অবসরের পর ভিভিএস লক্ষ্মণের প্রথম একান্ত সাক্ষাৎকার
‘যুবরাজকে আমার জায়গাটা নেওয়ার জন্য সব রকম শুভেচ্ছা’

সচিন তেন্ডুলকরকে অস্ট্রেলিয়া সরকারের দেওয়া মর্যাদাপূর্ণ খেতাব:
সচিন তেন্ডুলকরকে আমি কিন্তু ভাল রকম চিনি। তাই জানি যে সচিন স্বীকৃতির কথা ভেবে ক্রিকেট খেলে না। শুধু অস্ট্রেলিয়া কেন বিশ্বক্রিকেটে সবাই সচিনের ভক্ত। এইসব খেতাব-টেতাবে অবিচলিত থেকে বরাবর ও মনোসংযোগ করে ভারতের জন্য। অস্ট্রেলিয়ার মাঠে শেষ অস্ট্রেলিয়া সিরিজেও যখন ওকে তৈরি হতে দেখতাম, মনে হত এই বুঝি ভারতের হয়ে নতুন টেস্ট ম্যাচ খেলছে। এতটাই খিদে ও দেশের হয়ে পারফর্ম করার জন্য বাঁচিয়ে রেখেছে। সেই সচিনকে নিউজিল্যান্ড সিরিজে সমালোচনায় আক্রান্ত হতে দেখে আমার খুব বিষণ্ণ লেগেছে। যে মানুষটা নিজের শরীরের কখনও তোয়াক্কা করেনি দেশের হয়ে খেলার জন্য। দেশের হয়ে পারফর্ম করার জন্য শরীরকে সমস্ত রকম ঝুঁকির সামনে গত তেইশ বছর ধরে ফেলেছে, তার অবশ্যই এটা প্রাপ্য নয়।

