|
|
|
|
অশনি সংকেত |
এত জন ঠাকুর এখানে, এই অবস্থায়! মায়ের গ্ল্যামারে এই ক’টা দিন এরাও সব বস্তাচাপা পড়ে ছটফট!
এমনকী যাঁর ভয়ে সবাই সারা বছর থরহরিকম্প, সেই বাবা শনৈশ্চরও পাইপের ভেতরে সেঁধিয়েছেন! শুভময় মিত্র |
ঠিক জানতাম। চৌপাট্টি বিচেই পাব। পর পর সব পাও ভাজির স্টল। দেখি দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকার মতো জায়গায়, চাদর মুড়ি দিয়ে। না দিয়ে উপায়ও নেই। মুম্বইয়ের লোক দেখলেই চিনতে পেরে যাবে। চিনলে কেলেংকারির একশেষ। চাদরের তলা থেকে হাত বেরিয়ে আছে, প্লেটে বড়া পাও। যেই খাবে বলে শুঁড় বের করেছে, অমনি খপ করে ধরে ফেললাম ‘এই গণশা!’ এত বার বারণ করা সত্ত্বেও শোনে না। খালি বলে, ‘মুম্বইয়ের লোকই তো আমাকে রেয়াত করে।’ বললাম, ‘ঘণ্টা করে! মাথায় তুলে বাপ্পা বাপ্পা করে নেচে জলে ফেলে দেয়।’ খোঁচানোর জন্য জুড়ে দিলাম, ‘সেই জলে দাউদের তেল ভাসছে।’ চাদরের তলায় একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল মনে হল, বলল, ‘ভাল্লাগছে না, এয়ারপোর্ট চল, বাড়ি যাব।’
সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে টিকিট কেটে ফেললাম। অবশ্য এয়ারহোস্টেসগুলো আমাকে বড্ড ধরে, অটোগ্রাফ চায় যাক গে। এক বার আমাকে ঋষি কপুর ভেবে থাক গে। আড়াই ঘণ্টার মাথায় নীচে আলো দেখা গেল। তার পর বাড়িঘর, রাস্তার একটা প্যান্ডালও। গণশা বলল, ‘চ চ, নেমে যাই।’ আমরা টয়লেটের দিকে এগোলাম। তার পরে খসে গেলাম।
গঙ্গায় নেমে সুড়ুৎ করে কুমোরটুলিতে ঢুকে যাব দু’জনে, এটাই ভেবেছিলাম। অঙ্কে নিশ্চয়ই গণ্ডগোল হয়েছিল। ঝুপ ঝুপ করে নামলাম ভেড়ির ধারে। নামতেই কারা যেন হইহই করে ছুটে এল। চেঁচাতে লাগল, ‘ধর ধর, পালিয়ে না যায়, সলিড মাল দু’পিস।’ এর মধ্যে মহিলার গলাও শুনলাম মনে হল। পালাতেই পারতাম। কিন্তু ইচ্ছে হল না।
জামাকাপড় দেখেই বোঝা যায় বেশ গরিব। বয়েসও হয়েছে। মহিলা মুখের কাছে কুপি তুলে ধরে বলল, ‘ওরে অ শীতলা, এ তো দুগ্গার দুই পোলা রে।’ মাকড়সার মতো অনেকগুলো পায়ে খড়মড় করে এগিয়ে এসে এক জন বলল, ‘তা এখানে কেন বাছারা? সিট পাওনি বুঝি?’ ওদের মধ্যে কথা শুনে বুঝলাম ক্ষয়াটে চেহারার এক জনের নাম বগলা। আর এক জন, রোগা মতো চেহারা, নীল গায়ের রং। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, ‘এয়েচ যখন ঘরে চলো, তার পর হচ্চে।’ |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
ঘন ঝোপজঙ্গলের পাশে বড় বড় দু’দিক খোলা পাইপ পড়ে আছে। তার মধ্যে ভাঙা টিন, চটের বস্তা, আজেবাজে জিনিস ডাঁই করা। তার পিছনে আরও কেউ কেউ আছে মনে হল। ‘তা সরস্বতীকে দেকচি না। সে কি সিরিয়ালে নেমেচে? জামাকাপড়ের যা ছিরি করেছে আজকাল!’ ‘হবে না? ওর মা দশ হাতে কামাচ্ছে। বছরে একটা ভিজিট। মোষের মাথা মুড়িয়ে, সেখেন থেকে পালোয়ান বের করছে, টুপি থেকে খরগোশের মতো। তার পর পাবলিকের সামনে তালিবানি মার মেরে রক্ত বের করে ছাড়ছে। মহালয়ার ভোর থেকে কেত্তন গাওয়াচ্ছে হিংসার দমন নাকি এ সব। আর পাবলিক তাকে পুজো করছে, সাজাচ্ছে, আর্ট করছে, ফাইভ স্টার প্যান্ডালে রাখছে, কাঁড়ি টাকার নয়ছয়। ছি ছি ছি ধম্মের নামে এ কী অসভ্যতা! কোনও সেন্সরই নেই।’ গোপাল গোপাল বাচ্চাকে ভোলাচ্ছিল এক জন, সামলাতে পারছিল না। ‘খ্যাল এটা নিয়ে’ বলে একটা জ্যান্ত সাপ তার হাতে দিয়ে চিৎকার করে ডাকল, ‘ওগো শুনছ?’
