|
|
|
|
যেন কাঙালের মতো |
অনন্ত ঝলমলানির পাশেই, চরম বৈরাগ্যের মতো এই ক’দিন শহরের পার্কগুলো চেয়ে থাকে
পূজাবসানের আশায়,
শীতের অপেক্ষায়, আলো আর কমলালেবুর পা মেলানোর আনন্দে। মন্দার মুখোপাধ্যায় |
পাড়ার মোড়ে মোড়ে প্যান্ডেলের ঝলমলানি মানেই পার্কগুলোর চৌহদ্দির গাঢ় নিস্তব্ধতার ছায়া। বাঁশের আড়া আর কাপড়ের চূড়ার সটান উঠে যাওয়া এবং একেবারে ঢাকা পড়ে যাওয়া, কোণে কোণে বড় হয়ে ওঠা কদম্ব কুর্চি বা কৃষ্ণচূড়ার ঝাঁপালো ডালপালা। চার কোণে চারটে চড়া নিয়নের আলোও তখন ম্রিয়মাণ, দুর্গাপুজোর সহস্র টুনি লাইট ও ঝাড়বাতির কাছে। ঘাসগুলোয় শিশিরের ছোঁওয়া থাকলেও মর্নিংওয়াকারদের ভিড় নেই। ভিড় নেই সিমেন্টে বাঁধানো বা সবুজ রঙের লোহার বেঞ্চিগুলোতে। সারা রাত পুজো দেখে অথবা সকাল থেকে পাড়ার প্যান্ডেলে হল্লা জমাবার আয়েশে সকলেরই অন্য রুটিন। ভোরের হাঁটা, স্বাস্থ্যচর্চা বা জিলিপি-সিঙাড়া খাবার ‘খাই খাই’ ক্লাব সব থেকেই ছুটি। বৃদ্ধরাও ত্রিসীমানায় নেই, প্যান্ডেলের কচকচি ডিঙিয়ে পার্ক যাবার বাসনায়। বাচ্চাদের প্র্যামগাড়ির ভিড়ও শূন্য, কারণ আয়ামাসিদের ছুটি। ড্রাইভারদেরও পুজোয় স্পেশাল ডিউটি থাকায় ভোর না হতেই রেলিং জুড়ে পার্ক করা নেই, হাজারও মডেলের ছোট ছোট শৌখিন গাড়ির সারি। শহর বা শহরতলির পার্কগুলোতে পুজোর চার দিন একেবারেই অঘোষিত হরতাল। সকালের পার্কে, এ সময়কার ক্যানভাসে তাই মানুষ নেই। গাছে-পাতায়-ঘাসে শরতের শিশির, কোথাও বা ঝরে পড়া কমলাবোঁটার শিউলি, কোথাও জলঘেরির মধ্যে ম্যাজেন্টা। সাদা, গোলাপি, বেগুনি শাপলা, কোথাও সুগন্ধি দোলনচাঁপার ঝাড়। কোথাও আবার গাঢ় নীল অপরাজিতা বা নীলকণ্ঠ। আর খেয়াল করলে রোজকার মতোই দুর্গা টুনটুনি শালিখ চড়ুই কাক, ক্কচিৎ কখনও সবুজ টিয়ার ঝাঁক বা দু-একটা কালো দোয়েল। বছর কয়েক আগেও দেখা যেত শুঁড় বার করা শামুক, যা এখন একেবারেই অদৃশ্য। পুজোর চার-পাঁচটা দিন মানুষবিহীন এ হেন পার্কগুলো যেন প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য, কিন্তু সর্বতোভাবেই কোলাহলবিহীন। যেন বদ্ধাবাসের টুকরো আবাসন। |
|
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হতে না হতেই গাঢ় অন্ধকার। ঝালমুড়ি, ফুচকা, বাদাম, ঘটিগরম সমস্ত বিক্রিওয়ালাদেরর চার দিনের ভিড় প্যান্ডেলের ধারে-কাছে। সবুজবাড়ির মাসিমা, গলির মোড়ের স্কুটার-দিদি, কুকুরবাড়ির লাট্টুদা এঁরা কেউই আসবেন না বাঁধা খরিদ্দার হিসেবে পার্কের নিরালায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে টুকটাক মুখ চালাতে, আসবেন না প্রেমবিনিময়কারী জুটিগুলিও। জগৎবিস্মৃত হয়ে এ-ওকে জড়িয়ে বসে থাকবে না জারুল গাছের ছায়ায় বা একই বেঞ্চির মাঝখানটায় বিস্তর ফাঁক রেখে চরম বোঝাবুঝিতে, দু’টি জুটি দু’প্রান্তে, এক নিবিড় মুগ্ধতায়। ঢুকে আসবে না