কাঁসিরাম-মায়াবতী আগেই করে দেখিয়েছেন। সম্প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে পশ্চিমবঙ্গেও ঢুকে পড়েছে রাজনীতির এই ধারা। চাপে পড়ে চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে তাই সিপিএমকেও তেড়েফুঁড়ে নামতে হচ্ছে এই আইডেনটিটি পলিটিক্স বা পরিচিত সত্তার রাজনীতির মোকাবিলায়। দলের শ্রমিক সংগঠনকে এ বার হাতে-কলমে নতুন ধারার কাজ শুরু করার পরামর্শ দিলেন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট।
পরিচিতি সত্তার রাজনীতি এসে শ্রমিকদের চরিত্র ভাগ করে দিচ্ছে বলে মনে করছে সিপিএম। আদিবাসী, মহিলা, দলিত, ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘুর পরিচয়ে শ্রমিকদের পরিচয় ভাগ হয়ে যাচ্ছে। তাই সিপিএমের সাধারণ সম্পাদকের পরামর্শ, শ্রমিকদের মধ্যেই আলাদা আলাদা অংশকে ধরে তাঁদের বৈষম্যের প্রতিবাদে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যা সিপিএম রাজনীতিতে একেবারেই নয়া ধারা। কারাটের সাফ কথা, যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ট্রেড ইউনিয়ন এবং সার্বিক ভাবে গোটা দলকেই বেরিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে জনগোষ্ঠীর আলাদা আলাদা অংশের জন্য পৃথক সংগঠন বা মঞ্চও তৈরি করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য ও জেলা নেতৃত্বের হাতে ‘নোট’ তুলে দিয়ে পরিচিতি সত্তার রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে এই দাওয়াইয়ের কথাই জানিয়ে দিয়েছেন কারাট। কাজও শুরু করতে বলেছেন অবিলম্বে।
বিহার, উত্তরপ্রদেশ-সহ গোটা হিন্দি বলয়ে যুগ যুগ ধরে বামেদের দুর্বল রয়ে যাওয়ার মূল কারণই ধরা হয়, বর্ণ-নির্ভর রাজনীতির সঙ্গে এঁটে উঠতে না-পারা। যদিও গরিব মানুষের সংখ্যা ওই অঞ্চলে মোটেও কম নয়। দীর্ঘদিন বাম রাজত্ব থাকলেও পশ্চিমবঙ্গেও ইদানীং পরিচিতি সত্তার রাজনীতির দাপট বুঝতে পারছে সিপিএম! বিরোধী নেত্রী থাকাকালীনই মমতা যে ভাবে মতুয়াদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, দলীয় দর্শনে আপত্তি থাকলেও তার মোকাবিলায় নামতে হয়েছিল সিপিএমকে। বিমান বসু, বৃন্দা কারাটদের মতুয়াদের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করতে হয়েছিল, গৌতম দেবকে সক্রিয় হতে হয়েছিল সরকারি স্তরে। এখন আবার মমতার সংখ্যালঘু-নীতি ধর্ম ও ভাষাগত পরিচয়ের ভিত্তিতে একই ধারার আর এক রকমের রাজনীতির জন্ম দিয়েছে বলে সিপিএম নেতৃত্ব মনে করছেন। পশ্চিমবঙ্গের ভোট-মানচিত্রে তার ছাপ পড়তে শুরু করেছে। তাই আর বিলম্ব চান না কারাট। কোঝিকোড় পার্টি কংগ্রেসের আলোচনাকেই আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বুধবার রাজ্য শিক্ষা শিবিরে দলকে ধারা বদলানোর নয়া দাওয়াই দিয়ে গিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক।
কারাটের মতে, নয়া উদারনীতির রমরমার ফলেই অভিন্ন সেই শ্রমিক শ্রেণির পরিচিতি আর নেই। বিপুল সংখ্যায় অসংগঠিত শ্রমিক তৈরি হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে দলিত, আদিবাসী, মহিলা ও মুসলিম শ্রমিকরা নানা ধরনের সামাজিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। তাঁর নোটে কারাট বলেছেন, ‘ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে একটা প্রবণতা রয়েছে শুধু শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে অর্থনৈতিক প্রশ্নে জোর দেওয়ার। এর ফলে, দলিত বা তফসিলি জাতিভুক্ত শ্রমিকরা যে বৈষম্যের মুখোমুখি হন, তা উপেক্ষিত হয়। অথচ বাস্তব হল, দলিত শ্রমিকরা একই কাজের জন্য অন্যদের চেয়ে কম মজুরি পান’। এঁদের সমস্যা নিয়ে আন্দোলনে জোর দেওয়ার কথাই বলেছেন কারাট।
একই সঙ্গে নোটে সিপিএমের শীর্ষ নেতার পরামর্শ: ‘এই অংশের মানুষের বর্তমান চেতনার স্তর মাথায় রেখে যদি এদের জন্য আমরা পৃথক সংগঠন ও মঞ্চ তৈরি করি, তা হলে তাঁদের কাছে পৌঁছতে পারব।’ শিক্ষা শিবিরে তামিলনাড়ুর অস্পৃশ্যতা-বিরোধী আন্দোলনের কথা কারাট বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছেন বলেও দলীয় সূত্রের খবর।
তা হলে কি সিপিএম-ও এ বার পুরো মাত্রায় মায়াবতীদের স্রোতে গা ভাসাবে? কারাট সতর্ক করেছেন, সত্তা-নির্ভর রাজনীতির লেজুড়-বৃত্তি চলবে না। সঙ্কীর্ণ পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে হারাতে নিজেদের পৃথক রাজনৈতিক অস্তিস্ত্ব প্রমাণ করতে হবে আলাদা আলাদা গোষ্ঠীর মানুষের দাবি-দাওয়ার পাশে দাঁড়িয়ে এবং তাঁদের নিজেদের দিকে টেনে এনেই।
কঠিন কাজ, সন্দেহ নেই! কারাট জানেন, এই করতে গিয়ে তাঁরা বাঘের পিঠে উঠে পড়তে পারেন! তাই সতর্কতাও জারি রাখতে হচ্ছে বিস্তর! |