ভারতীয় রাজনীতি কোন অতলে নিমজ্জিত হইয়াছে, রাজনীতিকদের আচরণ, কথাবার্তা ও ভাবভঙ্গি হইতেই তাহা স্পষ্ট হইয়া যায়। প্রায়শ সেই ভাষা ও ভঙ্গি গণতন্ত্রের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে না। সংসদের বাহিরে অসংসদীয় আচরণ ও কথাবার্তার নিদর্শন তো ভূরি-ভূরি। সংসদের ভিতরেও প্রায়শ রাজনীতিকদের যে আচরণ দেশবাসীকে লজ্জিত করে, তাহা সাংসদদের পক্ষে একেবারেই বেমানান। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী সলমন খুরশিদের সাম্প্রতিক কথাবার্তা শুনিলে সংশয় জাগে, তিনিও কি বাহুবলীদের দলেই নাম লিখাইলেন? খুরশিদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আনিয়াছেন অরবিন্দ কেজরিয়াল। অভিযোগ যে কেহ, যে কাহারও বিরুদ্ধে আনিতে পারেন। যত ক্ষণ না অভিযোগ প্রমাণিত হইতেছে, তত ক্ষণ অভিযুক্ত ব্যক্তি নির্দোষ। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী হিসাবে খুরশিদ তাহা জানেন না, এমন নয়। তিনি যদি মনে করেন, তাঁহার অকলঙ্ক চরিত্রে কালিমা লেপনের অভিসন্ধিবশতই এমন অভিযোগের অবতারণা, তবে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তিনি সেই কলঙ্কলেপনকারীকে শিক্ষা দিতে পারেন। আইনমন্ত্রী বলিয়া নয়, ভারতের এক জন নাগরিক হিসাবেই সেই অধিকার তাঁহার আছে। অথচ, সেই স্বাভাবিক বিচারের পথে হাঁটিবার পরিবর্তে তিনি হুমকি ও ভীতি-প্রদর্শনের অগণতান্ত্রিক পথ অবলম্বন করিলেন।
সলমন খুরশিদ কিন্তু কোনও রাস্তার রাজনীতিক নহেন। রাস্তার আন্দোলন হইতে তিনি মন্ত্রিত্বের গদিতে আরোহণ করেন নাই। তিনি উচ্চশিক্ষিত, দেশের আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অন্যতম। দেশের বিভিন্ন অভিজাত বিতর্কসভায় এই তর্কশীল মানুষটি তাঁহার যুক্তিজাল বিস্তার করিয়া শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। উপরন্তু তিনি মার্জিত, রুচিশীল। অথচ দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হওয়া মাত্র তিনি অভিযোগকারীকে অনায়াসে ‘দেখিয়া লওয়ার’ হুমকি দিতে পারেন। অভিযোগকারী তাঁহার নির্বাচনকেন্দ্র ফারুকাবাদে গিয়া তাঁহার বিরুদ্ধে প্রচার করিবেন জানিয়া খুরশিদের হুমকি কেজরিয়াল ফারুকাবাদ যাইতেই পারেন, কিন্তু সেখান হইতে ফিরিতে পারিবেন কি? খুরশিদের আরও হুমকি এত কাল তিনি কেবল কলমের কালি দিয়া লড়িয়াছেন, এ বার রক্ত দিয়া লড়াইয়েও প্রস্তুত। হুমকির নিহিত ইঙ্গিত অস্পষ্ট নয়। তাঁহার সাংবাদিক সম্মেলনেও প্রশ্নকর্তা সাংবাদিকদের প্রতি তাঁহার মনোভাব, শরীরী ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক আদর্শ ছিল না। খুরশিদের মতো একজন বিজ্ঞ, পরিণামদর্শী, সম্ভ্রান্ত রাজনীতিকের কাছে এ ধরনের আচরণ ও ভাষা-ভঙ্গি কাঙ্ক্ষিত নয়, প্রত্যাশিতও নয়।
তবে কি খুরশিদের মতো ঠাণ্ডা-মাথার প্রাজ্ঞ রাজনীতিকও ভারতীয় সমাজের ‘গভীর গণতন্ত্রীকরণ’-এর পরিণাম সম্পূর্ণ এড়াইতে পারিতেছেন না? গণতন্ত্রকে গভীরগামী করিতে গিয়া এ দেশে রাস্তার রাজনীতি অনুশীলন করা গ্রাম্যতাদুষ্ট নেতাদের উত্থান নিশ্চিত করা হইয়াছে। আচরণের অসহিষ্ণুতা বা অভব্যতাকে এক ভাবে মহিমান্বিত করার চেষ্টাও প্রায়শই দেখা যায়। সংসদীয় অধিবেশন উপর্যুপরি ভণ্ডুল হওয়ার পিছনেও সেই রাজনীতির ক্রিয়া আছে। মণ্ডল ও কমণ্ডলুর শিবির হইতে এ ধরনের রাজনীতিকরা ক্রমশ প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আইনসভাগুলির আসন ভরাইয়া তুলিয়াছেন। তাঁহাদের বিরুদ্ধতার মোকাবিলা করিতে গিয়া কি সলমন খুরশিদের মতো পরিশীলিত অভিজাত রাজনীতিকরাও তাঁহাদেরই রাজনৈতিক ভাষা, পরিভাষা ও ভাবভঙ্গি অনুকরণ করিতেছেন? নাকি দুর্নীতি বা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ সম্পর্কে অতিরিক্ত স্পর্শকাতরতাই তাঁহার এমত প্রতিক্রিয়ার কারণ? কারণ যাহাই হউক, খুরশিদের এই প্রতিক্রিয়া দুর্ভাগ্যজনক এবং অমার্জনীয়। তাঁহার এমন প্রতিক্রিয়ায় তাঁহার দল বা সরকারের ভাবমূর্তিও কিছুমাত্র উজ্জ্বল হয় নাই। খুরশিদ নিশ্চয়ই একক ব্যতিক্রম নহেন। মন্ত্রী তথা রাজনীতিকরা যখন চতুর্দিক হইতে চাপে পড়েন, সমালোচিত বা আক্রান্ত হন, তখন অনেক সময়েই তাঁহাদের আচরণে নানা সমস্যা দেখা দেয়। অথচ, আপৎকালে মতি স্থির রাখাই নেতৃত্বের শর্ত, বিচক্ষণতার লক্ষণ। গীতায় উক্ত ‘স্থিতপ্রজ্ঞ’ ব্যক্তি সুখে এবং দুঃখে সমান থাকেন। নেতার প্রজ্ঞা যদি স্থিত না হয়, সাধারণ নাগরিকরা কাহাকে দেখিয়া শিখিবেন? |