পুস্তক পরিচয় ১...
রবীন্দ্রনাথ কি আশীর্বাদ করতেন?
প্রথমেই সুখবর! রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’, শরৎচন্দ্রের ‘ছিনাথ বউরূপী’, সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’, বিভূতিভূষণের ‘ঠ্যাঙারে বীরু রায়’ এমন সব অমর গল্প নিয়ে যোগীন্দ্রনাথ সরকার সম্পাদিত গল্প-সঞ্চয় (১৯৩৬) পুনর্মুদ্রিত হল (নবরূপায়ণ পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়)। ভূমিকায় লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ: ‘গল্পের দুর্ভিক্ষ নিবারণের জন্যে যারা কোমর বেঁধেছেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য যোগীন্দ্রনাথ... ছেলেরা তো আশীর্ব্বাদ করতে জানে না। সেই আশীর্ব্বাদ করবার ভার নিলেন তাদের বন্ধু রবীন্দ্রনাথ।’ হাতের মুঠোয় অনেক পুজো সংখ্যা, সবেতেই হাজারো গল্প। রবীন্দ্রনাথ করতেন কি আশীর্বাদ?
‘ছোট’দের পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা-য় উপন্যাস সবকটিই রহস্য-রোমাঞ্চের, পড়তে কমবেশি ভাল লাগে। গল্পের মধ্যে অন্য স্বাদ আনার চেষ্টা থাকলেও সব তেমন জমেনি। প্রচেত গুপ্তর বড়গল্প মানবিক মূল্যবোধের কথা মনে করিয়ে দেয়। যুধাজিৎ দাশগুপ্তর ‘কোথাকার জল কোথায় গড়ায়’ বাংলায় জনপ্রিয় বিজ্ঞানরচনার ধারায় সার্থক সংযোজন। কিন্তু কিশোররা কি আর ছড়া-কবিতা পড়বে না? কিশোর ভারতী পঁয়তাল্লিশে পড়ল। লেখার সংখ্যা অনেক, বৈচিত্র্যও কম নয়। পুরাণ-ইতিহাসকেন্দ্রিক কয়েকটি উপন্যাসের সঙ্গে ‘তিনু তান্ত্রিকের পুঁথি’র মতো জমাটি মজার লেখাও আছে। প্রচুর গল্প, কমিকস, ছড়া-কবিতায় ভরা উজ্জ্বল শারদীয় সম্ভার। মনে থেকে যায় শঙ্খ ঘোষের ‘বীরাঙ্গনা’
‘স্বাধীনতা দিন
নয় এক দিন
বহুদিন জোড়া সে-ইতিহাস...’।

শুকতারা-র বয়স পঁয়ষট্টি। নারায়ণ দেবনাথের ‘বাঁটুল দি গ্রেট’, ‘হাঁদাভোঁদা’ আজও সপ্রাণ, কিন্তু নেই শুধু মধুসূদন মজুমদারের ঐতিহাসিক রসসমৃদ্ধ কলম। কর্নেলের স্রষ্টা সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের শেষ গল্প ‘হু-হুম্বা রহস্য’ নিঃসন্দেহে প্রাপ্তি। পি সি সরকার জুনিয়রের ভ্রমণকাহিনিতে সেরেঙ্গেটি-র গ্রামের শিক্ষিত মাসাই শিল্পী হাসি দেখে নিশ্চিত হয়ে যান, তিনিই তাঁর প্রিয় জাদুকর!
সূচিপত্রে গল্প-উপন্যাসকে নানা রকম তকমা দিলে পাঠক আকৃষ্ট হয় নিশ্চয়ই, সঙ্গে সঙ্গে খোঁজার চোখটাও অলস হয়ে যায়। চার ডজনেরও বেশি গল্পে ভরা ছুটির জগৎ সেই পথেরই পথিক। ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় ও সংকর্ষণ রায়ের ‘কিশোর উপন্যাস’-এ শেষরক্ষা হয়নি। ‘মজার গল্প’ আর ‘হাসির গল্প’ এখানে আলাদা! চিরকালের ছেলেবেলা-র বয়স মাত্র দুই। প্রচ্ছদে মহিষাসুর কান ধরে মা দুর্গার কাছে মাফ চাইছে। ছোটদের উপযোগী গল্প-কবিতা-ছড়া-নাটিকার পাশাপাশি ছোটদের নিজস্ব বিভাগ ‘কিচিরমিচির’। শমীক সাহার ছড়া-নাটিকা ‘দৌড়’ ছোটরা মঞ্চস্থ করুক, বেশ লাগবে। কিশোর দুনিয়া-য় ভিন্ন স্বাদের বিশেষ রচনা ‘কলকাতার আকাশে প্রথম বাঙালি বেলুনযাত্রী’। দীনবন্ধু মিত্রের কথা বলেছে ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’। গল্প-ছড়া-কবিতার সঙ্গে ছোট্ট চৌকো খোপে ‘তুমি কি জানতে’ কলমে নানা অজানা তথ্য। শতদ্রু-র ছড়া-গল্প-কবিতার ভাণ্ডার মূলত বেশি ছোটদের জন্য। সরল, সাদাসিধে গল্প বলার ভঙ্গিতে ‘কুঁড়ির ছবি আঁকা’, ‘দোলা’, ‘জোনাকিটা কোথায় গেল’, ‘অভির বাড়ি চড়ুইবাসা’ রোদ-ঝলমল শারদ আকাশেরই মতো। ‘ছোটদের নিজেদের পাতা’য় তাদের আঁকিবুকি, একটু লেখালেখি। মন ছুঁয়ে যায় ছড়ার দল:
‘ভালবাসা হারিয়ে গেলে
গাছ কখনো পাখনা মেলে?
চারপাশে ঘর থরে থরে
যাচ্ছে ভরে স্বার্থপরে
... আমার বড় একলা করে।’

