...উৎসবের আলো
বঙ্গারণ্যে অসুর-জাগরণ
নন্তর লোমহর্ষণ-পুত্র সৌতি মহাভারতবর্ণনা সমাপ্ত করিলেন। রাত্রি অধিক হইয়াছিল, দূরে পেচক ও শৃগাল ডাকিতেছিল। সমবেত ঋষিরা গাত্রোত্থান করিয়া আশ্রমের পথ ধরিলেন। কেবল পাঁচ-সাত জন থাকিয়া গেলেন। তাঁহাদেরই এক জন বলিলেন, ‘কিন্তু সৌতি, আপনি তো সম্পূর্ণ মহাভারতটি বলিলেন না।’
সৌতি অবাক, ‘সে কী? কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ, কৃষ্ণের মৃত্যু, যুধিষ্ঠিরের সশরীরে স্বর্গারোহণ...অষ্টাদশ পর্বই তো বিধৃত করিলাম। কিছু গোপন করি নাই।’
এক ঋষিবালক ফিসফিস করিল, ‘আমরা শুনিয়াছি, ভগবান বেদব্যাস ইহার পরেও উনিশ নম্বর পর্ব লিখিয়াছিলেন। টপ সিক্রেট থাকায় উহা প্রচারিত হয় নাই। কিন্তু বেদব্যাস তাঁহার শিষ্য বৈশম্পায়ন ও আপনাকে সেই গোপন পর্বটি শুনাইয়াছিলেন।’
সৌতি চমকিত হইলেন, ‘কিন্তু উহা গূঢ়তর গোপনীয়।’
এক তাপস অনুনয় করিলেন, ‘দেখুন, আমরা কয়েক জনই আছি। নিশাবসানে অচিরে পিতৃপক্ষ শেষ হইয়া দেবীপক্ষ শুরু হইবে। ফলে, গোপন পর্বটি যদি বলেন! প্রমিস করিতেছি, কাকপক্ষীও জানিবে না।’
‘বেশ’, কয়েক মুহূর্ত ভাবিয়া সৌতি নিচু স্বরে বর্ণনা শুরু করিলেন, ‘পুরাকালে নৈমিষারণ্যের অদূরেই ছিল বঙ্গারণ্য। একুশ শতকে মহাভারতখ্যাত দৈত্য ও অসুরেরা সেখানে পুনর্জন্ম লাভ করিয়া প্রবল অত্যাচার চালাইয়াছিল।’
‘কী রকম?’ এক ঋষির প্রশ্ন।
‘পুরাণের নরকাসুরের কথা বলিয়াছিলাম। সে বিশ্বামিত্রের কন্যার সতীত্ব নষ্ট করিয়াছিল, দেবতা, গন্ধর্ব ও মানুষদের থেকে ১৬ হাজার কন্যাকে অপহরণ করিয়াছিল। বঙ্গারণ্যে সেই অসুর পুনর্জীবন পাইয়াছিল।’
‘সাঙ্ঘাতিক! কেহ চিনিতে পারে নাই তাকে?’ প্রশ্ন আর এক ঋষির।
সৌতি বিমর্ষ হাসিলেন, ‘না। বঙ্গারণ্যে তাহার নাম ছিল ধর্ষণাসুর। উদ্যানপথের নিশিনিলয় হইতে পার্শ্বপাস, বারাসপ্ত এলাকা সর্বত্র সে মহিলাদিগের উপর চড়াও হইয়াছিল। ট্যাক্সি, প্রাইভেট কার ইত্যাদি কোনও শকট বাকি রাখে নাই।’
‘ধষর্ণাসুরই কি সর্বাপেক্ষা প্রবল?’
