প্রবন্ধ ১...
১৯৬২: ভারতীয় ‘কূট’নীতির যাত্রা শুরু
চিন। শব্দটা উচ্চারণ করলেই দুই ধরনের অনুভূতির ঢেউ ওঠে আমাদের। দুশ্চিন্তা, আশঙ্কা, সন্দেহ। নয়তো বিরক্তি, ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ। চিন বলতেই মনে হয়, চিনা অনুপ্রবেশ (কে জানে চুপিসাড়ে কী কী দখল করে ফেলছে ওরা!), চিনা পাড়া (নোংরা, দুর্গন্ধ, অস্বাস্থ্যকর, শহুরে মালিন্যের সেরা নিদর্শন), কিংবা চিনা জিনিস (দামে শস্তা, কাজে চটপট, আয়ু সাত দিন)। চিনা খাবারই একমাত্র ব্যতিক্রম। তা ছাড়া আর যা কিছু বস্তু বা বিষয়ের সঙ্গে ‘চিনা’ বিশেষণ যুক্ত হয়ে থাকে, সবই অসুবিধেজনক, নিম্নমানের, অথবা উচ্চমানের হলেও কোনও না কোনও কারণে অতীব নিন্দাযোগ্য। ভারতের এই চিন-দর্শনের মধ্যে একটা আশ্চর্য জাতীয় ঐক্য রয়েছে, গোটা দেশ জুড়ে একই আবেগের অদ্ভুত সমতা। আর, যে কোনও জাতীয় ঐক্যের পিছনে স্বভাবতই আছে জাতীয় প্রোপাগ্যান্ডা। ভারতীয় রাষ্ট্র কয়েক দশক ধরে লাগাতার এই চিন-প্রোপাগ্যান্ডা চালিয়ে আসছে। তবে এর গোড়াটা সম্ভবত লুকিয়ে পঞ্চাশ বছর আগের সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধটির মধ্যেই, যখন নেহরুর ভারতের নাকটি হিমালয়ে ঘষে দিয়েছিল চিন।
১৯৬২ সালের ২০ অক্টোবর শান্তিবাদী, মিত্রতামনস্ক নেহরু বিনা মেঘে বাজের মতো চিনা আগ্রাসনের খবর পেয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন; ভারতীয় বাহিনীর প্রাণপণ আত্মরক্ষার চেষ্টা সত্ত্বেও চিনের অন্যায় অগ্র-অভিযান থামানো গেল না; শেষে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে একতরফা যুদ্ধসমাপ্তি ঘোষণা করে চিন প্রত্যাবর্তন করল; ভারত ধনেপ্রাণে রক্ষা পেল।— এই হল সেই যুদ্ধের জাতীয়তাবাদী ব্যাখ্যা। স্বভাবতই চিন নামক মহা-জুজুর উৎসসন্ধানে এই ব্যাখ্যার ভূমিকা বিরাট।

দুঃস্বপ্নদ্রষ্টা? জওহরলাল নেহরু ও তাঁর বিদেশমন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণ মেনন। ছবি: পি টি আই
পরবর্তী কালে চিন-ভারত যুদ্ধের এক অন্য ব্যাখ্যাও অবশ্য পেয়েছি আমরা। সেই ব্যাখ্যা অনুযায়ী: চিন নয়, ম্যাকমেহন লাইনের উত্তরে ভারতই সে দিন আগ্রাসনকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল, একের পর এক ‘পোস্ট’ তৈরির দুঃসাহস দেখিয়েছিল, দাবি তুলছিল যে থাগ-লা পর্বতশ্রেণি অবধি সমস্ত অঞ্চলই নাকি তার অধীন। বারংবার হুঁশিয়ারি দেওয়া সত্ত্বেও কাজ না হওয়ায় চিন সিদ্ধান্ত নেয়, যুদ্ধই একমাত্র শিক্ষা। বেশ কিছুটা শিক্ষা দেওয়া হয়ে গেলে চিন নিজেই যুদ্ধ শেষ করে দেয়। যুদ্ধশেষের সিদ্ধান্তের ‘অজ্ঞাত কারণ’ এটাই।
