গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় • গুপ্তিপাড়া |
এই চত্বর একেবারে সুনসান। নিঃসঙ্গ বক এখন আকাশে ঘুরপাক খেয়ে বাসামুখী। লাল মোরামের রাস্তা ঝোপঝাড় পেরিয়ে দুর্গাবাড়ির ফটকে মিশেছে। তখন নিঃশব্দে সন্ধ্যা নামছিল দুর্গাবাড়িতে। প্রায় ফাঁকা বাড়ি। নাটমন্দিরে তুলি হাতে মগ্ন উজ্জ্বল তেওয়ারি। পরিবারের পুরোহিত। অষ্টধাতুর দুর্গাপ্রতিমার চালচিত্রে শেষ তুলির টান দিচ্ছেন। তাঁর হাতের ছোঁয়ায় দেবীমূর্তি প্রাণ পাচ্ছে। আর পাঁচটা দুর্গাপ্রতিমার থেকে একেবারেই ভিন্ন এই মূর্তি। দুর্গা সিংহের ঘাড়ে চেপে অসুর বধ করছেন। নেই দুর্গার ছেলেমেয়েরা।
বছরভর অনেকটাই ফাঁকা থাকে এ বাড়ি। কিন্তু পুজোর চারটে দিন এ তল্লাটের চৌহদ্দি পেরিয়ে দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন। প্রতিদিন হাজার লোকের পাত পড়ে। চেনা-অচেনার ভিড়ে গম-গম করে পুরো চত্বর। সরগরম থাকে নাটমন্দির। গৃহকর্ত্রী সরস্বতীদেবীর মুখ রীতিমতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পুজোর দিনগুলির বর্ণনায়। তিনি বলেন, “সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীতে মায়ের পাতে দেওয়া হয় মোট ১১ রকমের ভাজা। কচু আর মোচার ঘণ্টও থাকে। আর থাকে দুর্গা অম্বল। এটাই রীতি।”
বাড়ির একমাত্র ছেলে পুরুষোত্তম ভট্টাচার্য। তিনিই এখন পুজোর পুরো দায়-দায়িত্ব নিজে হাতে সামলান। |
তাঁর বক্তব্য, “এই পুজো আনুমানিক ৫৫৮ বছরের প্রাচীন। বংশের পূর্বপুরুষ বাসুদেব সার্বভৌম পুজোর প্রতিষ্ঠাতা। এই পুজোকে ঘিরে অনেক ইতিহাস রয়েছে।” তিনি বলেন, “রাজ্যের পর্যটন দফতরের তথ্য অনুয়ায়ী, আমাদের পুজো রাজ্যর অন্যতম প্রাচীন। সেই কারণেই পর্যটন দফতর গ্রামের পুজো দেখার যে আয়োজন করে, সেই তালিকায় স্থান পেয়েছে আমাদের পুজো। এই পুজোর টানে কলকাতা থেকে অনেকেই আসেন। তবে অন্য পুজোর থেকে একেবারে ভিন্ন পরিবেশে পুজো হয় আমাদের। রীতিমতো সাধনার পরিবেশ থাকে। কারণ, সারা বছর মাকে ডাকলেও এই চারটে দিন মাকে স্মরণ করার বিশেষ দিন।” পুরুষোত্তমবাবু নিজেই পুজো করেন। বাবা নিত্যানন্দজী মহারাজের কাছে তাঁর পুজো পাঠ শেখা। পুরুষোত্তমবাবু বলেন, “মাত্র আট বছর বয়েসে আমি পুজো করা শিখতে শুরু করি বাবার কাছে।” স্থানীয় বাসিন্দা সুব্রত মণ্ডল বলেন, “দুর্গাবাড়ির পুজোকে ঘিরে আমাদের শৈশব কেটেছে। আর পাঁচটা পুজোর জাঁকজমকের ভিড়ে দুর্গাবাড়ির পুজো একেবারেই আলাদা।”
নাটমন্দির চত্বরে প্রাচীন বেল গাছ রয়েছে। স্থানীয়দের কাছে তা ‘বোধনবৃক্ষ’ হিসেবেই পরিচিত। নাটমন্দিরের দালানে সারি সারি প্রাচীন ঘণ্টায় যেন ইতিহাসেরই অনুরণন। |