সৌতি হাসিলেন, ‘বঙ্গারণ্যে কোন অসুর যে সবচেয়ে প্রবল ছিল, ঠাহর করা মুশকিল। মধ্যম পাণ্ডব যে বকাসুরকে বধ করিয়াছিলেন, পূর্বেই বলিয়াছি। বক রাক্ষসের কাছে রোজ চল্লিশ মণ ভাত, দুইটা মহিষ লইয়া যাইতে হইত। বক উদরপূর্তি করিত।’
‘হ্যাঁ, মনে আছে। ভীম সেগুলি নিজে খাইয়া, বৃক্ষ উপড়াইয়া তাহাকে পিটাইয়াছিলেন।’
‘সেই বকাসুর বঙ্গারণ্যে ফের জন্মাইয়াছিল। তাহার নাম হইয়াছিল নাধিগ্রহণাসুর,’ বলিলেন সৌতি।
‘নাদ মানে নাদব্রহ্ম? তাঁর বলে বলীয়ান অসুর?’ প্রশ্ন করিল এক মুনিবালক।
‘তুমি ছুটিতে সন্ধি, সমাস ও ব্যাকরণ উত্তমরূপে আয়ত্ত করিও,’ সৌতি উপদেশ দিলেন, ‘নাদের সহিত ওই অসুরের কোনও সম্পর্ক নাই। ন+অধিগ্রহণ+অসুর, এইরূপে সন্ধি করিয়া দুরাত্মা নিজের নাম রাখিয়াছিল নাধিগ্রহণাসুর।’
‘সে-ও বকাসুরের মতো তণ্ডুল, মাংস, পলান্ন, পিষ্টক ইত্যাদি খাইত?’ প্রশ্ন করিল বালক।
‘না, ওই সকল খাইবার সাধ বকজন্মেই তাহার ঘুচিয়া গিয়াছিল। ফলে বঙ্গারণ্যে নাধিগ্রহণাসুর কেবল সম্ভাবনা খাইত। রাজপথ প্রশস্তকরণ, বিদ্যুৎ সরবরাহের স্তম্ভ তৈরি, বৃহৎ শিল্পস্থাপন ইত্যাদি যাবতীয় সম্ভাবনা খাইয়া সে পুরুষ্টু হইয়া উঠিতেছিল।’
‘সম্ভাবনা খাইতে কেমন? টক? মিষ্টি-মিষ্টি?’ আর এক ঋষিকুমারের প্রশ্ন।
সৌতি হাসিলেন, ‘বলা দুষ্কর। তপোবনে মুনিঋষি ছাড়া কেহ বায়ুভক্ষণ করিয়া থাকিতে পারে না। তদ্রুপ অসুর ছাড়া কেহ সম্ভাবনা খাইতে পারে না।’
‘ওই দুই অসুরের উৎপাতেই কি বঙ্গারণ্য ক্রমে নির্জীব হইতেছিল?’ জিজ্ঞাসা করিলেন এক ঋষি।
‘না, অশিক্ষাসুরও ক্রমে বলশালী হইয়াছিল। বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় সব কিছুই তাহার আক্রমণে বিপর্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিল। অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের উপর সে গাত্রবল জাহির করিত।’
‘এত অসুর উৎপাত করিত?’ হতভম্ব প্রশ্ন এক ঋষিকুমারের।
‘১৯ নং পর্ব এখনও সমাপ্ত হয় নাই,’ সৌতি বলিলেন, ‘আর ছিল সিন্ডিকেটাসুর। মহাভারতে বলিয়াছিলাম, কশ্যপপত্নী অদিতির গর্ভে ধাতা, মিত্র, শত্র, বরুণ, বিষ্ণু প্রভৃতি দ্বাদশ আদিত্য জন্মাইয়াছিলেন। বিষ্ণু উহাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ, কিন্তু সর্বাপেক্ষা গুণজ্যেষ্ঠ। সিন্ডিকেটাসুরও তদ্রুপ। বয়সে ছোট, কিন্তু গুণে সকলের অধিক।’
‘বিষ্ণু তো বৈকুণ্ঠে থাকেন,’ বলিলেন এক তাপস।
‘সেই বৈকুণ্ঠ একটি। কিন্তু সিন্ডিকেটাসুর আরও প্রতাপশালী। যেখানে নির্মাণকার্য চলে, সেখানেই তাহার বৈকুণ্ঠ’, বলিলেন সৌতি।
তাপসগণ ভয়ার্ত। কেহ কেহ বঙ্গারণ্যের কথা ভাবিয়া শিহরিয়া উঠিতেছেন। এক জন জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আরও অসুর ছিল?’
সৌতি ঘাড় নাড়িলেন, ‘হ্যাঁ, আর ছিল ভয়ঙ্কর কমনিষ্ঠাসুর। সে ইচ্ছামতো লাল, সবুজ যে কোনও বর্ণে নিজেকে বদলাইতে পারিত। খড়গ, অসি, ভল্ল কোনও আঘাতেই তাহাকে শেষ করা যায় না। বঙ্গারণ্যে কেহ নিজেকে কমনিষ্ঠাঘাতী ভাবিয়াছিল। কিন্তু দেখা গেল, ওই অসুর রক্তবীজের ন্যায়। হন্তারকের ঘাড়ে উঠিয়াই নবজীবন পাইয়াছে।’
‘সাঙ্ঘাতিক তো!’
