|
চিরকুটে নম্বর লেখা রইল,
পড়ে নিস দিদি
ঋজু বসু • কলকাতা
|
|
নিকোনো উঠোনের তুলসীমঞ্চ, সবুজ ধানের খেত আর মেঠো পথের কিনারে বয়ে চলা ছোট্ট নদী। কালো ধোঁয়ায় ঢাকা শহরের চড়ায় সে হারিয়ে গেল।
চৌখুপি ঘরটার দেওয়ালে রিলিফ-নকশায় একদৃষ্টে সেই নদীর শুকিয়ে যাওয়া দেখছে ১০ বছরের দস্যি ছেলে। হুটোপাটি ভুলে দিদির গানের খাতায় আঁকিবুকি কাটছে।
দেশড়াবাজার সর্বজনীনের পুজোর ৫০ বছরের স্মরণিকায় ছাপা হচ্ছে রৌনিক পালের কবিতা। ‘দিদিভাই, তুই কেমন আছিস
দূর আকাশের পারে
জানিস, আমি দেখি আকাশ
রাতে বারে বারে!’
ছেলেটাকে বারবার টিভি-তে কার্টুন চ্যানেলের সামনে বসিয়ে দিচ্ছেন মা-বাবা। ও সবই দেখুক! নয়তো সারা ক্ষণ কম্পিউটারে দিদির ছবি দেখবে। দিদি জন্মদিনের কেক কাটছে। স্কুলের নীলপাড়-সাদা শাড়িতে দিদি। বাড়ির নারায়ণ মন্দিরের চন্দনের ফোঁটা কপালে দাঁড়িয়ে দিদি।
আমরা, মা-বাবার মধ্যে কেউ চলে গেলে না-হয় যা হোক কিছু বোঝানো যেত। কিন্তু পিঠোপিঠি দিদিকে নিয়ে কোন মিথ্যে সাজাই, বলুন তো! তা ছাড়া, ও তো টিভিতেই সব দেখেছে। কোতুলপুর থেকে ওর মামিমা সক্কালবেলা কাঁদতে কাঁদতে এসে টিভি খুলে দিল। ছেলেটা ঠায় বসে। “মা, খবরে বলছে হাসপাতালের আগুনে ৩০ জন মারা গিয়েছে। এই বলছে, ৭০, ৮০, ৯০...!” জয়রামবাটি, কোয়ালপাড়া থেকে লোক ভেঙে পড়েছে বাড়িটায়। ছেলেটা তবু বলছিল, “আমার দিদিভাই কিন্তু ভাল আছে, দেখো!”
জয়রামবাটির পাশের গ্রাম দেশড়ায় আলপনা আঁকা দরজা পেরিয়ে ঢুকতেই দোতলায় টেনে নিয়ে যান রিনা পাল। এই দেখুন আমার মামণির ঘর। পড়াশোনা সেরে রাতে এখানেই আমার পাশে ঘুমোত। জানলা দিয়ে টলটলে পুকুর দেখছেন! আমাদের নিজেদের। হাঁস চরছে। বলতে পারেন, খোলা মাঠ, হাঁসচরা পুকুর-ধারের মেয়ে কেন কলকাতার হাসপাতালে অন্ধকূপে দম আটকে মরবে?
বাবার মোটরবাইকের পিঠে বসেছিল মেয়েটা। ক্লাস নাইনের অ্যানুয়াল পরীক্ষার শেষ দিন। পিচরাস্তার ধারেই আমোদর। যে নদীর পাড়ে শামুক কুড়োতে যেতেন মা সারদা। নদীপাড়ের একটু আগেই ঘটল ঘটনাটা। “হাওয়ায় আঁচল সামলাতে গিয়েছিল। টাল রাখতে পারেনি। তখনও ভাবিনি, এমন বিপদ ঘটবে!” বাইক বিক্রি করে দিয়েছেন ধনঞ্জয় পাল। পুজোয় ছেলেমেয়েকে নিয়ে কোতুলপুর, জয়রামবাটি, কামারপুকুর যেতেন বাবা। মেয়ে বলত, একটা গাড়ি নাও এ বার। মা যেতে পারে না। ভাল্লাগে না!
সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ফার্মাসিস্ট ধনঞ্জয় অপরাধীর সুরে বিড়বিড় করেন, আমি তো ভালই করতে চেয়েছিলাম! আরামবাগে সিটি স্ক্যানের টেকনিশিয়ান টিফিন করতে গিয়েছিল। আধ ঘণ্টা দেরি হত। তাই অ্যাম্বুল্যান্স ডেকে কলকাতা পাড়ি দিই। যদি অপারেশন করতে হত! তখন সেই আধ ঘণ্টা দেরিই তো মারাত্মক হয়ে যেত, তাই না?
