ডিগ্রি না থাকা শিক্ষার অভাব নয়, মত ব্রাত্যর |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা মানুষরাও কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি হচ্ছেন বলে দিন কয়েক আগে আক্ষেপ করেছিলেন তৃণমূলের বর্ষীয়ান সাংসদ সৌগত রায়। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু সে দিন বলেছিলেন, ওটা সৌগতবাবুর ব্যক্তিগত মতামত। বুধবার শিক্ষামন্ত্রী জানালেন, কেউ স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন মানেই উচ্চশিক্ষিত আর যাঁর তথাকথিত ডিগ্রি নেই তিনি অর্ধশিক্ষিত এমনটা তিনি মনে করেন না।
কিছু কাল আগে ভাঙড় কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলামের বিরুদ্ধে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রতি দুর্ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছিল। অভিযোগ উঠেছিল তাঁদের হুমকি দেওয়ার। প্রসঙ্গক্রমে সেই বিতর্ক থেকেই প্রশ্ন ওঠে, কোনও ক্রমে স্কুল পেরোনো, এমনকী স্কুলের গণ্ডি না-পেরোনো লোকেদের কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি করা আদৌ উচিত কি না। সৌগতবাবু তাঁর বক্তৃতায় আরাবুলের নাম করেননি ঠিকই। কিন্তু শিক্ষাজগতের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই মনে করেছিলেন, ভাঙড় কলেজে আরাবুলের কার্যকলাপই তাঁর আক্ষেপের অন্যতম প্রধান কারণ।
বঙ্গবাসী কলেজে এক অনুষ্ঠানে বুধবার শিক্ষামন্ত্রীও এই প্রসঙ্গে কারও নাম উল্লেখ করেননি। তবে ডিগ্রি না থাকলেই কাউকে তিনি যে অর্ধশিক্ষিত মানতে রাজি নন, সে কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। সৌগতবাবুর সে দিনকার মন্তব্যই ব্রাত্যবাবুর এ দিনের বক্তব্যের নিশানা কি না, সে প্রশ্ন তাই উঠতে শুরু করেছে। নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে এ দিন নাম না করে রবীন্দ্রনাথকেই দৃষ্টান্ত হিসাবে তুলে ধরেন ব্রাত্যবাবু। তাঁর কথায়, “আমরা যাঁর লেখা পড়ে বাংলা শিখেছি, যাঁর সার্ধশতবর্ষ চলছে, সেই মানুষটাও তো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোননি কোনও দিন।”
বিশিষ্ট শিক্ষকদের অনেকেই শিক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্যে বিস্মিত। প্রবীণ শিক্ষক সুনন্দ সান্যালের আক্ষেপ, “শিক্ষামন্ত্রী তো রবীন্দ্রনাথ আর আরাবুলকে এক পংক্তিতে বসিয়ে দিলেন। এর চেয়ে বিস্ময়কর আর কী হতে পারে!” অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী বলেন, “প্রথাগত শিক্ষা ও ডিগ্রির সঙ্গে প্রকৃত শিক্ষার যোগ কতখানি, তা নিয়ে দার্শনিক স্তরে কথা হতে পারে। তবে ক্ষণজন্মা রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে যে নিয়ম খাটে, সবার ক্ষেত্রে তো তা খাটে না। তাই তাঁকে এ সব আলোচনায় টেনে না আনাই ভাল।”
|
যাঁর সার্ধশতবর্ষ চলছে,
তিনিও তো
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোননি।
ব্রাত্য বসু |
|
শিক্ষামন্ত্রী তো রবীন্দ্রনাথ আর আরাবুলকে
এক পঙক্তিতে বসিয়ে দিলেন!
সুনন্দ সান্যাল |
|
ক্ষণজন্মা রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে যে নিয়ম খাটে,
বার ক্ষেত্রে
তো তা খাটে না।
সুকান্ত চৌধুরী |
|
|
ব্রাত্যবাবু অবশ্য মনে করেন, কার শিক্ষাগত যোগ্যতা কী, সেটা বিবেচ্য নয়। দেখতে হবে, যিনি সভাপতি হচ্ছেন, কলেজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা কতটা। তিনি বলেন, “দেখতে হবে তিনি কলেজের ভিতরে রাজনীতি করছেন কি না, ক্ষুদ্র স্বার্থে কাজ করছেন কি না। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মানেই অপাংক্তেয় বা ব্রাত্য হবেন কেন!” প্রসঙ্গত, নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার অভাবের কথা স্বীকার করেও আরাবুল বিভিন্ন সময়ে দাবি করেছেন, ভাঙড় কলেজের উন্নয়নের জন্য তিনি মোটা টাকা এনেছেন, গ্রন্থাগারের উন্নতি ঘটিয়েছেন। আইআইএম-এর অধ্যাপক অনুপ সিংহ এ প্রসঙ্গে বলেন, “সাধারণ ভাবে দেখলে কথাটা খুব ভুল নয়। কিন্তু আগের সরকার সম্পর্কে তো এঁরাই রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগ তুলতেন! সিপিএমও একই যুক্তি দিত!” রাজনৈতিক ব্যক্তি যদি অপাংক্তেয় না-ই হয়, তা হলে শুধু শাসক দলের লোকেদেরই উচ্চ পদে থাকার কথা নয় বলে মনে করেন অনুপবাবু। তাঁর কথায়, “আমি দেখতে চাই, ব্রাত্যবাবু বামপন্থী উচ্চশিক্ষিত মানুষদের দায়িত্বপূর্ণ পদে বসাচ্ছেন! তা হলে ওঁর কথার যাথ্যর্থ মেনে নেব।”
সৌগতবাবুরও মতে, শিক্ষামন্ত্রীর এ দিনের মন্তব্যের মূল সুরটি নিয়ে মতপার্থক্য নেই। শিক্ষার প্রতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি আবেগ কতটা রয়েছে, এই ক্ষেত্রে সেটা খুবই বড় ব্যাপার। তিনি নিজে এই প্রসঙ্গে কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। স্কুলের গণ্ডি না পেরোনো সত্ত্বেও অতুল্যবাবুর মতো সুশিক্ষিত মানুষ তিনি খুব কম দেখেছেন বলে সৌগতবাবু জানান। তবে তাঁর মতে, সেটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। এবং রবীন্দ্রনাথ তো ব্যতিক্রমী বটেই। তিনি বলেন, “কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বড় অংশই
পিএইচ ডি ডিগ্রিধারী। আমি মনে করি এঁদের পরিচালনা করার জন্য সভাপতিদের অন্তত স্নাতক হওয়া দরকার।” ব্রাত্যবাবু এবং উচ্চশিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান সুগত মারজিতকে তিনি নিজের এই মত জানিয়েছেন বলেও এ দিন সৌগতবাবু জানান। |