‘কমনিষ্ঠাসুরের দুই পুত্র। জ্যেষ্ঠ অজ্ঞতাসুর। ছদ্মবেশী কমনিষ্ঠাসুর যখনই কাহারও ঘাড়ে সওয়ার হইত, অজ্ঞতাসুর সঙ্গী হইত। অজ্ঞতা হইতে বঙ্গারণ্য তখন ‘চলিছে না, চলিবে না’ মন্ত্র আওড়াইত। ভিনদেশি বণিক, বিনিয়োগ কিছুই চলিবে না।’
‘কিন্তু অজ্ঞতা জ্ঞানালোকে দূর হইয়া যায়,’ তর্কের চেষ্টা করিলেন এক তাপস।
সৌতি হাসিলেন, ‘ইহা আপনাদের নৈমিষারণ্যের কথা। বঙ্গারণ্যে জ্ঞানালোকের স্থান নাই। সেখানে অজ্ঞতাসুরের পশ্চাতে নীরবে আসিত তাহার ভ্রাতা জিদাসুর। ফলত জিদ এবং আত্মগরিমা প্রবল হইতেছিল, রাজধর্ম এবং ন্যায়ধর্ম ক্রমে উৎসন্ন যাইতেছিল।’
‘কিন্তু অসুরেরা এত শক্তিশালী হইল কী ভাবে? পিতামহ ব্রহ্মার আশীর্বাদে?’
‘না’, সৌতি ঘাড় নাড়িলেন, ‘পিতামহ ব্রহ্মা নন। বঙ্গদেশের অসুরেরা একটি নতুন তন্ত্রের আবাহন করিয়াছিল। শৈবতন্ত্র, তারাতন্ত্র, দশমহাবিদ্যাতন্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী ওই তন্ত্র। উহার নাম দলতন্ত্র। উহারই বলে অসুরেরা বলীয়ান হইতেছিল।’
এক ঋষি বলিলেন, ‘শুনিয়াছি, ভগবান বেদব্যাস এই উনিশ নম্বর পর্বের নাম রাখিয়াছিলেন বঙ্গপর্ব। কিন্তু তিনি উহা প্রচার না করিয়া গোপন রাখিলেন কেন, সৌতি?’
পূর্বাকাশে ক্রমে আলোর রেখা ফুটিতেছে। সৌতি সে দিকে তাকাইয়া বলিলেন, ‘আপনারা জানেন, মহাভারত লিখিবার সময় গণেশ শর্ত দিয়াছিলেন, তিনি লেখা থামাইতে পারিবেন না। ব্যাসদেব পাল্টা বলিয়াছিলেন, তাহা হইলে গণেশ না বুঝিয়া লিখিতে পারিবেন না। ফলে, ব্যাসদেব মহাভারতের জায়গায় জায়গায় দুরূহ হেঁয়ালি বলিয়াছিলেন। এক্ষণে উহা ‘ব্যাসকূট’ নামে খ্যাত। কিন্তু উনিশ নম্বর পর্বের শুরুতে গণেশই একটি প্রশ্ন করেন। ভগবান ব্যাস তাঁহার উত্তর দিতে পারেন নাই।’
‘কী প্রশ্ন?’ স্তম্ভিত সকলে।
‘গণেশ প্রশ্ন করিয়াছিলেন, ‘ইহা লিখিব কেন? বঙ্গারণ্যে শিল্প থাকিবে না, আমার পূজায় কেহ সিদ্ধিলাভ করিবে না। তাহা হইলে অযথা ডিক্টেশন লইব কেন?’ ব্যাসদেব উত্তর দিতে পারেন নাই। ইহাই গোপন গণেশকূট। যান, ভোর হইয়াছে। আশ্রমে গমন করুন। দেখিবেন, এই গোপন বঙ্গপর্ব যেন প্রকাশ না পায়।’
নৈমিষারণ্যে তত ক্ষণে দেবীপক্ষের প্রথম আলো পড়িয়াছে।

অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.