...আমি জানি আজ যে রাত্তিরের অনুষ্ঠানটায় গিয়েছিলাম সেখানে আমার এক্স ক্যাপ্টেন থাকলে বাড়তি কিছুই হত না। ও কোনও কাজ করত বলেও মনে হয় না। এক কোণে দাঁড়িয়ে অতিথি আপ্যায়ন ছাড়া। বরাবরের মতো স্ত্রীর ওপর ছেড়ে দিয়ে বলত, রিঙ্কু আছে তো। ও ঠিক দেখে নেবে। রিঙ্কু মানে শর্মিলা সত্যিই অসাধারণ সংগঠক। গত বছরই এই পরিবারের আরও একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে গিয়েছিলাম। সেটা অবশ্য হয়েছিল পটৌডিতে। আমার ক্যাপ্টেনের সত্তর বছরের জন্মদিন উদযাপন। এমনিতে আমার ক্যাপ্টেনকে কখনও জন্মদিন পালন করতে দেখিনি। ড্রেসিংরুমে বহু বার ওর জন্মদিন এসেছে। পালন হয়নি যেহেতু ওর জন্মদিনেই, ৫ জানুয়ারি মারা গিয়েছিলেন সিনিয়র পটৌডি। কিন্তু সত্তর বছরেরটা দারুণ জাঁকজমক করে হয়েছিল। রিঙ্কু যে ভাবে গোটা ব্যাপারটা অর্গ্যানাইজ করেছিল আমি ভুলতে পারিনি।
সইফ আর করিনাকে দেখতে দেখতে আমার বারবার মনে হচ্ছিল আহা ও যদি থাকত! সুখের মধ্যেও একটা শূন্যতা, যেটা টের পাচ্ছিলাম সকাল থেকে। সইফকে কত ছোট দেখেছি। কাগজে কত কী লেখে, কিন্তু আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে এই বংশের ছেলেমেয়েদের মধ্যে কোথাও একটা পেডিগ্রি ভীষণ আছে। আমার ক্যাপ্টেনকেই যেমন কখনও খুব উত্তেজিত হয়ে কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে দেখিনি। ভীষণ, ভীষণ প্রাইভেট মানুষ। শুধু রিঙ্কু নয়, আমি আমার ক্যাপ্টেনের মা-কেও ভাল রকম চিনতাম। বেগমসাহেবা দারুণ ব্যক্তিত্বসম্পন্না ছিলেন। ওঁর মারা যাওয়ার খবর পেয়ে যখন আমি আমার ক্যাপ্টেনের ১ নম্বর ডুপ্লে রোডের বাংলোতে যাই, যেখানে ওরা আগে থাকত, তখন বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। আমার চোখেও অঝোরধারায় বৃষ্টি নেমেছে। ক্যাপ্টেনকে কিন্তু দেখলাম অবিচলিত। যেন কিছুই হয়নি। বললাম না, ভীষণ প্রাইভেট ছিল। আবেগ বাইরে প্রকাশই করত না। |
সইফকে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল প্রথম যখন ও করিনার সঙ্গে প্রেম করছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে, তখন এক দিন ক্যাপ্টেন আমাকে মজা করে বলেছিল, বিশ, হমারে বাচ্চে যো যো কর পা রহে হ্যায়, হম কভি কর নহি পায়ে। আমিও একচোট হাসলাম। বললাম, সত্যিই এদের পাশে তো আমরা কিছুই করতে পারিনি। দু’বন্ধুর নির্দোষ হাসি আর গল্প। আর একটা কথাও ক্যাপ্টেন বলেনি। ওর ছেলেমেয়ে মানুষ করার ভঙ্গিটাই এ রকম ছিল: এটা ওদের জীবন। নাক গলিও না। ওদের মতো করে করতে দাও। ওদের যদি তোমার প্রয়োজন হয়, একমাত্র তা হলেই ঢুকবে। যখন সইফ ঠিক করল ফিল্মে অভিনয় করবে তখনও ও কিছু বলেনি। রিঙ্কুও তাই। স্ত্রী হিসেবেই শুধু অসাধারণ নয়, খুব ভাল মা-ও। আজ বুঝি, নিজে এত বড় অ্যাচিভার হয়েও আমার বন্ধুকে ও জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যালান্স দিয়েছে। এ রকম কাপ্ল সচরাচর দেখা যায় না।
