প্রবন্ধ ২...
পথে পুরুষ বিবর্জিত
মোষের পিঠে চেপে একটা দুষ্টু গুঁফো লোক পুরুষ দেবতাদের রাজ্য ছাড়া করেছিল। সেই নাকাল দেবতারা শেষে অস্ত্র দিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে স্মার্ট একটি মেয়েকে যুদ্ধে পাঠাল। মহিষাসুর মেয়েটিকে দেখে খানিক আন্ডারএস্টিমেট করল, খানিক মোহিত হল এবং শেষ অবধি যুদ্ধে হেরে মরে গেল। ছোট করে, গল্পটা তো এই। এই দুর্গতিনাশিনী, মহিষাসুরমর্দিনী দেবীর থেকে আর এক জন কিন্তু কোনও অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সে হল আটপৌরে উমা। তার দুই ছেলে, দুই মেয়ে। তাদের নিয়ে একা একা সে বাপের বাড়ি যাচ্ছে।
এমনিতে আমাদের শাস্ত্রে আছে পথে নারী বিবর্জিতা। সে তো মেয়েদের ঘরে আটকে রাখার পুরুষী চক্রান্ত মাত্র। পুরুষরা পথে নেমে নিজেদের মতো যা খুশি করবে, যেখানে খুশি যাবে, মেয়েদের সঙ্গে নেবে না কিছু বললেই বলবে, উঁহু পথে নারী বিবর্জিতা। আটপৌরে দুর্গা যেন এটাকেই অনায়াসে চ্যালেঞ্জ করছে। পুরুষদের দেওয়া অস্ত্র নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে অসুর মারতে যাওয়া নয়। নিজের মতো করে গোছগাছ সেরে ছেলেমেয়েদের বলা, চলরে চল চারটে দিন একটু দাদুর বাড়ি থেকে নিজেদের মতো ঘুরে আসি। কাজটা কিন্তু মোটেই সোজা নয়। পুরুষ বাপেদের ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব নিয়ে যেতে বললে কোথাও যেতেই চায় না। শিব তো নানা জায়গায় ঘুরে ফিরে আসে। আজ অবধি দায়িত্ব নিয়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বেড়াতে গেছে বলে মনে পড়ে না। ডোমনি পাড়ায় গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে একা একা ফ্লার্ট করতে আমাদের পুরাণের শিবের আপত্তি নেই, কিন্তু ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব নৈব নৈব চ। আর উমা! স্নেহে, বাৎসল্যে, দায়িত্বে সে অন্য গোত্রের মানুষ। অসুরনিধনের চাইতে একা একা বাপের বাড়ি যাওয়া কোনও অংশে কম কৃতিত্বের নয়।

মায়ের কাছে কোনও কোনও সেকালিনির কথা শুনেছি। তাঁরা অনেকটাই উমার মতো, তবে পুরোটা নয়। দায়িত্ব নিয়ে পথে নামতেন। যেমন মটরদি। কোনও বছর পুজোর আগে কোনও বছর পুজোর পরে মটরদি সদলে তীর্থে যেতেন। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-অনাত্মীয়ের বিশাল দল নিয়ে তাঁর সেই তীর্থযাত্রা। পাড়ায় এমনিতেই মটরদির যথেষ্ট দাপট। সন্তানের জন্ম, বিবাহ, মৃত্যু সব কিছুতেই আচার-অনুষ্ঠানে মটরদি সহায়। আর দল বেঁধে যাত্রাকালেও তিনিই দলপতি। এই মটরদিরা পথে পুরুষদের তোয়াক্কা করতেন না, তবে পুরুষদের সঙ্গে নিতেন। পাড়া থেকে যে দল যেতেন তাতে মটরদিই দলনায়ক। পাড়ার পুরুষেরা মটরদির এই দলে যেতে ভালই বাসতেন। অবশ্য সসম্ভ্রম দূরত্ব থাকত। এঁরা কেউই মটরদির সখা ছিলেন না।
