|
|
|
|
|
জনৈক ‘ভোগ’বাদীর দুর্ভোগকথা
পাঁচতারার ভোগে উপভোগ কই? খিচুড়ি লাবড়া ভাজার
ওই পঞ্চব্যঞ্জনটিকে,
পরমান্ন বানাতে চাই মা-মাসিমার সোনার টাচ।
এ পুজোতেও কি সে সুখ পাব না?
অঞ্জন চট্টোপাধ্যায় |
|
|
কিছু কিছু জিনিস বাঙালির জীবন থেকে মায়ের ভোগে চলে গেছে, মায়ের ভোগ তার মধ্যে অন্যতম। ধৃষ্টতা মার্জনীয়, তবু সব কিছুতেই আধুনিকতার আতিশয্যে সত্যিই বলুন তো আমাদের জীবনে কতটুকু আর শুদ্ধাচার অবশিষ্ট আছে! নেই-নেই বলতে বলতে উলটো পথে হাঁটার কথা বলছি না। এগিয়ে যেতে গেলেও কিছু জিনিসকে যে আঁকড়ে ধরতে হয়, থ্রিজি-ফোরজি স্পিডে চলতে চলতে আমরা ভুলতে বসেছি সে কথা। মন্দিরে যেতে বলছি না, পাড়ার পুজো মণ্ডপেও বছর দশেক আগে যে ভোগ রান্না হত, কাজু-কিশমিশ-জাফরান-এলাচ-লবঙ্গ মেশা কসমো স্বাদের পাল্লায় পড়ে পুজোর সেই সাবেক স্বাদটা আজ হাওয়া হতে বসেছে। কে না জানে, আমরা এখন ভোগের ব্যাপারেও ইন-ভোগ থাকাতে বিশ্বাস করি। অষ্টমী বা নবমীর ভোগ উঠে এখন পুজোর চার দিনই পাত পেড়ে খাওয়া। খুবই সাধু এক সামাজিক উদ্যোগ। কিন্তু, এর মধ্যে যদি ফাঁকতালে নবরতন পোলাও ঢুকে পড়ে, হার্ডকোর বাঙালি হিসেবে দাঁত কিড়মিড় করে কি না বলুন। |
|
ছবি: দেবাশীষ দেব |
আসলে অর্থনীতিই এখন সব। বাজারই আপনাকে বলে দেবে কী খাবেন, কী দেখবেন, কী পরবেন। ভোগের স্থান পাঁচতারা রেস্তরাঁতেও। কাঁসার থালা বা কচিকলাপাতা সাজানো রেস্তরাঁয় অষ্টমীর স্পেশাল মেনু: পিয়োর মাদার্স ভোগ, অ্যাভেলেবল হিয়ার! বাজার যখন বলছে অথেনটিক, তবে তো বস সেটাই ঠিক। অতএব, বাঙালির মায়ের ভোগে যাওয়া আটকায় কে। খিচুড়ির সঙ্গে চিপস চলে না, পায়েসের বদলে আইসক্রিমই বা মানি কী করে। ফিউশন হতে হতে বাঙালি কালচারটাই ফিউজ হতে বসেছে, কে কাকে বোঝায়।
তবু এখনও বেশ কিছু বাড়িতে, বেশ কিছু বনেদি বারোয়ারি পুজো ধরে রেখেছে মায়ের ভোগের সেই সাবেকি স্বাদ। যেখানে ভোগ মানে কমপ্লিট একটা মিল, খিচুড়ি দিয়ে শুরু করে ভাজা, লাবড়া, চাটনি, পায়েসে তার সুখসমাপ্তি। কেষ্টনগর রাজবাড়ির পুজোয় তেমন ভোগ-ভক্ষণ আমার জিভ আজীবন মনে রাখবে। অমন স্বাদের সন্ধান পেলে এ কালের ছেলেমেয়েরাও পুজোর রাতে রেস্তরাঁয় লাইন দেওয়া ছেড়ে দেবে!
কাউকে কিছু ছাড়ার কথা বলছি না। ত্যাগের নয়, ভোগের কথা বলতেই আজকের ভ্যানতারা। আমরা তো সব সময়েই নতুন কিছু খুঁজি। আসুন না, এ বারের পুজোয় খুঁজি নতুন কিছু যা আদতে অনেক দিনের পুরনো। পুরনো সেই দিনের খাওয়াকে নতুন করে আবিষ্কার করতে দুগ্গা-দুগ্গা বলে চোখে দেখি মায়ের আশীর্বাদ।
কিন্তু ইচ্ছে থাকলেই সব সময় উপায় হয় না, সাবেক কালের সেই রেসিপির খোঁজ ক’জনই বা জানেন? সনাতনী ভোগ রান্না শেখার আগ্রহ থাকলেও শেখানোর মতো মানুষেরা আজ সত্যিই বিরল। বাংলা পোলাও, চাপড় ঘণ্ট, জাফরান সন্দেশ, এই সব দুষ্প্রাপ্য রান্নার সন্ধান তাই যত দিন যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে কালের গর্ভে। এমনকী কুচো গজা বা নিমকি-নাড়ুর খোঁজে, আমাদের লাইন দিতে হয় ভুজিয়াওয়ালার দোকানে। আত্মবিস্মৃত বাঙালির এই বোধহয় পরিণতি!
পুজোর আগে শোভাবাজার রাজবাড়িতে পুরোহিতদের ট্রেনিং প্রোগ্রাম হয়, নব্য শেফদের প্রশিক্ষণে এগিয়ে আসুন বাংলাদেশের রন্ধনবিদ মাসিমা-পিসিমারা। মায়ের হাতের স্বাদ অন্তত ভোগে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে। |
|
|
|
|
|