চাঁদের হাসি কচি মনে হাসি ফোটাতে ঝকঝকে উপহার সাজিয়েছে। সূচি জুড়ে ষোলো জন গল্পকার কার্তিক ঘোষ, বলরাম বসাক কে নেই। ছড়ার ঝুড়ি টইটম্বুর। আছে কাজি নজরুলের নাটক ‘জাগো সুন্দর চির-কিশোর’ (পুনর্মুদ্রণ?)। ‘তোমাদের পাতায়’ সৃজন দে সরকারের ‘গোল্ডেন গোল’ কল্পনা ও বাস্তবের সরস মিশেল। ছোটদের কচিপাতা-র সেরা আকর্ষণ ‘চিরকালের সেরা’ ছড়া-কবিতা-গল্পের ঝুড়ি আছেন রবি আর অবন ঠাকুর, জীবনানন্দ, সুকান্ত, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, সুকুমার, উপেন্দ্রকিশোর। শান্তিপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পৃথিবীর ছাদে প্রথম মানুষ’ তেনজিং নোরগে-কে নিয়ে। নাটক-গল্প-ছড়া-কবিতা ছাড়াও আছে বিচিত্র সংবাদ, আর কমিকস। অঞ্জন বসুর মিষ্টি, রঙিন প্রচ্ছদ। ছোটদের জন্যে ছড়ায় সম্পাদকীয় হৈ হৈ-তে:
‘তোমার আমার দুর্গাপুজো
মাংস, মাছ, বিরিয়ানি
নতুন জুতোয় ফোস্কা নিয়ে
কেমনতর হয়রানি।’

সন্দেশ সমৃদ্ধ বিশেষ রচনায়: (এডওয়ার্ড) লিয়র ২০০, সুকুমার ১২৫, সন্দেশ ১০০। গল্প উপন্যাস কবিতা নাটক ভ্রমণ খেলা-র সঙ্গে প্রবন্ধও। কিন্তু শারদীয়-তে ধারাবাহিক উপন্যাস কেমন যেন বেখাপ লাগে।
গণিতবিদ শ্রীনিবাস রামানুজনের ১২৫ বছর, পক্ষীপ্রেমী অজয় হোমের ১০০-র সঙ্গে ভিটামিনেরও শতবর্ষ স্মরণ করাল কিশোর জ্ঞানবিজ্ঞান। পুনর্মুদ্রিত লীলা মজুমদার, শ্রীপান্থ, নারায়ণ সান্যাল। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ঘনাদার বাঘ’ ও সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল’ পূর্বপ্রকাশিত কি না উল্লেখ নেই। বিজ্ঞানভিত্তিক এক ডজন গল্প, ‘নিজে নিজে কর’ বিভাগ, ম্যাজিকের বিজ্ঞান, ‘সংস্কারবিরোধী গল্প’র পাশাপাশি অনেক লেখাতেই জানার আনন্দ আছে। কাগজের নিম্নমান ছোটদের মুখ ভার করতে পারে।
‘ইচ্ছে আমায় মাখায় ধুলো
ইচ্ছে বলে, ডিগবাজি দে
খাবারটা কী, বিচার করে
ইচ্ছে বাড়ায় কমায় খিদে’

