পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদীদের প্রকাশ্য সংগঠনগুলিকে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই মদত দিচ্ছে বলে সন্দেহ করছে রাজ্য পুলিশ। মাওবাদী সমস্যা নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ডাকা বৈঠকে রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায় আজ এ কথা জানিয়েছেন। কেন্দ্রকে তাঁরা বলেছেন, সিমি-র কিছু পুরনো সদস্যের মাধ্যমে মাওবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করেছে আইএসআই। মুর্শিদাবাদ-সহ তিন-চারটি জেলায় মাওবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল তথা প্রকাশ্য সংগঠনগুলি এবং সিমি-র কিছু পুরনো সদস্য একজোট হয়েছে। রাজ্যের সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে তারা।
রাজ্যের এই অভিযোগ পেয়ে আজ নড়েচড়ে বসেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। কারণ, আইএসআই বা পাকিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে মাওবাদীদের যোগাযোগ থাকতে পারে বলে আগেও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিপোর্ট দিয়েছে। কিন্তু কোনও রাজ্যের পুলিশকর্তা সরকারি ভাবে এই প্রথম আইএসআই-এর সঙ্গে মাওবাদীদের যোগাযোগের কথা বললেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রও ছিলেন আজকের বৈঠকে।
কেন্দ্রের কাছে যা রিপোর্ট রয়েছে, সেই অনুযায়ী কিন্তু অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদী কার্যকলাপ অনেকটাই এখন নিয়ন্ত্রণে। বিশেষত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতায় আসার পরে জঙ্গলমহলের তিন জেলায় যে ভাবে উন্নয়মূলক কাজকর্ম শুরু হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর নিজে বারবার জঙ্গলমহলে গিয়ে যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, তাতে মাওবাদীরা কোণঠাসা হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছিল। সিআরপি কর্তারাও তেমনই রিপোর্ট দিয়েছেন কেন্দ্রকে। কিন্তু আজকের বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের তরফে জানানো হয়েছে, মাওবাদীরা একেবারে বসে নেই। নতুন করে সমস্যা তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। ঠিক এই কারণেই বিষয়টিকে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে নর্থ ব্লক।
কী ভাবে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে মাওবাদীরা?
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, নপরাজিতবাবু বলেছেন, সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল গোষ্ঠী এবং সিমি-র কিছু পুরনো সদস্য একই মঞ্চে এসে কাজ শুরু করেছে। কয়েকটি মুসলিম মৌলবাদী সংগঠনও এর মধ্যে জড়িত। তারা বিভিন্ন মানবাধিকার ইস্যুতে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছে। প্রকাশ্যেই সভা-সমিতি, প্রচারমূলক কাজকর্ম চালাচ্ছে তারা। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। মুর্শিদাবাদের মতো বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এবং সংখ্যালঘু অধ্যুষিত রাজ্যগুলিতেই এরা সবথেকে বেশি সক্রিয়। এই গোটা বিষয়টাতেই আইএসআই-এর হাত থাকতে পারে বলে রাজ্য পুলিশ সন্দেহ করছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, মাওবাদীদের প্রকাশ্য সংগঠনের সঙ্গে সিমি-র যোগাযোগের বিষয়টিতে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কর্তারাও সমর্থন জানিয়েছেন। মাওবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল বেশ কিছু গোষ্ঠী যে রাজ্যের মৌলবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, সে বিষয়ে তাঁরাও নিশ্চিত। এর পিছনে আইএসআই-এর মদত থাকলে, তা কোথা থেকে এবং কী ভাবে আসছে, এ বার সে বিষয়েই সামগ্রিক ভাবে তদন্তে নামতে চাইছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
নর্থ ব্লকের কর্তারা বলছেন, বিভিন্ন মাওবাদী হামলার তদন্তের ক্ষেত্রে রাজ্য পুলিশের আরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বিশেষ করে যে সব মামলায় কট্টর মাওবাদী নেতারা জড়িত, সে ক্ষেত্রে স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম (এসআইটি) তৈরি করে তদন্তে নামা যেতে পারে। আদালতে মামলার শুনানির উপরেও রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের আরও বেশি নজরদারি প্রয়োজন। স্বরাষ্ট্রসচিব রাজকুমার সিংহের সভাপতিত্বে আজকের বৈঠকে ঠিক হয়, ছত্তীসগঢ় হোক বা পশ্চিমবঙ্গ, মাওবাদীদের প্রভাব ঠেকাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন।
এ জন্য বস্তার বা সারান্ডার মতো যে সব এলাকায় এর আগে নিরাপত্তা বাহিনীর কোনও উপস্থিতিই ছিল না, সেখানে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করে এগোনোর প্রয়োজন বলে মনে করছে কেন্দ্র। এরই পাশাপাশি, ওই সব এলাকার স্থানীয় যুবকদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের জন্য শিক্ষাগত বা অন্যান্য যোগ্যতার ক্ষেত্রে ছাড় দিতে চাইছে কেন্দ্র। অরণ্যের অধিকার আইনে আদিবাসীদের পাট্টা ও অন্যান্য অধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রেও নিয়মনীতি শিথিল করার কথাও ভাবা হচ্ছে। এ বিষয়ে আদিবাসী উন্নয়ন মন্ত্রকের সঙ্গেও কথা বলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। মাওবাদীদের কবল থেকে পণবন্দি মুক্তির জন্য নতুন নীতি নিয়েও আজ রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনা করেছেন স্বরাষ্ট্রসচিব। রাজ্যগুলির আরও মতামত চাওয়া হয়েছে। মাওবাদীরা যে ভাবে গ্রামবাসীদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে, তা রুখতেও কী নীতি নেওয়া হবে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। |