কটক থেকে ক্যালিফোর্নিয়া— দুর্গোৎসবের ইতিহাস ঘাঁটলে এমন পাগলামির ভুরি ভুরি নজির। কলকাতা তথা বাংলার নিজভূমে তার উৎসবকে দুনিয়ার সামনে মেলে ধরতে এই বাঙালিই কিন্তু আশ্চর্য নিরুত্তাপ। এত দিনের জড়তা ভেঙে এ বার চাকাটা খানিক উল্টো দিকে ঘুরতে দেখা যাচ্ছে।
কলকাতার পুজো টানছে বিদেশি পর্যটকদের। এ-ও এক পরিবর্তন। যা লক্ষ্য করে বিভিন্ন পুজো উদ্বোধনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলছেন, “এ এক খুশির বার্তা, আনন্দের খবর। এমনকী, বাইরে থেকে ছোটরাও আসতে চায়।”
কানাডার মন্ট্রিয়েলের বণিকসভার (বোর্ড অফ ট্রেড অফ মন্ট্রিয়েল) সামনে দুর্গাপুজোকে মেলে ধরতে এক অনাবাসী বাঙালির ‘রোড শো’-র জেরে শহরে আসছেন কানাডা, ফ্রান্স-সহ ইউরোপ-আমেরিকার ২৫ জন পর্যটক। ভারত সফরের বড়সড় প্যাকেজ উপলক্ষে দুর্গাপুজোর শহরে বুড়ি ছুঁয়ে যাওয়া নয়, স্রেফ পুজোর আনন্দ চেটেপুটে উপভোগ করতেই সাত সাগর উজিয়ে এসে কলকাতায় পড়ে থাকবেন তাঁরা।
আদতে ঝাড়খণ্ডের মাইথনের ছেলে জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের এই চেষ্টায় বিদেশে কলকাতার দুর্গাপুজো নিয়ে অনেকেরই চোখ খুলছে। মার্কিন ভ্রমণরসিকদের পুজোর হাল-হদিস দিতে এই প্রথম উৎসাহ দেখাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের ইন্ডিয়া ট্যুরিজম ওভারসিজ। সংস্থার টরন্টো অফিসের মুখপাত্র সুশীলকুমার সিংহের কথায়, “বুঝতে পারছি, দুর্গাপুজো দেখতে অনেকেই ভারতে অর্থাৎ, বাংলায় আসতে চাইবেন। দুর্গাপুজোকে কেউ ভিন্দেশিদের সামনে মেলে ধরতে চাইলে তাদের সাহায্য করব।” আমেরিকা-কানাডার কয়েকটি জায়গায় দুর্গাপুজোর রোড শো কেউ আয়োজন করলে তার অর্ধেক খরচ দিতেও সায় দিয়েছে কেন্দ্রীয় পর্যটন দফতর।
রাস্তায় ভিড়ের নিরিখে ব্রাজিলের বিখ্যাত রিও কার্নিভ্যালকেও টেক্কা দেয় কলকাতার পুজো। কিন্তু ওই সময়েই শহরের হোটেলগুলি অর্ধেক ভর্তি থাকে না। কেন্দ্রের ‘ইনক্রেডিব্ল ইন্ডিয়া’-র ওয়েবসাইটেও কেরল, রাজস্থান বা পুষ্করমেলা, কুম্ভমেলা নিয়ে প্রচারের পাশে দুর্গাপুজো নেহাতই দুয়োরানি।
এতদিন দুর্গাপুজোয় বিদেশি পর্যটকদের ভিড় সাধারণত কাকতালীয় ভাবে কলকাতায় চলে আসা ‘ব্যাকপ্যাকার্স’দের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। ফলে অনাবাসী বাঙালি, ভারতীয় ছাড়া সম্পূর্ণ বিদেশিদের কোনও দল স্রেফ পুজো দেখতে কলকাতায় আসছে এমন ঘটনা এখনও বিরলতম বলেই চিহ্নিত হবে।
এ বার মন্ট্রিয়েলের দলটি ছাড়াও পুজোয় আসছে জার্মানির ১১ জন ও অস্ট্রেলিয়ার ছ’জন পর্যটক। কলকাতায় বিসর্জনের সময়ে নৌ-ভ্রমণ বা ক্রুজের তদারককারী একটি সংস্থার কর্ত্রী সুশীলা রামমূর্তি বলছেন, “দিল্লির একটি সংস্থা ও আর একটি আন্তর্জাতিক সংস্থাও কিছু বিদেশি পর্যটককে কলকাতায় আনবে। তাদের কেউ কেউ পরে ক্রুজে সুন্দরবনেও যাবেন।”
বিদেশি পর্যটকদের পূর্ব ভারতে নিয়ে আসার কাজে যুক্ত একটি সংস্থার কর্তা দেবজিৎ দত্তও মনে করেন, কুমোরটুলিতে পুজোর প্রস্তুতি থেকে শুরু করে ভাসান অবধি কলকাতার পুজো বিদেশিদের মন জয়ের একটি দারুণ ব্র্যান্ড। কিন্তু সংগঠিত ভাবে কেউ এই ব্র্যান্ড গড়ে তুলতে
সে ভাবে এগোয়নি। কেন?
বেশির ভাগ ভ্রমণসংস্থারই মত, এত ভিড়ে বিদেশিদের পুজো দেখানো প্রশাসনের সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়। কিন্তু ক’বছর আগেও রাজ্য সরকারের ভরসায় থেকে পরে ঝামেলায় পড়তে হয়েছে কোনও কোনও ভ্রমণ সংস্থাকে। এ বার ভরসা দিচ্ছে রাজ্য পর্যটন দফতর। পর্যটনমন্ত্রী রচপাল সিংহ নিজে ভ্রমণ সংস্থা ও পুজো কমিটিগুলির মধ্যে সমন্বয় রক্ষায় তৎপর হয়েছেন। পর্যটন সচিব বিক্রম সেন বলছেন, “মণ্ডপে বিদেশি পর্যটকদের ঢোকা, গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা ও বিভিন্ন স্বাচ্ছন্দ্যের দিকগুলি আমরা দেখছি। এই ধরনের সফরের আয়োজকদের পরিচয়পত্রও দেওয়া হচ্ছে।”
পুজোর এই ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ার আশ্বাসেই বুক বাঁধছেন জয়দীপ, দেবজিতেরা। |