শিশুমেলা জুড়ে ছোটদের ইচ্ছে-ফুলের মালা গেঁথেছে ছড়া/কবিতা, গল্প, লোককথা। ঐতিহ্য বজায় রেখে অলঙ্করণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে প্রণবেশ মাইতি, শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য, শঙ্কর বসাক, অরুণ চট্টোপাধ্যায়ের ছবিতে প্রতিটি লেখা প্রাণবন্ত। ছোট্ট হাতি দুলদুলি, মৎস্যকুমার, বেজি, মেনিবিড়াল, কুটকুটে কাক, ঠাম্মা, রাজা, সেপাই-এ জমজমাট একান্নবর্তী সংসার। ছোটদের কবিতা-য় সম্পাদক প্রথমেই বলেছেন, ‘ছড়া ভুরি ভুরি লেখা হয়, কিন্তু কবিতা কই?’ ছড়া-কবিতার তফাত বোঝা, ছন্দের কান তৈরি হতে থাকা, মিল ও অমিলের কবিতার সঙ্গে মিতালি পাতাতে ‘কী করে কবিতা লিখতে হয়’ (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়), ‘ছড়ার গল্প’ (সুভাষ ভট্টাচার্য), ‘ছোটদের কবিতায় ছন্দ’ (অপূর্ব দত্ত), শিশুসাহিত্য চর্চায় মগ্ন অশোককুমার মিত্র ও সুনির্মল চক্রবর্তীর সঙ্গে কথাবার্তার পাশাপাশি সুপাঠ্য কিছু কবিতা। শিবশঙ্কর ভট্টাচার্যের চমৎকার প্রচ্ছদে সজ্জিত রঙবেরঙ টারজানের শতবর্ষ মনে করিয়ে দিল। আছে অনেকগুলি ভাল গল্প, নাটক, ছড়া-কবিতা, ইতিহাস, বিজ্ঞান। ‘বাংলা আমার রক্ততে আছে, বাংলাতে আমি লিখি/ প্রত্যেকদিন নতুন করেই, বাংলা বলতে শিখি’ এই আশ্বাসের ছোঁয়া টগবগ-এর লেখায়, রেখায়। খুব ছোটরা আনন্দ পাবে যদি কেউ গল্পগুলো তাদের পড়ে শোনান, যেমন, ‘ইচ্ছে পাতার দেশে’, ‘রাজহাঁসের পালক’, ‘টুয়ার পাপু দাদা’। আবার ‘জদু কর নয়, জাদুকর’, ‘হেড মিসের পাখি পোষা’, ‘বেগুনকোদরের ভূত’, ‘ব্রহ্মানন্দ স্যার’ কৈশোরের মনের মতো। ‘শ্বেতপাথরের ময়ূর’ গল্পের শেষ লাইনটি (‘বাবাই এই প্রথম খুব কাছ থেকে জীবনকে দেখল’) জীবন ও সাহিত্যের মিশেলে ছোটবড় সবার মন ভাল করে দেয়। সুব্রত মাজী-র প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণে দৃষ্টিসুখ দুর্দান্ত। ষোলো বছরের অরিন্দম সিনহার রঙিন ছবি উড়োজাহাজ-এর প্রচ্ছদে। ছক-কাটা পাতায় ছাপা ছবি কচিকাঁচারা খুব কিছু না বুঝলেও কৈশোরকে নাড়া দেবে। পরিকল্পনা, বিন্যাস ও অলঙ্করণ সুন্দর। প্রতিটি গল্প থেকে অল্প অল্প তুলে এনে তৈরি হয়েছে ‘অল্প-গল্প’ লাইন খোঁজার মজার খেলায় শামিল হলে অভিনব প্রাপ্তিযোগ। আছে কুড়ি জন কবির ‘ছড়া-কবিতা’ ছোটরা খুঁজে নেবে কোন লাইন কোন কবিতার। শেষ পাতায় তাদের জন্য ছবি আঁকার ছক-কাটা পরিসর সৃজনী প্রক্রিয়ার অন্তর্গত হয়ে উঠবে তারা আপন খেয়ালে।
এখন তো গল্প পড়ার চেয়ে গল্প শুনতে আর দেখতে বেশি পছন্দ ছোটদের। বহু গল্পেরই প্রেক্ষাপট গ্রাম, কিন্তু গ্রামের খুদে পাঠকরাও সেই গ্রাম চেনে কি? ভেবেচিন্তে ছোটদের জন্যে লিখতে বসে অনেকেই কৃত্রিম এক সরল জীবনের কথা বলেন, যার সঙ্গে আজকের ছোটদের প্রত্যহের সম্পর্ক নেই। অধিকাংশই যেন তাড়াহুড়োয় কোনও রকমে শেষ হয় তাতে ছোটদের কল্পনাশক্তি জেগে ওঠে, না ধাক্কা খায় কে তার খবর রাখে! তাই ডজন ডজন ফরমায়েসি গল্প ছড়া পরিবেশন না করে ছোটদের ডাকতে হবে, ভাবাতে হবে, তাদের নানামুখী ভাবনার অংশীদার হতে হবে। তবেই না সৃষ্টিসুখ। তবেই না শারদোৎসব।

ফিরে পাওয়া
সকলেই ছোটবেলায় নানা পত্রিকা পড়েছি, কিন্তু সে সব পত্রিকার ইতিবৃত্ত তো কোথাও ধরা নেই! কারা লিখতেন বা আঁকতেন, সম্পাদনা কী ভাবে হত, কত দিন চলেছিল সবই আজ বিস্মৃত। ঝালাপালা এ বার সেই ইতিহাস ধরে রাখতে উদ্যোগী। প্রায় দুশো বছরের কালপর্ব থেকে পঞ্চাশটিরও বেশি ছোটদের পত্রিকার কথা একত্র এই সংকলনে। হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলার খানিকটা যেন অনেক যত্নে ফিরিয়ে দিলেন সম্পাদক অশোককুমার মিত্র।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.