যুবরাজ সিংহের কামব্যাক: অবিশ্বাস্যর চেয়েও যদি কোনও আজব শব্দ থাকে! যে দিন ও কেমোথেরাপিটেরাপি সব শেষ করে দেশে ফিরে এনসিএ-তে প্রথম প্র্যাক্টিস করতে এল, আমি যুবরাজের অ্যাটিটিউড দেখে আশ্চর্য হয়ে যাই। এই ছেলেটা এত যন্ত্রণা সহ্য করে এত নির্বিকার রয়েছে কী করে? ওর যখন ট্রিটমেন্ট চলছিল তখন আমি আর আমার স্ত্রী বার দু’য়েক আমেরিকায় ফোন করে ওর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। দু’টো জিনিস তখনই লক্ষ করি। এক, যুবরাজ ওর সেন্স অব হিউমার হারায়নি। দুই, টেস্ট খেলার মারাত্মক খিদেটা ওই অসুখের মধ্যেও জিইয়ে রেখেছে। এ বার যখন এনসিএ-তে এল, আমিও একই সঙ্গে ওখানে প্র্যাক্টিস করছি। দ্বিতীয় দিন থেকেই যুবিকে এত মরিয়া দেখাতে লাগল যে সবাই বলতে শুরু করল, ওরে একটু রিল্যাক্স কর। নিজের ওপর এত কঠোর হোস না। যা করবি একটু আস্তে-ধীরে কর। আমি বলব যুবরাজের কামব্যাকে এনসিএ ফিজিওদের একটা বড় ভূমিকা আছে। এনসিএ-তে আশিস কৌশিক নামের একজন ফিজিও আছে, যে নিজের কাজে অসম্ভব ভাল। ও যুবিকে বোঝায় যে মোটিভেটেড থাকতে হবে। কিন্তু রিল্যাক্সও করতে হবে। আশিস এবং ওর সঙ্গী ফিজিও যুবরাজকে দারুণ ফিজিক্যাল ফিটনেসে এনে দেয়। কলম্বোতে ওর কামব্যাকে তাই আশ্চর্য হইনি।
হায়দরাবাদের বাড়ির ড্রইংরুমের জন্য ভিভিএস লক্ষ্মণকে বিশেষ
উপহার দিলেন এফডি ব্লক সর্বজনীনের সংগঠকরা। ছবি: শৌভিক দে
এনসিএ-তে কয়েক দিন একসঙ্গে কাটিয়েই বুঝে যাই, এ ছেলে এ বার আরও মরিয়া হয়ে এসেছে। সে দিন আমার শহরেই ডাবল সেঞ্চুরি করেছে যুবরাজ দলীপ ট্রফিতে। আমি ম্যাচটা দেখতে যাইনি। কিন্তু সেন্ট্রাল জোন বোলারদের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল। ওরা বলছিল, লক্ষ্মণভাই, ও যা ইচ্ছে তাই করেছে। ওকে বলই করা যাচ্ছিল না। যুবরাজ হল রিদম প্লেয়ার। ছন্দের ওপর খেলে। ছন্দটা এই মুহূর্তে ওর ব্যাটিংয়ে দারুণ ভাবে রয়েছে। আমি ডাক্তারের বাড়ির ছেলে বলে যেন প্রথম দিকে একটু অবিশ্বাসই হচ্ছিল যে, কী করে পারবে যুবি? পরে ওর শারীরিক সক্ষমতা দেখে বুঝেছি বিষাক্ত টিউমার যেটা ছিল, শরীর থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। যুবরাজের কামব্যাক দেখে আমি নিজেও অসম্ভব অনুপ্রাণিত। সবাই বলছে ও অসুস্থ ক্যানসার রোগীদের অনুপ্রেরণা। আমি একমত নই। আমার মনে হয়, তাবৎ সুস্থ লোকেদেরও যুবরাজ অনুপ্রেরণা। যুবি দেখিয়ে দিয়েছে মন চাইলে যে কোনও বাধা জয় করতে পারে। ও দেখিয়ে দিয়েছে যে মাইন্ডসেটটাই আসল। আর একটা জিনিস দেখে আমার দারুণ লাগল। ওর টেস্ট খেলার খিদে। পাঁচ নম্বরে আমার ফেলে আসা জায়গাটা যুবরাজ নিলে অসম্ভব খুশিই হব। আমার বরাবর মনে হয়েছে টেস্ট পর্যায়ে সফল হওয়ার মতো ট্যালেন্ট ওর আছে। যেটা ঘাটতি ছিল, সেটা হয়তো পরিণতিবোধের। টেস্ট ম্যাচে কোন অবস্থায় কী ভাবে খেলতে হবে? কী ভাবে সময়-সময় পরিস্থিতি অনুযায়ী ঘোরাতে হবে? সেটা হয়তো ততটা ভাল রপ্ত ছিল না ওর। এই যুবরাজের সঙ্গে মিশে দেখছি সেটাও ওর মধ্যে এসে গিয়েছে। জোড়া টেস্ট সিরিজের জন্য ওকে সব রকম শুভেচ্ছা রইল।

দুর্গাপুজো ও কলকাতা:
‘কহানি’ দেখা হয়নি। তবে বিদ্যা বালনের অভিনয়ের কথা শুনেছি। শুনলাম যে আজ উনিও কলকাতায় একটা পুজো উদ্বোধন করছেন। আমার এই শহরে নামামাত্র দারুণ লাগে। শেষ এসেছিলাম প্রায় এক বছর আগে নভেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্টের জন্য। কলকাতার স্মৃতিগুলো বরাবর মনে বিঁধতেই থাকে।
এই নিয়ে পুজোর সময় আমার চার বার আসা। আমি সে দিনও আপনাদের কাগজে বলেছি শুধু প্রতিমার দিকে তাকালেই অসম্ভব একটা এনার্জি পাওয়া যায়। আমার কাছে এই এনার্জিটা ভীষণ প্রয়োজনীয়। একই কারণে যখন ইন্ডিয়ার হয়ে খেলতে আসতাম, আর আমাদের তাজ বেঙ্গলে তোলা হত, অবধারিত ভাবে কালীঘাটের মন্দির ঘুরে যেতাম। কালীঘাটের কালী মা দর্শন খুব এনার্জি দেয়।

