|
|
|
|
রেল দুর্ঘটনা এড়ানোর নতুন দিশারি এক বাঙালি |
সঙ্গীতা ঘোষ • কলকাতা |
ট্রেনে ট্রেনে ধাক্কা এড়ানোর নিখুঁততর প্রযুক্তির দিশা দিচ্ছে বাঙালি মগজ।
সাঁইথিয়ায় একই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা উত্তরাঞ্চল এক্সপ্রেস পিছন থেকে ধাক্কা মেরেছিল বনাঞ্চল এক্সপ্রেসকে। প্রাণ গিয়েছিল ৭২ জন যাত্রীর। তার ঠিক দু’মাস আগে সরডিহার জ্ঞানেশ্বরী দুর্ঘটনা। তারও আগে কখনও ফিরোজাবাদ, কখনও গাইসাল। ভারতীয় রেলের ইতিহাসের এই সব ক’টি দুর্ঘটনাতেই কখনও দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের পিছনে এসে ধাক্কা মেরেছে অন্য ট্রেন, কখনও ধাক্কা হয়েছে মুখোমুখি। জ্ঞানেশ্বরী যেমন বেলাইন হয়ে পাশের লাইনে গিয়ে পড়ার পর তাতে আছড়ে পড়েছিল মালগাড়ি। জিপিএস স্যাটেলাইট-ভিত্তিক অ্যান্টি-কলিশন ডিভাইসের সাহায্যে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো নিয়ে প্রচুর কথা হলেও তার যথাযথ প্রয়োগ বা সাফল্য নিয়ে এখনও প্রশ্ন রয়েছে।
এই অবস্থায় তথ্যগত ভাবে আরও নিখুঁত ও কার্যকরী সুরক্ষা ব্যবস্থা হয়ে উঠতে চলেছে ‘টিকাস’ অর্থাৎ ‘ট্রেন কলিশন অ্যাভয়ড্যান্স সিস্টেম’। টিকাস-এর প্রধান কারিগর, দক্ষিণ কলকাতার বাঙালি ইন্দ্রনীল মজুমদার তেমনই বলছেন। এই ব্যবস্থায় ইঞ্জিনে বসানো রেডিও আর লাইনে বা সিগন্যালে বসানো অজস্র সেন্সরের সাহায্যে ট্রেনগুলো যেন নিজেরাই পরস্পরের অবস্থান জানতে জানতে এগিয়ে যাবে। দু’টি ট্রেন এক লাইনে মুখোমুখি বা আগে-পিছনে এসে পড়লে নিজে থেকেই থেমে যাবে তারা। হ্যাঁ, চালক ঘুমিয়ে পড়লেও। |
|
মহড়ার সময় ‘টিকাস’-এর প্রধান কারিগর ইন্দ্রনীল মজুমদার। —নিজস্ব চিত্র |
হায়দরাবাদ থেকে দেড়শো কিলোমিটার দূরে নওয়াঙ্গডি ও মানকাট্টি স্টেশনের মাঝের রেললাইনে মঙ্গলবার সফল মহড়া হয়েছে টিকাস-এর। হাজির ছিলেন রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান বিনয় মিত্তল, ইলেকট্রিক্যাল বিভাগের সদস্য কুলভূষণ, আরডিএসও (লখনউ)-এর প্রধান ভি রামচন্দ্রন।
রেল বোর্ডের এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর (তথ্য) চন্দ্রলেখা মুখোপাধ্যায় বলেন, “অ্যান্টি-কলিশন ডিভাইসের চেয়েও এই প্রযুক্তি অনেক উন্নত। এটি রেলেরই প্রযুক্তি সংক্রান্ত গবেষণার ফসল। এতে অনেকেরই সাহায্য রয়েছে। পরীক্ষাও সফল হয়েছে।”
এই প্রযুক্তির আদি সংস্করণের নাম ‘রেলওয়ে
কলিশন অ্যাভয়ড্যান্স সিস্টেম’ বা ‘রাকাস’। সেটি ইন্দ্রনীলের আবিষ্কার। রেলের গবেষণা শাখা আরডিএসও (লখনউ) এবং হায়দরাবাদ ব্যাটারিজ লিমিটেড (এইচবিএল)-এর প্রধান সহযোগিতায় রাকাস-কে ঘষেমেজে আরও শক্তিশালী করে তোলেন ইন্দ্রনীল। সেই উন্নততর সংস্করণই হল টিকাস।
কী ভাবে কাজ করে এই ব্যবস্থা?
