|
|
|
|
ইতি তেলোত্তমা |
এই চার দিন আমার কথা কেউ ভাবেও না, কেউ ফিরেও তাকায় না।
অথচ সারা বছর ‘কোলেস্টেরল’ ‘কোলেস্টেরল’ বলে কত কান্নাকাটি! দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত |
এ আমার কথা নয়, মেডিক্যাল রিসার্চ দ্বারা প্রমাণিত। সংসার দুখের হয় রমণীর আহ্লাদে। এই যে আমি কালে দিনে একটু একটু করে পৃথুলা হয়েছি, তিলতিল করে হয়ে উঠেছি তেলোত্তমা, সারাটা বছর আমায় এত খাতির যত্ন করে সামলে রাখিস, আমার ফিগার নিয়ে এত ভাবিস, আর যাতে মেদ না জমে তার জন্য মাঝরাতে হাঁটতে পাঠাস বরটাকে, চোখ রাঙাস, পটাং পটাং করে ‘মাথার দিব্বি’, ‘মড়া মুখ দেখবে’ বলিস, সেই তুই একটা বাহা আর একটা ঘিচা শাড়ি পেয়ে আমায় ভুলে গেলি? পুজোর বেশ ক’দিন আগে থেকেই সন্ধেয় আমার মালিক ঘরে ফিরে একা। কেন? কেন আবার, গিন্নি আজ গিয়েছেন ব্লাউজের মাপ দিতে তো পর দিন ছুট ফলস পিকোর দোকানে। তৃতীয় দিন ম্যাচিং চুড়ি হার দুল। চতুর্থ দিন ব্লাউজের ডেলিভারি, এতেও নিস্তার নেই, এক সন্ধে জুতো কেনায় যায় এবং শেষ বেলায় ‘এমা, দেখলে একদম ভুলে গেছি, ওই রং এর খামচিই তো নেই।’ অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও (!) গড়িয়াহাট। ও দিকে আমার ভগবান কি বাড়ি ফিরে পেটে খামচি মেরে বসে থাকবে? প্রথম দিন নিয়ম মেনে ক্রিম ক্র্যাকার তো পর দিন ওমলেট, শেষ দিন তো চর্বির বড়া দিয়ে শরবৎ খেয়ে আটটাতেই গভীর রাতের ঘুম। আর সোহাগি আমি, এত অনিয়মে সুখেন দাসের মতো কাঁদতে থাকি।
কত হাজার কিউসেক জল জমলে ডিভিসি বলে বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে, ঠিক জানা নেই। তবে আমি ২৪০ মিলিগ্রামের ওপর দিয়ে বইলে বিপদ অনিবার্য। আমি মানেই ‘লাদেন দিল লণ্ঠন’ (LDL), ১৬০ টপকে গেলে ‘কখন কী ঘটে যায় কিচ্ছু বলা যায় না’। আমি মানেই ‘মারব বুকে/ল্যাটা যাবে চুকে’, ‘আমি ম্যালোরি নই, ফ্যালোরি নই, আমি ক্যালোরিওয়ালা কোলেস্টেরল, এক ছোবলেই অগরু’। কোলেস্টেরল, আমি এক অতি বিষম বস্তু। স্নেহের কাঙাল, ডিসিপ্লিন বিলাসী। আমায় পাত্তা না দিলে আমি লিভারের কান ভারী করি। এমনটা নয় যে, আমি প্রথম বার এ কথা বলছি। এমনও নয় যে, আজকের গিন্নিমারা লক্ষ্মীর পাঁচালীর মতো আমার নামটা ভুলে গেছে, বরং বেশি বেশি করে জানে। অনেক বেশি মানে। ধ্যানে এবং জ্ঞানে। জীবন এখন ভেজিটেবল, অন্তত খাবার পাতে। আগে বাড়ি ছিল লালের দখলে। রেড মিটের আনাগোনা। এখন পরিবর্তন হয়ে শুধু সবুজ। তরকারিই জীবনের একমাত্র দরকারি। ‘শীত গ্রীষ্ম বর্ষা নিয়ম মানায় ভরসা’। এই বদবাক্য মেনে চলতে হয় সবাইকে। বরমাল্য কে না চায়, কিন্তু সেটা যদি গোল মালা হয়? এই গোলমেলে চিন্তাতেই আমার অধীশ্বর বেজার মুখে চারবেলা ঘাসপাতা খান, স্বপ্নে ঢেঁকুর তোলেন। আমি এমনই। পোজেসিভ প্রেমিকার মতো। আমায় একটু অবহেলা করলেই নেপথ্যে খোল করতাল খঞ্জনির আবহ। আর এই আতঙ্ক থেকেই গিন্নিমাও আমায় সমঝে চলেন, রেসপেক্ট দেন। সারা বছর।