নেভিল ম্যাক্সওয়েল-এর ‘ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়র’ বইতে ১৯৭২ সালেই এই তত্ত্ব পড়া যায়। তাঁর বিশ্লেষণে বেশ আতিশয্য থাকলেও মূল বক্তব্যে সন্দেহ করা মুশকিল, কেননা ভারত থেকেও, এমনকী ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিজস্ব বৃত্তের মধ্য থেকেও, এই ধরনের অভিযোগ ইতিমধ্যে শোনা গেছে। ব্রিগেডিয়ার জে পি ডালভি লিখেছিলেন ‘হিমালয়ান ব্লান্ডার: দ্য কার্টেন রেজার টু দ্য সাইনো-ইন্ডিয়ান ওয়ার অব ১৯৬২’ এবং ডি আর মানকেকর লিখেছিলেন ‘দ্য গিলটি মেন অব ১৯৬২’। এগুলি থেকে আমরা জানতে পারি, কী ভাবে উঁচু মহলের প্রত্যক্ষ নির্দেশের অপেক্ষা না করে, এবং সীমান্ত-অঞ্চলগুলিতে যে অফিসাররা আছেন, তাঁদের নিষেধের তোয়াক্কা না করে দিল্লির প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ছোট অফিসাররাই ম্যাকমেহন লাইন-বরাবর ধোলা বা খিনজামেনের মতো বেশ কিছু জায়গায় ‘ফরওয়ার্ড পোস্টিং’-এর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতেন। এই সেই বহুনিন্দিত ‘ফরওয়ার্ড পলিসি’, দিল্লিতে যার কোড-নাম ছিল ‘অপারেশন লেগহর্ন’। যা-ই হোক, এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী ভারত বা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরু, কাউকেই ঠিক ধোওয়া তুলসীপাতা বলা যায় না।
৯৬২-র যুদ্ধের এই যে দুই পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যা, এদের মধ্যে কিন্তু একটা মিলের জায়গাও আছে। দুই তত্ত্বেরই ইঙ্গিত: প্রধানমন্ত্রী নেহরু ও বিদেশমন্ত্রী কৃষ্ণ মেননের কোনও ধারণাই ছিল না যে চিন সত্যি ভারতকে আক্রমণ করতে পারে! প্রথম ব্যাখ্যাটির মধ্যে তো তাঁদের এই অজ্ঞানতা, অনবধানতারই করুণ ছবি। দ্বিতীয় ব্যাখ্যা থেকেও বোঝা যায় যে, ভারতের ফরওয়ার্ড পলিসি সত্ত্বেও সমাজতন্ত্রের ‘চির-উন্নত শির’ চিনা রিপাবলিক আসলে কোনও ভাবেই সামরিক আক্রমণ চালাবে না এই ছিল নেহরুদের অটল বিশ্বাস। অজ্ঞানতানির্ভর বিশ্বাস। অর্থাৎ যুদ্ধের যে ব্যাখ্যাই মানি না কেন, নেহরু সরকারের মধুর অজ্ঞানতা, পেশাদারিত্বের অভাব, বাস্তববোধের চূড়ান্ত অনুপস্থিতির বিষয়টা অনস্বীকার্য। কার সঙ্গে খেলা সেটা বিন্দুমাত্র না জেনেবুঝেই মাঠে নেমে নিতান্ত বেকুব বনে যাওয়ার এই দৃষ্টান্ত সম্ভবত স্বাধীন ভারতের কূটনীতির ইতিহাসে বৃহত্তম কলঙ্ক।