নাছোড়বান্দা, নিভৃতিভঙ্গকারী, মূর্তিমান বিঘ্নস্বরূপিণী সেই পাঁপড় বিক্রি করা মেয়েটিও। আর দঙ্গল বেঁধে হল্লাকারী কলেজফেরত ছেলেমেয়েগুলিও। আসবেন না অবসরপ্রাপ্ত সর্বজ্ঞ মানুষগুলি আলাপচারিতায় সামাজিক দুর্নীতি, রাজনীতি এবং অতীতচারণা। আসবে না সেই একলা বসে থাকা মেয়েটিও, কিছুক্ষণ একা বসে থেকে দু’দণ্ড বাতাস মাখতে। আসবে না স্কেচবুক-হাতে সদ্য গোঁফ গজানো চিত্রী, ভেলো কুকুরের অবয়ব আঁকতে। ভেলো, ঘুটু, ঠেঙি সমস্ত নেড়ি কুকুরগুলো পার্কের ঘেরি ত্যাগ করে কাতারে কাতারে মানুষের পিছনে ক্রমাগত ল্যাজ নাড়বে; কাগজকুড়োনো মানুষগুলিও পার্ক ছেড়ে পুজোমণ্ডপের আশেপাশে দেদার ফেলাছড়া প্লাস্টিক, ঠোঙা, জলের বোতল কুড়োবার আশায়।
তবে একটু গাঢ় রাতে রেলিং টপকে কেউ কেউ ঢুকবে। নেশাগ্রস্ত গ্যাঁজাড়ুরা, ছোটমোটো দল পাকিয়ে, আনাচকানাচ খুঁজে। ভুল করে ঢুকে যাবে কিছু মাতাল, টান-টান ঘুমিয়ে পড়বে বেঞ্চের বিছানায়। বেলা অবধিও কেউ বিরক্ত করে তুলে দেবে না। ইতস্তত শোনা যাবে ফিসফিসানি স্বরে চোর-ছিনতাইবাজদের গলা। নিশ্চিন্তে ভাগ হবে হিস্যার। আর আসবে আশ্রয় ভাড়া করতে না পারা সঙ্গম-উন্মুখ কিছু দেহবিলাসীর জুটি। গোপনে মিলিত হয়েই সটকে পড়ে ভিড়ে মিশে যাবে তারা। যে সব পার্কে সিকিউরিটির ব্যবস্থা আছে, চলবে দরদাম, ঘুষ। মাইকের জোর আওয়াজে সে-সব চাপা পড়ে যাবে। শুধু শ্বাপদ কিছু চলাচল আর শেয়ালের নীলচোখ বুঝিয়ে দেবে রাত গাঢ় হলেও পার্কগুলি একেবারে জনশূন্য নয়।
পুজোর পরে দেখা যাবে রেলিং টপকে ছুড়ে ফেলা এলোমেলো চিপসের প্যাকেট, কোল্ড ড্রিংকসের বোতল, দেশলাই খোল, ফেলে যাওয়া রুমাল আর পোড়া সিগারেট। কোথাও অসাবধানে টুকরো আগুনে ঝলসে যাওয়া গাছের পাতা বা খানিকটা ঘাস। কোথাও অবিশ্বাস্য রকমের স্তূপাকার ময়লা, দুর্গন্ধময়।
তবে ব্যতিক্রম সেই পার্কগুলি যেখানে দুর্গাপুজো হয়, প্যাণ্ডেলগুলিও পরিচিতি পায় পার্কেরই নামে। কিন্তু পুজোর আয়োজনে সেগুলিও আর পার্ক থাকে না। মস্ত মস্ত খুঁটি পুঁতে হাত তিনেক গর্ত। কাঠের পাটাতন ফেলে সাময়িক পাকা রাস্তা এবং গাছ থেকে গাছে টেনে ইলেকট্রিকের সংযোগ। তখন এ সব পার্কে আর শিশির পড়ে না। পাখি প্রজাপতি অদৃশ্য হয়ে যায় ভিড়ের শব্দে, ফুলগাছগুলি চলে যায় যায় প্যান্ডেলের আড়ালে। হাত-পা-মাথা মুড়ে, ডাল ছেঁটে প্রায় যাই-যাই অবস্থা। খাবারের দোকানের আগুন, ভিড় আর ময়লায় পার্কগুলির দমফাঁস অবস্থা। পুজো, পার্ক, প্যান্ডেল আর মানুষের ঢল কে কাকে সামলায়। সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, ভোরের শিশির এবং মাঝরাতে ঝরে পড়া শিউলি সব আড়াল হয়ে যায় মা-দুর্গার মস্ত চালচিত্রের পিছনে।
ঝলমলানির পাশেই, চরম বৈরাগ্যের মতো পুজোর এই ক’দিন পার্কগুলি যেন কাঙালের মতো চেয়ে থাকে পূজাবসানের আশায়, শীতকালের অপেক্ষায়। আলো আর কমলালেবুর পা মেলানোর আনন্দে। |
|
|
|
|
|