সারা বছর? না, ভুল বললাম। বছরে চার দিন আমি বঞ্চিত। আমি সর্বহারা।
একা একা গাই
কবে যে কোথায় কী যে হল ভুল
জীবন জুয়ায় হেরে গেলাম।
এই চার দিন আমার কথা কেউ ভাবে না, ফিরেও তাকায় না। ওরে আমায় ইগনোর করলে যে তোদেরই সর্বনাশ, কে কার কথা শোনে। দুটো শাড়ি পেয়ে গিন্নি আহ্লাদে আটখানা, খুশিতে তার ষোলো কলা পূর্ণ। কথাবার্তাই বদলে গিয়েছে তাঁর। পৃথিবীতে যেন লঙ্কা, মরিচ, মুড়ো ঝ্যাঁটা আবিষ্কৃতই হয়নি। |
|
ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী |
‘ওগো শুনছ গো, মানা তো করতে পারি না, তাও বলছি, লক্ষ্মীটি বাবু, একটু খেয়াল রেখো নিজের, জানি সব নিয়ম মানা সম্ভব নয়, তবু...’ ব্যস, সাঁকো নাড়িয়ে, তার দু’চারটে নাটবল্টুও খুলে দিলে আর কী-ই বা বাকি রইল? কে না জানে পুরুষমানুষ সব সামলাতে পারে শুধু জিভটাই পারে না। গোলকিপারই যদি চোখে কাপড় বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে, তা হলে কোন আনাড়ি পেনাল্টি মিস করে? এর পরেই ‘মশলাগন্ধে আনন্দে নাচো নটরাজ হে।’ আমি এক কোণে চুপচাপ পড়ে থাকি, চর্বির চর্বিত চর্বণ শুনি। আরও অনেকের মতো উৎসবে আমিও বঞ্চিতের দলে। আমার অধীশ্বরও তেমনি, ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। গপগপিয়ে খাচ্ছে, আর চিবোতে চিবোতে বিকাশ রায়ের মতো ডায়লগ বলছে, ‘পুজোটা যাক, তার পর দেখো রেস্ট্রিকটেড লাইফ কাকে বলে।’ গা জ্বলে যায় না? এ কী? আমার রাস্তা কেটে উড়ালপুল হচ্ছে? ‘টুডেজ পেন, টুমরোস গেন’! এর পরে আমার যদি মনে হয় ১৬০ থেকে এক লাফে ১৬৬০ হয়ে যাই, তখন সেটা অন্যায়? ওরে তোর ফ্যাটের মেটাবলিজমের সমস্যা, তুই কিনা মেটেলোভাজ্ম-এ মজে গেলি? আমায় ভুলে গেলি? মেটের তৃষ্ণা মেটাতে এতটা মেটামরফোসিস? কর্তাকে সক্কাল বেলা ছোলা খাওয়াবেন ডাক্তারের এ হেন উপদেশ ভুলে গিন্নিমা সাতসকালে চুলে শ্যাম্পু করে শুকিয়ে, গরদের শাড়ি পরে চললেন অঞ্জলি দিতে, প্রশংসা কুড়োতে। ছোলা গিয়ে ছলা আর কলা এল। স্যরও তেমনি। লাউয়ের রস না খাওয়ার আনন্দে বেমালুম গুল দেয়, বাব্বা, চেনাই যাচ্ছে না, দশ বছর কমে গেছে বলেই আড়ে তাকান খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনে গয়না পরা মডেলের দিকে। লাউ না থাক ফাউ তো আছে। আমার কথা কারও মনেও এল না!