অজ্ঞানতার ফলে যে বিরাট মূল্য দিতে হয়েছিল ১৯৬২ সালে, সেটার একটা দীর্ঘস্থায়ী ছাপ আছে ভারতের বিদেশ-চিন্তায়। আর সেই জন্যই অর্ধশতক পরেও ১৯৬২ আমাদের কাছে এত প্রাসঙ্গিক। এই ধাক্কার পর থেকেই আমাদের বিদেশনীতি ক্রমে সাবালক হতে শুরু করল, মাধুর্য ও অজ্ঞানতার জায়গায় সন্তর্পণে প্রবেশ করল কূটনৈতিক রিয়েলিজম, যে রিয়েলিজম ছাড়া রিয়েলপলিটিক অসম্ভব। এই পঞ্চাশ বছরে ভারত অনেক আত্মপ্রত্যয়ী হয়েছে, কূটনীতিতে মেনন-যুগের ভাবালুতা কাটিয়ে কড়া বাস্তববাদিতার ছাপ পড়েছে। পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, মায়ানমার, বহু দেশের সঙ্গেই ভারতের সম্পর্কে এই নতুন বাস্তববাদিতা লক্ষ করা যায়। এত বড় পরিবর্তন রাতারাতি ঘটে না, কিন্তু তবু যদি এর কোনও সূচনাবিন্দু খুঁজতে চাই আমরা, ১৯৬২-ই হবে প্রথম দাবিদার। মজা এটাই যে, ভারতের কূটনীতিতে এই নতুন বাস্তববাদিতার মধ্যেও কিছু ক্ষেত্রে তার সমস্যাদীর্ণ ‘ব্লাইন্ড স্পট’ রয়েই গিয়েছে। তার মধ্যে প্রধান ক্ষেত্র চিন স্বয়ং।
এই অর্ধশতকেই বিশ্বমঞ্চের পালাবদলের মধ্যে চুপিসাড়ে দুনিয়া-পিরামিডের শীর্ষে উঠে এসেছে চিন। এখন এশিয়া ও আফ্রিকার নানা অংশে আমেরিকার চেয়েও বেশি তার প্রতাপ। বহু দেশের সঙ্গে তার গোপন দৃঢ় বোঝাপড়া, যে তালিকায় একটি নাম: পাকিস্তান। পরিস্থিতি সব মিলিয়ে যে রকম, তাতে ভারতের চোখে চিন যেমন সর্বদা-সন্দেহযোগ্য কু-শক্তি, তেমনই ভারতীয় রাষ্ট্রের মনোভূমিতে চিনই আবার অবিসংবাদী নায়ক এবং মডেল, যার মতো হয়ে উঠতে-পারাই প্রত্যহ তার নিভৃত উচ্চাকাঙ্ক্ষা। চিনকে সে ভয় করে, সন্দেহ করে, আবার চিনই তাকে স্বপ্ন দেখায়। রাষ্ট্রমানসের এই অদ্ভুত টানাপড়েনের জটিল মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবেই হয়তো চিনের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কেই ভারত এখনও সবচেয়ে অ-যুক্তিপ্রবণ থেকে গিয়েছে। ১৯৬২ ভারতকে অনেকটা সাবালক করে দিলেও চিনের ক্ষেত্রেই ভারতের কূটনীতি ভারী নাবালক হয়ে আছে আজও।
ই নাবালকপনার জন্যই চিনের প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার সঙ্গে কী ভাবে এঁটে ওঠা যায়, সেটা আজও বুঝতে পারে না দিল্লি, আর বুঝতে না পেরে অভিযোগের ঘ্যানঘ্যানানি চালিয়ে যায়। বেজিং সুচতুর ভাবে বৃত্তাকারে প্রতিপত্তি ছড়িয়ে ভারতকে কোণঠাসা করছে, এই একটি অভিযোগ। বেজিং ইসলামাবাদকে নানা ভাবে মদত দিয়ে চলেছে, এই আর একটি অভিযোগ। কিন্তু অভিযোগ তুলে কি সমস্যার নিষ্পত্তি হয়? দরকার তো পাল্টা স্ট্র্যাটেজি, যে স্ট্র্যাটেজির একটি দিক অন্যত্র ভারতীয় প্রভাব বিস্তারের প্রয়াস, আর অন্য দিকটি চিনের সঙ্গে বন্ধুত্বমূলক আদানপ্রদানের সম্পর্ক। কোনওটাই কি দিল্লি করে উঠতে পারছে, এখনও?