আর এ কালে? গত শতকের শেষ দশকের কথা। আমরা তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছেলেবন্ধু আর মেয়েবন্ধু কথাগুলো ডেটেড হয়ে গেছে। ছেলে-মেয়েরা বন্ধু হিসেবে কথায় কথায় প্রায় সব কিছুই শেয়ার করি। আনন্দ, প্রেম, দুঃখ, বেদনা, যৌন প্রবণতা। ঈপ্সিতার সঙ্গে এস-থার্টিওয়ানের এক জন কন্ডাক্টরের খণ্ডকালীন প্রেম যেমন আলোচনার বিষয় তেমনই এক জনের রাতস্বপ্নে কী ভাবে রবীন্দ্ররচনাবলির আবডালে অনেক কনডোম পাচার হল তা নিয়েও হা-হা হি-হি হো-হো। পুজোর আগে আকাশের সাদা মেঘেরা যেই ভাসতে শুরু করল, অমনি আমরা ছেলে-মেয়ের দল পথে। সুনীল-সত্যজিতের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র মতো এ পুরুষদের ষাট-সত্তরের সদল আউটিং নয়। নব্বইয়ের দশকে দলবেঁধে ছেলে-মেয়েদের কম পয়সায় টো-টো-কোম্পানি চালু হয়ে গিয়েছিল। সেই পথ চলায় নারী বিবর্জিতা ছিল না, মোস্ট ওয়েলকাম। পুরুষ-নারীর লিঙ্গ বিভাজন প্রকট নয়। অধিকাংশ সময় ফরেস্ট বাংলোর টানা ঘরে ঢালাও বিছানায় একসঙ্গেই পাঁচ-ছ’জন বন্ধু, ছেলেমেয়ের দল নির্ভেজাল আড্ডা মারতে মারতে ঘুমিয়ে পড়তাম। সাবধানী অভিভাবকেরা অবশ্য ফরেস্ট বাংলোয় দু’টো ঘরই বুক করতে বলেছিলেন। একটা মেয়েদের, একটা ছেলেদের। ঝাড়গ্রামের কাছে সুদেষ্ণার পিসি তাই করেওছিলেন, তবে একটা ঘর ফাঁকাই পড়ে থাকত। তাতে ঘরের কিছু যেত আসত কি না কে জানে, পথিকদের কিছু যায় আসেনি। কারণ পুরাণকাল, সেকাল, এমনকী ষাট-সত্তরের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র কাল ডিঙিয়ে তখন সেই নব্বইয়ের দশকে ছেলেমেয়েরা পথে এক সঙ্গে নিজেদের মতো করে চলার শিক্ষা নিতে চাইছে। সখা হতে চাইছে, তবু বোধহয় ছেলেদের খবরদারি করার স্বভাব যাই যাই করেও যায় না। কয়লা শত ধুলেও কি চট করে ময়লা যায়!
ইদানীং দেখলাম শরতের মেঘে মেঘে মেয়েরা দলে দঙ্গলে একা একাই পথে। ছেলেদের সঙ্গে নেয়নি, বেশ করেছে। অমৃতা আর সংঘমিত্রা দু’জনের দলে কিছু দিন আগেই গিয়েছিল সুনতালিখোলা। ট্রেনে পারিবারিক যাত্রীরা মেয়ে দু’টিকে একা একসঙ্গে যেতে দেখে তো চোখ কপালে! এই ২০১২’তেও একটু বেশি বয়সের মেয়েদের একসঙ্গে একা যাওয়া তা-ও মেনে নেওয়া যায়, তা বলে বিয়ে-থা হয়নি, চুল পাকেনি, চামড়া ঝোলেনি তোরা দু’টিতে কেন বাপু একা! পারিবারিকেরা সন্দেহের চোখে আড়ে আড়ে চায়। মেয়ে দু’টি হেসে কুটিপাটি। সাহস করে তারা আবার দল পাকাল বড় করে। প্রায় বসন্তে উত্তরবঙ্গের পর শরৎ পড়তেই এ বার ব্রাহ্মণী নদীতীরে রামপুরহাটের কাছে। শালবনে রোদ খেলছে, নদীতীরে ছায়া নাচছে। কম রেস্ত নিয়ে বনানী, সুস্মিতা, স্বয়ংসিদ্ধা আর ওরা দু’জন। গাঁ-গঞ্জের লোক ইরি-মিরি-কিরি করে উঠছে। কিছু বলতেও পারছে না মুখ ফুটে, চোখ দিয়ে বলছে।
যাক গে যাক, ওদের পা লম্বা হচ্ছে, এ বার নাকি দেশের বাইরে যাবে। আসছে বছর চল পানসি বাংলাদেশ। পুরুষেরা নট অ্যালাউড।

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.