ইডেন গার্ডেন্স ও কলকাতা দর্শক: পূর্ণ ইডেন গার্ডেন্সে খেলার চেয়ে সুখকর অভিজ্ঞতা কোথাও হয় বলে বিশ্বাস করি না। আমি কলকাতার মিষ্টি ভালবাসি। আপনাদের বাঙালি রেস্তোরাঁগুলোয় যে দারুণ নিরামিশাষী রান্নাগুলো হয়, সেগুলোও ভালবাসি। বাংলা ভাষাটা শতকরা ৭০ ভাগ বুঝতে পারি। বলতে পারি না। কিন্তু ইডেন গার্ডেন্সটা একটু বেশিই ভালবাসি। আর ইডেন গার্ডেন্স বললেই ২৮১ রানটা চলে আসে। আমি বাড়িতে যে ওই ইনিংসের ভিডিও চালিয়ে সুখস্মৃতির জাবর কাটি, এ রকম মোটেও নয়। কিন্তু যেখানেই যাই না কেন, অনিবার্য ভাবে ওটা দেখানো হয়। পিছন ফিরে মনে করতে পারি প্রথম ইনিংসে সবার শেষে আউট হয়েছিলাম। এসে প্যাড খুলছি। হঠাৎ জন রাইট এসে বলল, এই ভিভিএস তোমাকে আবার ওয়ান ডাউন যেতে হবে। আমি আজও জানি না সিদ্ধান্তটা কার ছিল। জনের না সৌরভের? ইডেনে নামলে কেন জানি না আমি সব সময় একটা পজিটিভ এনার্জি পেয়েছি। ইডেনের বাইশ গজে গেলেই মনে হত বেশ একটা আরামের জায়গায় এলাম। এই মনোভাবটা হয়তো আমায় এখানে সাহায্য করত। অস্ট্রেলিয়ানরা খুব আক্রমণাত্মক বোলিং করায় আমার স্ট্রোক প্লে-র সুবিধেই হত। আর একটা মজার কথা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না যে, ২৮১ করার রাস্তায় ওরা কিন্তু আমাকে সে ভাবে স্লেজই করেনি। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আমি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেছি। যেখানে ওরা আমায় উইকেটের পিছন থেকে প্রায় কিছুই বলেনি।

২০০১ ইডেন টেস্ট ম্যাচ: ভারতীয় ক্রিকেটে ওই টেস্টটা বোধহয় একটা মাইলস্টোন হিসেবে থেকে যাবে। এমনকী যারা ওই ইডেন ম্যাচটায় খেলেছিল, তারাও পরবর্তী কালে ওই খেলাটা নিয়ে বারবার আলোচনা করেছে। আমি দেখেছি সঙ্কটের সময় যখন হয়তো টিম ইন্ডিয়া চাপের মধ্যে, তখনও টিমের কেউ না কেউ অবধারিত প্রসঙ্গটা নিয়ে এসেছে আর বলেছে, ওই অবস্থা থেকে যদি টেস্ট ম্যাচ জিততে পারি, আজ পারব না কেন? অ্যাডিলেডে দু’বছর বাদে একই রকম অবস্থা থেকে আমরা টেস্ট ম্যাচ জিতেছিলাম। আমার আর রাহুলের ওখানেও বড় পার্টনারশিপ হয়। সে বারও রেফারেন্স পয়েন্ট ছিল ইডেন ২০০১। সঙ্কটে-বিপদেআপদে-চূড়ান্ত দুর্দশার মধ্যে ভারতীয় ক্রিকেটের নির্ভরযোগ্য মন্ত্র কিন্তু ইডেন ২০০১।