হেল্থ ডিপার্টমেন্টে কাজ করি। আমি তো পিজি-তেই প্রথমে খোঁজ করেছিলাম। বেড ছিল না। জয়রামবাটির মহারাজরা মাথার উপরে আছেন, তাই সেবাপ্রতিষ্ঠানের কথাও ভেবেছিলাম। হাসপাতালের গেটের মুখে খবর এল, সে দিন কোনও নিউরোসার্জন নেই। অ্যাম্বুল্যান্সের ছেলেটাই বলল, ঢাকুরিয়ার আমরি-র কথা। মেয়েটাকে ভর্তি করার আগেই ওরা সিটি স্ক্যান করে ফেলেছিল, জানেন! তখনও চিনতে পারিনি ওদের!
মিইয়ে যাওয়া স্বর হঠাৎ ফুঁসে ওঠে, একটা কথা বলুন তো, সিটি স্ক্যান করে আইটিইউ-তে ভর্তি করতে যেখানে এত তৎপরতা, সেখানে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা কেন কাজ করবে না? আমি রাতে ছিলাম, সব দেখেছি। নিজেদের মুখরক্ষা করতে একটি বার দমকলে খবর পর্যন্ত দিলে না। বারবার বললাম, ধোঁয়া বাড়ছে। পেশেন্টদের আগে বার করুন। হেসে বলল, পাঁচ তলায় আপনার মেয়ের কাছে আগুন পৌঁছতে ঢের দেরি। ঘাড়ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। চোখের সামনে সব শেষ। রিনা ডুকরে ওঠেন, ওর বাবা বলেছিল, আর ভয় নেই। শিগ্গির ছুটি হবে। সে দিন বিকেলেই ওর জেঠুর সঙ্গে কলকাতায় যেতাম। ঠাকুরের প্রসাদ নিয়ে। যেতে হল না! মামণির সত্যি ছুটি হয়ে গেল।
এখন ছেলেটা খালি বলবে, একা একা পড়তে ভাল লাগে না। দিদিভাই কই? মাঠের ধারে মেয়েটাকে যেখানে ওরা পুড়িয়ে এল, সেখানে গিয়ে দিদিভাইকে নিজের পরীক্ষার রেজাল্ট বলে এসেছে। কাগজে নম্বর লিখে পাথর চাপা দিয়ে এল। কোত্থেকে একটা রাখি এনে বলছে, মা তুমিই পরিয়ে দাও। আমার তো দিদিভাই নেই! পুজোর পরে ভাইফোঁটা আসবে। কেন যে আসে দিনগুলো! ভয়ে কাঁটা হয়ে আছি। আমাদের ছেলেটাকে সুস্থ রাখতে পারব তো?
দেশড়াতেই রিনার বাপের বাড়ির মস্ত পুজো। সেখানে পড়ে থাকত ভাই-বোন। হ্যাঁরে, পুজোয় কী সাজবি? জিজ্ঞেস করলে মুখ নিচু করে মেয়েটা বলত, তোমরা যেমন দেবে তেমনই হবে। কিন্তু ভাইকে নতুন জামায় সাজাত, চুল আঁচড়ে দিত। ঠিক দুগ্গা দিদির মতো।
বাড়ির কাছেই পারিবারিক শ্মশানে ধনঞ্জয় পালের মা-বাবা-কাকাদের স্মৃতিসৌধের পাশেই মেয়েকেও দাহ করা হয়েছিল। ওখানে মেয়ের স্মৃতিতে একটা মন্দির করছি জানেন। বিশে নভেম্বর ওর জন্মদিনে উদ্বোধন। কত কিছু ভালবাসত আমার মেয়ে। ইংরেজি, অঙ্ক, গান, গিটার, ছবি! ওর আঁকা সব ছবির ফ্লেক্স থাকবে। ছোট একটা মূর্তি বসবে। লেখা থাকবে, কী ভাবে মেয়েটাকে খুন করা হল।
এই রিলিফটা দেখুন, গ্রামের নদী। কুলকুল করে চলতে গিয়ে চড়ায় আটকে গেল। এই আমার মেয়ে। ১৫ বছরে পড়েছিল। বাবার গলা বুজে আসে, “যে নদী মরুপথে হয়েছে হারা...” সেই নদীর দিকে তাকিয়েই ‘দিদির ঘর’ দেখছে ভাই। কোথাও ঝড়-বৃষ্টির চিহ্ন নেই। শরতের সোনা রোদে ভেসে যাচ্ছে গোটা গ্রাম। ধানখেত, তুলসীমঞ্চ, হাঁস-চরা পুকুরের ধারে শুয়ে রৌনিকের দুগ্গা-দিদি।
বিষবাষ্পে স্তব্ধ প্রাকৃতা পাল। |