক সরকারি হাসপাতালে আবার বার বার বলা সত্ত্বেও স্পেশ্যালিস্টরা জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন করছিলেন না। ফলে সেই প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে টাকায় ছাড় পাওয়া যাচ্ছিল না। কারণ নিয়মানুযায়ী, একমাত্র জেনেরিক নামে লেখা ওষুধের টাকাই এই কর্মসূচিতে মেটানোর কথা।”
২০১২ সালের এপ্রিল নাগাদ পশ্চিমবঙ্গে কমর্সূচিটি পুরোপুরি চালু হয়। এ বছর এপ্রিলে রাজ্যের প্রতিটি সরকারি হাসপাতালের বাইরে যে বেসরকারি ওষুধের দোকান রয়েছে সেগুলির সঙ্গে চুক্তিও করে স্বাস্থ্য দফতর। ঠিক হয়, হাসপাতালের লিখে দেওয়া কাগজ দেখালে ওই দোকানগুলি প্রসূতি ও নবজাতককে নিখরচায় ওষুধ দেবে। সেই টাকা কয়েক দিনের মধ্যে মিটিয়ে দেবে স্বাস্থ্য দফতর।
কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, চাহিদা থাকা সত্ত্বেও জেএসএসকে কর্মসূচির টাকা জেলায় খরচই হচ্ছে না। |