চিনের সঙ্গে আদানপ্রদানের সম্পর্ক তৈরি করতে গেলে আঞ্চলিক দাবি-প্রতিদাবিগুলিই প্রথমে সমাধান করা দরকার: ভারতের প্রধান সংকটটা সেখানেই। মূল দুটি বিতর্কিত অঞ্চল পূর্বে অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াং এবং উত্তরে আকসাই চিন। দুটি নিয়েই ভারতের ভাবা দরকার, ‘চিনা অনুপ্রবেশ’-এর প্রোপাগ্যান্ডার বাইরে আর কী কী পথ খোলা আছে। একটি পথ কিন্তু চোখে পড়ে সহজেই। আকসাই চিনের দাবি ছেড়ে দিয়ে অরুণাচলের দাবি আদায় করা। এই ‘আদানপ্রদান’টিতে তাদের সম্মতি আছে, এমন ইঙ্গিত বেশ কয়েক বারই দিয়েছে চিন। তবে কেন সেই সম্মতির জায়গাটাতে এগোনো যায় না? কেন আকসাই চিনের মতো একটি অতি-দুর্গম, মনুষ্যবিহীন, চিন-প্রভাবস্নাত অঞ্চল নিয়ে এতখানি উদ্গ্রীবতা ছেড়ে দিয়ে বরং অরুণাচলের অধিবাসীদের নিষ্কণ্টক নাগরিকত্ব দেওয়া ও চিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বাড়ানোর কাজটা করা যায় না? আকসাই চিনের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানের প্রশ্নটি উঠে আসবে এখানে, কিন্তু সেই প্রশ্নও কি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে না যদি বেজিং-এর সঙ্গে সুসম্পর্ক আরও একটু বেশি দূর বিস্তৃত হয়? অতিরিক্ত আদর্শবাদিতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে সেই সুসম্পর্কের পথে তিব্বত কাঁটাটাকেও সরানো দরকার, ঠিক যেমন মায়ানমারের ক্ষেত্রে আদর্শ বনাম বাস্তববোধের লড়াইয়ে দিল্লিকে দ্বিতীয়টিকেই বেছে নিতে দেখেছি আমরা।
অরুণাচল প্রদেশের সীমারেখা নিশ্চিত করার বিষয়েও আসে আর এক প্রশ্ন: ম্যাকমেহন লাইনের প্রশ্ন। ভারত কিন্তু বড্ডই আবেগপ্রবণ এই লাইন নিয়ে। অকারণেই। উপনিবেশের প্রভুদের স্থির করে দেওয়া রেখাটির যে কোনও বিরাট মাহাত্ম্য নেই, তার চেয়ে বরং চিনের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসে খোলা মনে নতুন সীমান্ত নির্ধারণই উচিত কাজ, দিল্লিকে এই বার্তা অনেকেই দিয়েছেন, দিল্লি কান বন্ধ রেখেছে। অথচ কূটনীতির খেলায় ছোট ছোট জেদ ছেড়ে দিলে অনেক সময় বড় বড় লাভ মেলে। ম্যাকমেহন লাইন ঠিক সেই রকম একটা ছোট জেদ, যা চিন-ভারত সুসম্পর্কের বড় লক্ষ্যটাকে ধোঁয়াটে করে দিচ্ছে।
‘আলোচনার টেবিল’-এর প্রসঙ্গটা যখন এলই, তখন একটা জরুরি কথা দিয়েই শেষ করা যাক। ১৯৬২-র শিক্ষা কিন্তু এই নয় যে, নিজেকে সামরিক দিক দিয়ে চিনের চেয়ে দুর্বল জেনেও সামরিক সংঘর্ষের পথ বন্ধ করতে পারেনি ভারত। ১৯৬২-র আর একটা গুরুতর বার্তা আছে। সেটা হল, আলাপ-আলোচনার কূটনীতিতে ভারত প্রকৃতিগত ভাবেই অত্যন্ত দুর্বল, প্রায় রুগ্ণ বলা চলে। বেজিং-এর সঙ্গে মত বিনিময় বা পারস্পরিক সমঝোতা তৈরির কত সুযোগ যে ভারত তখন হেলায় হারিয়েছে, ভাবলেও কাঁটা হতে হয়। সেই ট্র্যাডিশন-এর বহু ছাপ কিন্তু এখনও দিল্লির ব্যবহারে প্রকট। চিনের সঙ্গে টেবিলে বসে সমস্যা মেটাতে না পারা সেই রুগ্ণতারই লক্ষণ।
অর্ধশতক পুরোল। আমাদের জাতীয় কূটনীতির রোগ কিন্তু পুরো সারল না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.