ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা কতটুকু বা কতখানি, তাহা লইয়া অনেক তর্ক। তবে কিছু কিছু ব্যক্তি সম্পর্কে তর্ক তুলনায় কম। তাঁহারা এতটাই স্বতন্ত্র, কার্যকারণসূত্রের পরিচিত এবং প্রত্যাশিত গতিপথ হইতে তাঁহাদের যাতায়াত এতটাই দূরবর্তী যে, ঘটনাপরম্পরার উপর তাঁহাদের প্রভাব অনস্বীকার্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমনই এক স্বতন্ত্র ব্যক্তি। পশ্চিমবঙ্গের উপর তাঁহার ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যের প্রভাব ইতিমধ্যে এতটাই প্রকট ও সর্বব্যাপী যে, তাহা লইয়া বলিবার কিছু নাই। সর্বভারতীয় রাজনীতিতেও তিনি যে ঢিলটি ছুড়িয়া দিয়াছেন, তাহার তরঙ্গবিক্ষোভ এখনও প্রবল। পরবর্তী নির্বাচনের আগে সেই আন্দোলন আর স্থিমিত হইবার ভরসা নাই। তাহার পাশাপাশি তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর সমর্থন প্রত্যাহারের অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়াও ইতিমধ্যে বহু-আলোচিত, তাঁহাকে সঙ্গী রাখিয়া মনমোহন সিংহের পক্ষে আর্থিক সংস্কারের পথে এক পা অগ্রসর হওয়াও সম্ভব ছিল না। সরকার এবং ইউ পি এ হইতে তাঁহার প্রস্থানের পরেও সংস্কার কত দূর যাইবে, সে প্রশ্ন আলাদা, কিন্তু আর্থিক নীতির বন্ধনমুক্তির জন্য প্রস্থানটি যথেষ্ট না হউক জরুরি যে ছিল, সে কথা প্রশ্নাতীত। কতটা জরুরি, তাহার অন্যতম প্রমাণ রেল মন্ত্রকের একটি সিদ্ধান্ত। সম্প্রতি মন্ত্রক স্থির করিয়াছে, ‘রেল ট্যারিফ অথরিটি’ তৈয়ারি করা হইবে, সেই কমিটি যাত্রী ভাড়া এবং পণ্য-মাশুল পরিবর্তনের একটি পদ্ধতি নির্ধারণ করিবে, অতঃপর সেই পদ্ধতি অনুযায়ী ভাড়া ও মাসুল নির্ধারিত হইবে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইউ পি এ’র শরিক থাকিলে এই কমিটির জন্ম হইত না, সে কথা মুকুল রায়ের নামে শপথ করিয়া বলিয়া দেওয়া যায়। রায় মহাশয় দিল্লিতে থাকুন অথবা নেত্রীর পাশে হাই কমান্ডের নির্দেশে জানাইয়া দিতেন, রেলের ভাড়া বা মাশুল নির্ধারণের জন্য কমিটির প্রয়োজন নাই, কারণ তাহা বাড়িবে না, রেলের খরচ বাড়ানো নিষিদ্ধ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় রেল ভবন এই নিষেধাজ্ঞায় অনড় ছিল। তাহার পরিণামে রেলের আয়ের কী পরিমাণ ক্ষতি হইয়াছে, লাভের হার কত কমিয়াছে, প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের সংস্থান কতটা ব্যাহত হইয়াছে, সে সবই বহুচর্চিত। কিন্তু তাহারও আগে এক মৌলিক ক্ষতি হইয়া গিয়াছে। রেল ভাড়া জনতোষণের স্বাভাবিক উপকরণ হিসাবে স্বীকৃত হইয়া গিয়াছে। ইহার দায় অবশ্যই একা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নহে। অতীতেও রেলভাড়াকে জনতোষণের কাজে ব্যবহার করা হইয়াছে, নির্বাচনী মরসুমে যাত্রীদের রেহাই দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু ‘কখনওই ভাড়া বাড়িবে না’, এমন নীতি অনুসরণ করা হয় নাই। এখন সরকারের সামনে দুই স্তরের সমস্যা। এক, দীর্ঘ স্থিতাবস্থার ফলে রেলভাড়া ও মাশুল ন্যায্য মাত্রা অপেক্ষা অনেক পিছনে পড়িয়া গিয়াছে ডিজেল বা রান্নার গ্যাসের মতোই। দুই, যাত্রীরা অপরিবর্তনীয় খরচে অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন। এই দুই সমস্যা অতিক্রম করিয়া রেলের প্রাপ্য বাড়ানোর একটা যুক্তিসঙ্গত নীতি তৈয়ারি করা জরুরি। প্রত্যাশা, প্রস্তাবিত কমিটি সেই কাজটিই করিবে। |