|
|
|
|
|
|
|
ব্যাগ গুছিয়ে... |
ফরাসি সুগন্ধির মতো
পড়ন্ত বিকেলের পুদুচেরি কেমন যেন মন-কেমনের। এলোমেলো হাওয়া
ছুঁয়ে ছুঁয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে বিশ্ব নাগরিকেরা। লিখছেন সোমঋতা ভট্টাচার্য |
|
ইল্লে...নো পার্কিং!
দুই ড্রাইভারের কথা চালাচালিতে হঠাৎ হুঁশ ফিরল। কী রকম একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম এত ক্ষণ। চেন্নাই এয়ারপোর্ট থেকে সাঁ-সাঁ দৌড়চ্ছিল গাড়ি। আর হুড়মুড়িয়ে বদলে যাচ্ছিল দু’ধারের জনপদ। কোভাডি, ওমান্ডুর, মইলাম, আরুভাপক্কম...কখনও ঘিঞ্জি মফস্সল, তো কখনও ধু-ধু চাষের জমি। মসৃণ হাইওয়ে দিয়ে প্রায় উড়েছি তিন ঘণ্টা। এর মধ্যেই কখন ঢুকে পড়েছি সেই শহরটাতে, যেখানে আসার ইচ্ছেটা মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলাম বহুকাল।
পন্ডিচেরি পন্ডিচেরি! এখন অবশ্য খাতায়-কলমে নাম পুদুচেরি। তবুও পুরনো নামটা একফোঁটা আদরের মতো লেগে রয়েছে গায়ে। ঠিক যেমন শহরটা অনেক বদলে গেলেও রয়ে গিয়েছে ফরাসি ফরাসি গন্ধটা। তাই ‘রু্য দো লা মারিন’ এখনও নিয়ে যায় অতলান্ত বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত। সেখানে নিরন্তর ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে এবড়োখেবড়ো কালো পাথরে। |
|
সমুদ্র আছে। তবে ‘সি-বিচ’ বলতে ঠিক যেমনটা বোঝায়, তা নয়। এখানে সমুদ্রতীরের অন্য গাম্ভীর্য, পেলব মেদুরতা। তাই কি জীবন-সায়াহ্নে এখানেই আশ্রম গড়েছিলেন অরবিন্দ? শহরের অন্যতম প্রধান দ্রষ্টব্য স্থান শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম, সেখানে সমাধিতে শেষ ঘুমে শায়িত ঋষি অরবিন্দ এবং শ্রীমা। অদ্ভুত নীরবতা গোটা এলাকা জুড়ে।
সমুদ্রের ধার দিয়ে শ্লথ পায়ে হাঁটছি বিকেলবেলা। পাশে পাশে চলছে বঙ্গোপসাগর। কমলা সূর্যটা নরম আলো ফেলছে মুখে। পড়ন্ত বিকেলের পুদুচেরি কেমন যেন মন-কেমনের। ইতস্তত কিছু আইসক্রিম-ফুচকাওয়ালা অথবা ফুলের মালার ফেরিওয়ালার সামনে ভিনদেশি ভিড়। এলোমেলো হাওয়া ছুঁয়ে ছুঁয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে বিশ্ব নাগরিকেরা। কারও শরীরী ভাষা অন্যের সঙ্গে মেলে না। এই জায়গাটা অতুলনীয়! এখানে পায়চারি করেই দিন কেটে যায় নিমেষে। ইচ্ছে হলে চলে যাওয়া যায় শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমে অথবা এমনিই চক্কর কাটা যায় অলিগলি ধরে। আশ্রমেরই অনেক দ্রষ্টব্য স্থান আছে লাইব্রেরি, মিউজিয়াম, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার অফ এডুকেশন, সুগন্ধি তৈরির জায়গা, আরও কত কী! আছে জোয়ান অফ আর্কের মূর্তি, অগুনতি গির্জা, রমাঁ রলাঁ লাইব্রেরি, অথবা শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরে ছুন্নাম্বর বোট হাউস। সেখানে আবার মিলবে ‘ব্যাক ওয়াটার’। |
|
রাস্তার নামগুলোও কেমন অন্য রকম! ‘রু্য দো লা মারিন’, ‘রু্য রমাঁ রলাঁ’ বা ‘রু্য দ্যুমা’। গাছগাছালির ছায়া-ঘেরা নিঝুম পথের ধারের বাড়িগুলো ফরাসি স্থাপত্যের। এটা তো ‘ভিল ব্লঁশ’ অর্থাৎ কি না ফরাসি কলোনি। আরও কিছু দূর এগোলেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শহিদদের স্মরণে ‘ফ্রেঞ্চ ওয়ার মেমোরিয়াল’ আর দুুপ্লের মূর্তি।