আজ রাতের অনুষ্ঠানটাতেও রিঙ্কুই ক্যাপ্টেন। আমার বন্ধু বেঁচে থাকলে খুব আনন্দের সঙ্গে ওর অধীনে খেলত। কিন্তু আমার এত লোকজনের আনাগোনা, আনন্দ-ফুর্তির মধ্যেও বারবার মনে পড়ছিল বন্ধুর কথা। বন্ধু, ক্যাপ্টেন এবং এক হিসেবে আমার জীবনের পথপ্রদর্শক! আমি যখন ভারতীয় দলে ঢুকি তার বছরখানেকের মধ্যে ওর বিয়ে হয়। পরিবারের সঙ্গে মোটেও তখন আমার অন্তরঙ্গতা ছিল না। যেটা তৈরি হল কয়েক বছর বাদে। দু’টো বিদেশ সফরে গিয়ে। ক্রিকেটপড়ুয়াদের উদ্দেশে আমি বলতে চাই আমার ক্যাপ্টেনের মতো নেতা আর ভারতীয় ক্রিকেটে আসেনি। তোমরা ভাইরা, স্ট্যাটিসটিক্স দেখে ওকে বিচার করতে যেও না। ভীষণ পজিটিভ ছিল ও। দু’টো জিনিস বুঝত। হয় জয়, নয়তো হার। ড্র বলে কোনও শব্দের কথা ভাবেইনি। ১৯৭১-এ জোড়া বিদেশ সফরে অজিত ওয়াড়েকরের টিম জেতে। আমিও তার অন্যতম সদস্য ছিলাম। কিন্তু কী করে অস্বীকার করি ওটা আমার ক্যাপ্টেনেরই গড়ে দেওয়া দল ছিল। ওরই উত্তরাধিকার। |
দাবি করব না যে ওর কাছে পুরোটা শিখতে পেরেছি। কিন্তু জীবন এবং ক্রিকেট টিম সম্পর্কে আমার মনোভাব যে ক্যাপ্টেন অনেকটা বদলে দিয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই যে লোকে বলে, ভারতীয় ক্রিকেটে প্রাদেশিক রাজনীতি নাকি সব ক্যাপ্টেনই করে এসেছে। ছ্যাঃ, আমার ক্যাপ্টেন এ সবের কয়েক হাজার মাইল উর্ধ্বে ছিল। ও-ই প্রথম ড্রেসিংরুমে বলে যে, সবাই প্রাদেশিকতার উর্ধ্বে ওঠো। ’৬৭-র অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড সফরে ও সপ্তাহে দু’টো দিন চালু করেছিল হিন্দি স্পিকিং ডে আর ইংলিশ স্পিকিং ডে। হিন্দির দিনে গোটা টিম শুধুমাত্র হিন্দিতেই কথা বলতে পারবে। আর ইংলিশের দিন শুধুমাত্র ইংলিশে বলা যাবে। আর সব স্থানীয় ভাষা তামিল, বাংলা, মরাঠি, কন্নড় সব ঘোরতর নিষিদ্ধ। আইডিয়া হল গোটা টিম এক ভাষায়, এক সুরে কথা বলবে। আমার মনে আছে হিন্দি স্পিকিং ডে নিয়ে প্রসন্ন-চন্দ্রশেখরদের সমস্যা হয়েছিল। ওদের বক্তব্য ছিল, দক্ষিণীরা হিন্দি বলতে পারে না। ওদের কেন অহেতুক জোর করা হবে? হিন্দি স্পিকিং ডে-টা রাখা হবে কি না, টিম ম্যানেজমেন্টের ভেবে দেখা উচিত। আমার ক্যাপ্টেন পাত্তাই দেয়নি। বলেছে নাথিং ডুয়িং। ইউ হ্যাভ টু থিংক ইন্ডিয়া। আর হিন্দি হল আমাদের রাষ্ট্রভাষা। আজ রাতে আনন্দের মেহফিল থেকে ফিরে মনে হচ্ছে আমার ক্যাপ্টেন সময়ের বড় আগে চলে এসেছিল। তাই ওকে অনেকে ঠিকমতো বুঝতেই পারেনি। রাতের মজলিসে প্রসন্ন বা চন্দ্রশেখরকে দেখলাম না। ওরা বোধহয় আসেনি। অংশুমান গায়কোয়াড় ছিল, যজুবেন্দ্র সিংহ ছিল। আর ছিল কপিল দেব। রাজনীতিবিদ বেশ কয়েক জনকে দেখলাম। কিন্তু ওদের দিকে বিশেষ কাউকে তাকাতে দেখলাম না। ওদের বিশ্বাসযোগ্যতা এতটাই নেমেছে। আমরা এক্স প্লেয়াররা আড্ডা মারছিলাম। ৩-৪ জন জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা রিসেপশনে তো এলাম। টাইগারের সঙ্গে আমাদের কখন দেখা হচ্ছে? তারপর নিজেরাই কয়েক জন উত্তর দিল, আর ১০-১৫ বছর। তারপর তো দেখা হচ্ছেই।
টাইগার চলে গিয়েছে এক বছরেরও সামান্য বেশি। আজ ওরই বাড়ির উৎসবে এক চূড়ান্ত আনন্দের পরিস্থিতিতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, শত আনন্দেও আমার ক্যাপ্টেনকে খোয়ানোর বেদনাটা ভুলতে পারব না...। |