বুঝলাম, কেউ মানুষ না, সব আমাদের স্বজাতি, স্বগোত্র। তা, এত জন ঠাকুর এখানে, এই অবস্থায়! মায়ের গ্ল্যামারে এই ক’টা দিন এরাও সব বস্তাচাপা পড়ে ছটফট! পাইপের ভেতর একটা নীল আলোর বলয় চোখে পড়ছিল। সেটা নড়ে উঠল একটু। কাটা কাটা হিস হিস শব্দ শোনা গেল, ‘কথা বলা দরকার। তোমাদের মায়ের মোবাইল নম্বরটা দাও তো।’ মা’কে লক্ষ্মী একটা মোবাইল দিতে চেয়েছিল। নেয়নি। রেগে আগুন হয়ে বলেছিল, ‘সব হাত জোড়া। ধরব কোন হাতে?’ এটা বলার সাহস হল না। নীল আলোর বলয়টা বন বন করে ঘুরছে, আগুন ছিটকোচ্ছে চার পাশে। ‘সারা বছর রাস্তার ধারে, নর্দমার পাশে, গা-জোয়ারি মন্দিরে থালা পেতে বসে থাকি। কত চোর-জোচ্চোরদের ফেলে দেওয়া পয়সা কুড়িয়ে সংসার চালাতে হয়। দু’পয়সা কামালেই পাতাখোর, গাঁজাখোরেরা সেই পয়সা ঝেঁপে দেয়। কিচ্ছু বলিনি এত দিন। কারুর দিকে কু-দৃষ্টি দিইনি। কারুর সংসারে আগুন জ্বালিনি। কিন্তু সহ্যের একটা সীমা আছে। এর শেষ দেখতে চাই, কী হল, ফোনে পাচ্ছ না বুঝি?’
গণশা এর মধ্যেই পাশের পুকুর থেকে একটা পদ্মফুল তুলে কায়দা করে সেট করে ফেলেছে হাতে, নির্বিকার মুখ। ফিস ফিস করে বলল, ‘ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগলে যা হয়! ইন্দ্রজেঠু তান্ত্রা-তে যা কাণ্ড করেছিল সেটা জানলে, হেঃ হেঃ হেঃ।’ শুঁড় চাপা দেওয়া সত্ত্বেও ফিচিত ফিচিত হাসি লিক করতে থাকল ক্রমাগত।
রেগে গেলে শনিকাকা যাচ্ছেতাই কাণ্ড করে বসতে পারে, আমি আগে শুনেছি। সত্যি বলতে কী, আমরা বছরে এক বার কৈলাস-কলকাতা ট্রিপ মেরেই খালাস, কাজ তো কিছুই করি না। ‘কার্তিক কলিং কার্তিক’ বলে একটা হিন্দি ছবির ডাব্ল রোলের আশায় আমি মুম্বই গিয়েছিলাম সেটা যদি এরা জানতে পারে, মহাপ্রলয়। আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘ঠিক আছে, বাবার সঙ্গে কথা বলছি...’ ‘বাবা? কার বাবা? শহরে যে মোচ্ছব চলছে প্যান্ডালে প্যান্ডালে, সেখানে দেখেছ কি, তোমার মায়ের মাথার ওপর থেকে শিবুদা প্পুরো ভ্যানিশ!’ আমি কিছু বলার আগে ছিটকে এল শব্দবাণ, ‘নেই, পাবে না, নরকুল উন্মত্তের মতো উৎসবের নামে দুগ্গার ষষ্ঠীপুজো করছে, অথচ আসল লোকটাই নেই। কারণ? কারণ, এই দ্যাখো, সে পড়ে আছে এইখানে!’ বলার সঙ্গে সঙ্গে চার পাশে বাজ পড়তে লাগল, চমকে উঠতে লাগল কলকাতার স্কাইলাইন। সেই আলোয় দেখি বাবা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে পাইপের এক কোণে, ত্রিশূল, কমণ্ডলু পাশে নিয়ে। কল্কেটা গড়াগড়ি খাচ্ছে আপন মনে। |
|
|
|
|
|