|
|
|
|
ঢাকে কাঠি... |
|
উদ্ধত উৎসবের চ্যালেঞ্জ ছুড়ছে মুম্বই
তীর্থ আচার্য • কলকাতা |
|
পুজোর ঘট পাক্কা পাঁচ কিলো। রুপোর। দুর্গার নাকে বিশাল বড় নথ, মহারাষ্ট্রের মহিলারা যেমন পরেন। হিরের। দু’কানে বিরাট বড় দুল। তা-ও হিরের। দূর থেকেও দেখলেও ঝকমক করে টিকলিটা। নিখাদ হীরক-দ্যুতি। দশপ্রহরণধারিণীর দশ আয়ুধ নিখাদ রজত-নির্মিত। অস্ত্রশস্ত্রের ওজনে আঙুল যাতে ভেঙে না-পড়ে তার জন্য লোহার কাঠি দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা। সোনা-রুপো-হিরে!
হবে নাই না কেন?
এ পুজো যে জাভেরি বাজারের স্বর্ণ-শিল্পীদের। পুজো হচ্ছে সিপি ট্যাঙ্কের কাছে মাধব বাগে। এ বার হচ্ছে ৫১ দুর্গা! জানিয়েছেন পুজো কমিটির সম্পাদক লক্ষ্মীকান্ত দাস। পুজোর চার দিন মাকে বিশেষ ফুলের মালা পরানো হয়।
সপ্তমীতে রজনীগন্ধা, অষ্টমীতে গোলাপ, নবমীতে জবার মালা, দশমীতে শিউলি।
মুম্বইয়ে শারদপ্রাতে প্রথম ঢাক বেজেছিল ১৯৩০ সালে জাভেরি বাজারের বাঙালি স্বর্ণশিল্পীদের উদ্যোগেই, কালবাদেবী সর্বজনীন দুর্গাপুজোয়। এটাই মুম্বইয়ের আদি দুর্গাপুজো। পুজোর বয়স ৮৩। প্রয়াত স্বর্ণশিল্পী বীরেশ্বর দাস এবং ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের কর্মী সঞ্জীবন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে পুজো শুরু হয়। সে সময় পুজো হতো কখনও তাড়দেওতে, কখনও ক্রস ময়দানের কাছে।
ভাল পুজো দেখতে হলে চলুন পওয়াই হিরানন্দানি গার্ডেন্স। গতবার বৃহ্ণমুম্বই পুরসভা (বিএমসি) ও মুম্বই পুলিশের বিচারে সেরা পুজোর শিরোপা পাওয়া পওয়াই-এর পুজোর এ বার সপ্তম বর্ষ। বিশাল পুজো প্রাঙ্গনে গড়ে তোলা হয়েছে একটা গোটা ‘বাংলার গ্রাম’। তার পটচিত্র-বাউল গান-লোকগীতি-নাটমঞ্চ-সহ। ‘নাটমঞ্চ’ ভাবনাটা মুম্বইয়ে এর আগে কেউ জানতই না! সাড়ে সাত হাজার বর্গমিটার পুজো প্রাঙ্গনে অন্তত ৩০টা সিসি টিভি! শতাধিক নিরাপত্তা রক্ষী পুজোর পাঁচ দিন অষ্টপ্রহর নজর রাখবেন। জানিয়েছেন পিনাকী দত্ত। অন্তত ২০ হাজার মানুষ উৎকৃষ্ট মানের ভোগ পাবেন পুজোর তিন দিন। এই খাতে খরচ হবে ১৫ লক্ষ টাকা। পুজো বাজেট? পওয়াই বেঙ্গলি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন-এর তরফে সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “অন্তত সোয়া কোটি।”
সুন্দর পুজো হয় অ্যান্টপ হিল, ওয়াডালায়। বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন-এর পুজোর এ বার ২৭ বছর। ভোগ-খাতেই খরচ ১৫ লক্ষ টাকা, জানিয়েছেন রাধানাথ বসাক। এ বার পুজো শিব-ময়। মার্কেণ্ডেয় পুরাণ থেকে ভাব ধার করে মণ্ডপ। এই পুজোয় মহিলারা বেশি সক্রিয়।
ইয়ে হ্যায় মুম্বই নগরিয়া!
দি-দা-ডু-সু! দিঘা-দার্জিলিং-ডুয়ার্স-সুন্দরবন।
এটাই এ বার এই ভারতের প্রকৃত পাঁচ তারা পুজোর ‘থিম’ হওয়ার কথা ছিল। হল না। লোখান্ডওয়ালার পুজো কর্তা অভিজিত ‘থিমের পুজো’ শব্দটাতেই ভীষণ আপত্তি জানিয়ে বলেছেন, “নানা কারণে হল না। চেয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে। হল না।”
কেন?