এখন কি সত্যিই নিজের দেশে আছি? ওই যে সামনের হেলে পড়া গাছটা, তার নীচে ছোট্ট কাঠের বেঞ্চ দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে যেন জলরঙে আঁকা ছবি। এমন ছবি আমার দেশে মেলে কি? অনেক ক্ষণ হাঁটার পরে একটু জিরিয়ে নিতে সাধ যায়। ওই তো সামনেই ‘লো ক্যাফে’। ওখানেই দু’দণ্ড বসি। ধোঁয়া ওঠা ক্যাফে ল্যাটে-য় চুমুক দেওয়ার ফাঁকে কানে ভেসে আসছে টুকটাক ‘বঁজ্যু’, ‘বঁ সোয়ার’, ‘সা ভা’। ভাঙা ভাঙা ইংরেজি আর ফরাসিতে কথা চালাচালি। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, কিছু ক্ষণ আগে ক্যাফের দেওয়ালে দেখা শব্দবন্ধ। ফরাসি লেখক ভোলতেয়ারের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী প্রেম কোনও ফরাসি রমণীর সঙ্গে ছিল না, ছিল এক ভারতীয় শহরের সঙ্গে। সত্যিই তাই। পুদুচেরির ‘লা কোত্ দাজুর দো লেস্থ’ বা ‘দ্য ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরা অফ দ্য ইস্ট’ নাম সার্থক! |
|
বেলা গড়িয়ে যায়, সন্ধ্যে নেমে আসে। জ্বলে ওঠে রাস্তার আলোগুলো। মনে হয় অবিরাম বসে থাকি নোনা হাওয়া গায়ে মেখে। আর নিঃসীম বঙ্গোপসাগর মৃদু গর্জনে কথা বলে যাক। সামনে দিয়ে ওই তো দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গিনীর হাত ধরে হাঁটতে বেরিয়েছেন অশীতিপর শ্বেতাঙ্গ। জার্মান সুন্দরী তার দুই খুদেকে নিয়ে তড়িঘড়ি বাড়ির পথে। ইতস্তত হেঁটে বেড়াচ্ছে ফরাসি প্রণয়ীযুগল। এক কথায় চোখের সামনে চলমান এক টুকরো পৃথিবী, আর আমিও যেন বিশ্বপথিক।
পরের দিনের গন্তব্য অরোভিল বা ‘সিটি অফ ডন’। শহর থেকে একটু দূরে। দেশ-ভাষার নিরিখে কোনও বিভেদ না রেখে এখানেই এক জনপদ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন শ্রীমা। হয়েছেও তা-ই। এখন অরোভিলের জনসংখ্যার অধিকাংশই ফরাসি, জার্মান ও ভারতীয়। প্রবেশপথে একাধিক ভাষায় লেখা ‘স্বাগত’। অরোভিলের কেন্দ্রস্থলে মাতৃমন্দির। আর যথারীতি জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে অগণন মানুষের আনাগোনা। |
|
সবুজের চাঁদোয়া ঘেরা সে জায়গা। একা একা হেঁটে যেতে পারি অনেক ক্রোশ। কেউ বাধা দেওয়ার নেই। শুধু প্রকাণ্ড মহীরূহেরা ঝুরি ফেলেছে, আর আমারই মতো আরও কিছু ভিনদেশি সবুজের ভিড়ে একা হয়ে হারিয়ে যাওয়ার সবটুকু আনন্দ শুষে নিচ্ছে। কিছু ক্ষণ আগেই দেখে এসেছি সোনার বলের মতো মাতৃমন্দির! সূর্যের আলো পিছলে যাচ্ছে তার গায়ে। আর এখন অরোভিলের নিজস্ব রেস্তোরাঁয় তোফু স্যালাড খেতে খেতে মনের পাতা ওল্টাচ্ছি। ছুটি আসছে ফুরিয়ে। দিন দু’য়েকের মধ্যেই আবার কাজে ফেরা। তবু মণিকোঠায় থেকে যাবে পুদুচেরির স্মৃতিটুকু, যেখানে নীল সাগরের জল ছুঁয়ে নিরিবিলি কেটে যায় আয়েসের দিন।
|
কী ভাবে যাবেন |
এখন হাওড়া থেকে ট্রেনে সরাসরি পৌঁছনো যায় পুদুচেরি। এ ছাড়া, বিমানে বা ট্রেনে চেন্নাই হয়েও যেতে পারেন।
অথবা, ট্রেনে হাওড়া থেকে ভিল্লুপুরম জংশনে নেমে সেখান থেকে বাসে বা গাড়িতে পুদুচেরি। |
কোথায় থাকবেন |
শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমের নিজস্ব কিছু অতিথিশালা রয়েছে। তবে সেগুলো আগে থেকে
বুক করতে হয়। তা ছাড়া প্রচুর বেসরকারি হোটেলও রয়েছে। |
|
|
|
|
|
|
|