কে বলে পুজো চার দিনের? টেস্ট খেলার আগে রঞ্জি খেলার মতো বিশ্বকর্মা পুজোর দিন থেকেই আমার দর কমতে থাকে। টেলিভিশন-এর ভাষায় ‘আমার টি আর পি’ কমতে থাকে। এমনিতে আমি যেন ‘তোমায় ছাড়া ঘুম আসে না মা’। আর বীরেন ভদ্রর দিন থেকে তো আমার দফারফা। যে লোকটা বউয়ের জ্বালায় অফিস থেকে বেরোতেই চায় না, সেও এখন ঝাঁকের পায়রার মতো, সন্ধে হওয়ার আগেই দাঁড়ে ফিরে বকমবকম। আমার কথা ওঠে না পর্যন্ত। গিন্নী তো নয় ওয়ারেন হেস্টিংস। সামান্য তোষামোদেই রাজা, রায়বাহাদুর, খেতাব দানের মতো কর্তাকে অনিয়মের অনুমতি সনদ দিয়ে চলেছেন। কাকেই বা দোষ দেব মা দুগ্গা, আমার অমন রাশভারী, নিয়মমানা, হ্যান্ডসাম বয়ফ্রেন্ড থুড়ি মুনিব, সেও যে এমন সজনে শুটির মতো ঢলে পড়তে পারে, পুজো না এলে জানতাম? মা চার দিনের, আমি যে নিত্য দিনের। কে কার কথা শোনে, পুরনো প্রেমিকার সামনে দিয়ে নতুন বিয়ে করা বউকে নিয়ে গটগট করে ‘দিল্লি চলো’ মুডে হেঁটে যাওয়ার স্টাইলেই আমায় ফুৎকারে উড়িয়ে গপগপিয়ে খ্যাঁটন। কেউ মনে করালেই তার ভাগ্যে ধমক অনিবার্য, ‘আরে রাখো তো, কোলেস্টেরল, সারা বছর অনেক শুনেছি, এই চার দিন ও সব ধাষ্টামো চলবে না।’ কী তেজ! ওরে কালিদাস, তুই কার ডাল কাটছিস? মনে মনে নিজেকে বারুদের কারখানা ভেবে ফেটেফুটে যাব ভাবি তার পর বর্ষার জলে নুইয়ে পড়ার মতো দশা নিয়ে লিভার নামক ডাস্টবিনের পাশে ময়লাভরা ঠোঙার মতো পড়ে থাকি। গিন্নীমা’র কী দোষ? গিন্নীদের তো দুটোই রূপ প্রতিবাদী আর পতিবাদী। কিছু না পেলে প্রথমটা আর পেলে দ্বিতীয়টা। তাই বলে আমার বস আমার বশে থাকবে না? বসে বসে চোখের জলে ভাসব আমি? ‘পুজো যদি দুখের এমন হোক সে মিছে কল্পনা, কাঁদিয়ো না আমায় কাঁদিয়ো না।’
আমায় বঞ্চিত করে কী পাস তোরা? জানবি কোলেস্টেরল গোকুলে বাড়ে। চোখের জলেই পুষ্ট হই আমি। পুজোয় আমি সত্যি একা। একলা লিভার আমার দেশ, আমি একা বসে ফেলি নিঃশ্বেস...। এই উৎসবে আমি কেউ নই। সারা বছর আমায় নিয়ে মাতামাতি, মা এলেই আমার ইগোয় কষিয়ে লাথি? মা গো, এ কেমন তোমার বিচার? মা গো, আমায় একটু জায়গা দাও, আমি মন্দিরে বসি...! |
|
|
|
|
|