সোজা কথায়, এর মূলে রয়েছে ইঞ্জিনে বসানো কম্পিউটার ও রেডিও এবং লাইনে বসানো সেন্সর। দু’টি স্টেশনের মাঝখানে প্রতি এক কিলোমিটার অন্তর লাইনে ও প্রতিটি সিগন্যালে লাগানো হবে ওই সেন্সর। এক কিলোমিটার অন্তর ট্রেন ওই সেন্সরের মাধ্যমে নিজের অবস্থান ‘আপগ্রেড’ করতে করতে এগিয়ে যাবে। স্টেশনে ঢোকার সাড়ে চার কিলোমিটার আগে ট্রেন নিজেই বুঝে যাবে সিগন্যালিং। এমনকী চালক যদি ঘুমিয়ে পড়েন, ট্রেনের সামনে লাল সিগন্যাল থাকলে প্রথমে ইঞ্জিনে বসানো ‘অডিও বাজার’ ও ‘ভিজুয়াল ডিসপ্লে’র মাধ্যমে তাঁকে সতর্ক করার চেষ্টা করা হবে। এই ব্যবস্থাটা চলবে পাঁচ সেকেন্ড। তাতেও যদি কাজ না হয়, তখন আপনা-আপনিই থেমে যাবে ট্রেন।
এ তো গেল সিগন্যালের কথা। এ ছাড়াও লাইনে বসানো সেন্সরগুলি ট্রেনের ইঞ্জিনকে লাগাতার জানাতে থাকবে, তার সামনে-পিছনে অন্য কোনও ট্রেন আছে কি না। এক ট্রেনের উপস্থিতির সঙ্কেত পেলেই সেন্সর তা জানিয়ে দেবে আগুয়ান অন্য ট্রেনকে। সেন্সরের মাধ্যমে যেন কথা বলতে বলতে এগোবে সমস্ত ট্রেন।
এ সব যাঁর মাথা থেকে বেরিয়েছে, সেই ইন্দ্রনীল সেপ্টেম্বরের গোড়া থেকেই নাওয়া-খাওয়া ভুলে দলবল নিয়ে কার্যত রেললাইনেই পড়ে ছিলেন। ম্যান্ডেভিল গার্ডেন্সের বাসিন্দার লক্ষ্য একটাই রেল দুর্ঘটনা রুখতে কিছু করতেই হবে। ফিরোজাবাদের রেল দুর্ঘটনায় মৃতদের মধ্যে তাঁর এক বোনও ছিলেন। ইন্দ্রনীলের কথায়, “কষ্টটা সারাক্ষণই বুকের ভিতর তোলপাড় করত। তাই লড়ে গিয়েছি।”
২০০১ সালেই রাকাস-এর নকশা তৈরি করে দেশ-বিদেশের প্রায় সমস্ত সংবাদপত্রের শিরোনামে এসেছিলেন ইন্দ্রনীল। ওই বছরেই পেয়েছিলেন ‘টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস অ্যানালগ ডিজাইন চ্যালেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড’। যার মূল্য এক লক্ষ ডলার।
আক্ষরিক অর্থে লক্ষ্যে পৌঁছতে অবশ্য লেগে গেল আরও এগারোটা বছর। ২০০৯-এ এইচবিএল-এর প্রধান এ জে প্রসাদের কাছ থেকে প্রথম ডাক পান ইন্দ্রনীল। তাঁর সাহায্যে এবং আরডিএসও (লখনউ)-এর সহায়তায় আরও কার্যকরী করে তোলেন নিজের আবিষ্কারকে। সিগন্যালিংয়ে যাবতীয় সাহায্য করেছিল রেল। তার পর? দেবীপক্ষের শুরুতেই প্রথম পরীক্ষাটা উতরে গেল টিকাস। এখন শুরু অপেক্ষা। এক দিন সত্যিই হয়তো রেল সফরের আকাশে থাকবে না দুঃস্বপ্নের কোনও মেঘ। |
|
|
|
|
|