রাহুল এবং আমি: অনেকে বলে অনূর্ধ্ব উনিশে নাকি আমরা একসঙ্গে খেলতাম। সেটা ঠিক নয়। রাহুল আমার চেয়ে দু’বছরের সিনিয়র। আমি ওর সঙ্গে খেলেছি পরে। দলীপ আর দেওধরে। দারুণ ছিল আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং। ইডেনের ওই বিশেষ পার্টনারশিপ নিয়ে বলতে পারি যে, আমরা দু’জনেই যার যার নিজের খেলা খেলেছিলাম। ঠিক হয়েছিল অবশ্যম্ভাবী হেরে যাওয়াটা যত দূর রুখতে পারি। ছোট ছোট লক্ষ্য রেখে ব্যাট করছিলাম। প্রথমে একটা সেশন। তার পর আর একটা সেশন। এই ভাবে। এত লম্বা পার্টনারশিপ হবে লক্ষ্য নিয়ে মোটেই এগোইনি। রাহুলও খুব পজিটিভ মানসিকতাসম্পন্ন ছেলে। আমাদের কম্বিনেশনটা তাই বোধহয় এত ভাল হত। রাহুল টিভি বক্সে চলে এসেছে। আমিও এ বার লেখালেখির মধ্যে চলে আসব।
সেই ইডেন বলতে গেলে আর এক জনের কথাও মনে রাখা উচিত। তার নাম হরভজন সিংহ। হরভজন টিম থেকে বাদ ছিল। নাগপুরে বোর্ড প্রেসিডেন্ট একাদশের হয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে ওকে ফেরানো হয়। সেখানে বোর্ড দলটার ক্যাপ্টেন ছিলাম আমি। সৌরভ আমার কাছে জানতে চেয়েছিল, ভাজ্জি কী রকম বল করেছে। আমি বলি, দারুণ। তার পরে ও আর নির্বাচকেরা ভাজ্জিকে সমর্থন করা শুরু করে। ইডেনে শেষ দিনে ও অনবদ্য বোলিং করেছিল। লোকে ২৮১-র কথা বলে। রাহুলের কথা বলে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে ইডেন টেস্টটা ভাজ্জির জন্যও মনে রাখব।

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়: ২০০১ থেকে যে ভারতীয় দলটাকে খেলতে দেখেছি, সেটা একেবারে অন্য রকম। একে অপরের সাফল্যে আনন্দ পেত। এক জন আর এক জনকে ব্যাক করত। আমার মতে ২০০১ সেই বছর, যখন থেকে ভারতীয় ড্রেসিংরুমের চেহারাই বদলে গেল। সৌরভের সঙ্গে স্টিভের সেই সিরিজে সংঘাতের কথা অনেকেই জানেন। আমি পরে শুনি, ইডেনেও নাকি ও স্টিভকে টসের জন্য দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। আমি জানতাম ঘটনাটা ঘটেছিল ইনদওরে। তবে যেখানেই ঘটুক (হাসি), অস্ট্রেলিয়ার জন্য আমাদের ও রকম একটা ক্যাপ্টেন বোধহয় দরকার ছিল। ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয় সিরিজ শুরুর আগেই টিমটা চার্জড হয়ে গিয়েছিল। চেন্নাইতে কন্ডিশনিং ক্যাম্প হয়েছিল। আমার খুব ভাল মনে আছে, সেই ক্যাম্পের মধ্যেই স্টিভ ওয় বলে বসল যে, চূড়ান্ত সীমান্ত জয় করার জন্য ও ভারতে আসছে। আরও কিছু অবজ্ঞাসূচক কথা বলেছিল যে, আসবে আর জিতবে। পুরোটাই কিন্তু পরিকল্পিত মানসিক দাওয়াই। অস্বীকার করব না, স্টিভের বিবৃতি বোধহয় একটু চাপেও ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু তার পরের পরের দিন সকালে উঠে কাগজে দেখলাম, পাল্টা বিবৃতি দিয়েছে আমাদের ক্যাপ্টেন। স্টিভ ওয়-কে একহাত নিয়েছে। এই জিনিস কখনও দেখিনি যে, ইন্ডিয়ান ক্যাপ্টেন অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপ্টেনের ওপর পাল্টা বিবৃতি দিচ্ছে। ভাবখানা এমন, কে হে তুমি স্টিভ? সৌরভ এই কথাটা টিম মিটিংয়ে কখনও বলেনি। আমরাও আলাদা করে আলোচনা করিনি। কিন্তু আমি জানি ইন্টারভিউটা অনেকেই পড়েছিল। আর তাদের মনে হয়েছিল, সত্যিই তো! কে হে তুমি অস্ট্রেলিয়া!




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.