অভিজিৎ বলছেন, “ওটা ওদের (পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন দফতর) জিজ্ঞাসা করুন। এত ঢিলেঢালা মানসিকতা।” তবে লোখান্ডওয়ালার বিরাট মাঠটায় থাকবে বাংলার তাঁত শিল্প-হস্ত শিল্প ও ইলিশের রকমারি পদ। বাংলার ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে চাইছেন অভিজিৎ। এ বারও পুজোতে উঠে আসছে এক টুকরো ‘গড়িয়াহাট’। অভিজিতের কথায়, “গড়িয়াহাট কলকাতার অমোঘ অভিজ্ঞান!” পশ্চিমবঙ্গের প্রতি এক বুক অভিমান নিয়েও অভিজিৎ বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গের মতো সমৃদ্ধ সংস্কৃতি বিশ্বে কারও নেই। বিশ্বের সেরা পুজোয় তাকে সবার সামলে তুলে ধরব না? কলকাতা শুধু থিম
খোঁজে। আরে বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গ সংস্কৃতিকেই থিম করো না।”
বিশাল বাজেটের এই পুজো সাধারণের চাঁদার বদলে পুরোপুরিই স্পনসরশিপে হয়। বাজেট? অভিজিতের কথায়, “এটাই পৃথিবীর সেরা পুজো। যা খরচা হয় হবে। বাজেট আবার কি?” এই পুজোয় তিন দিন অন্তত ৩০ হাজার মানুষ ভোগ খান। শুধু বহরমপুর থেকে ৩৫ জন ঢাকি লোখান্ডওয়ালায় যাচ্ছেন পুজো মাতাতে। সঙ্গে সুছন্দে ধুনুচি-নৃত্য। বিশাল মণ্ডপ ‘হোয়াইট মেটাল’ দিয়ে গড়া হয়েছে। নাম করা আর্ট ডিরেক্টর বিজন দাশগুপ্ত প্রতি বার এই স্বপ্নলোক সাজান। এ বার লোখান্ডওয়ালা জুড়ে থাকবে সার্ধশর্তবর্ষে বিবেকানন্দ। বিশাল পুজো প্রাঙ্গন ‘উডেন প্যানেল’ দিয়ে তৈরি! অভিজিৎ বলেন, “আমার পুজোটাই একটা ব্র্যান্ড। এবং বিশ্বের সেরা ব্র্যান্ড মা দুর্গা।”
তবে সব থেকে বড় বাজেটের পুজোটা হচ্ছে নভি মুম্বইয়ের ভাসিতে। বেঙ্গল ট্রাস্ট-ভাসি সর্বজনিক-এর উদ্যোগে, মোতিলাল ঝুনঝুনওয়ালা কলেজের মাঠে। এটাই দেশের বৃহত্তম বাজেটের দুর্গোৎসব। ট্রাস্ট-এর কোষাধ্যক্ষ উৎপল চক্রবর্তী জানিয়েছেন, “বাজেট পাঁচ কোটি।”
২৮ ফুট উঁচু প্রতিমা। শিল্পী বিশ্বনাথ পাল। ৬২ ফুট উঁচু মণ্ডপ। যেন বেলুড় মঠটাই কলেজ মাঠে গড়েছে রাজা ডেকোরেটর। সাড়ে সাত হাজার বর্গ ফুট এলাকা জুড়ে পুজো! অন্তত আঠারোটা স্টল। মহাসপ্তমী থেকে মহানবমী--- তিন দিন এলাহি ভোগ-প্রসাদের আয়োজন। উৎপলবাবুর দাবি, “এত উঁচু মানের ভোগ-প্রসাদ আর কোনও ক্লাব বা পুজো কমিটি পরিবেশন করতে পারবে না এত ভাল মানের চাল-ডাল-সব্জি-ঘিয়ের ভোগ-প্রসাদের আয়োজন করা অন্য কোনও সংগঠনের পক্ষে সম্ভব নয়।”
নিছক পুজো নয়, উদ্ধত উৎসব। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও সবাইকে টেক্কা দিতে চাইছে বেঙ্গল ট্রাস্ট।
পঞ্চমীতেই পুজো শুরু। সন্ধ্যায় সোমলতার গান। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় সুনীধি চৌহান। সপ্তমীতে শ্রেয়া ঘোষাল। মহাষ্টমীতে সোনু নিগম। মহানবমীতে ‘মস্ত ধমাকা’! সন্ধ্যায় বিশাল মঞ্চ মাতাবেন শাহরুখ খান ও তাঁর দলবল। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান খাতে খরচ হবে দু’কোটি টাকারও বেশি, জানাচ্ছেন উৎপলবাবু।
কলকাতা, কিছু বলবে? |
|
|
|
|
|