প্রকল্প রয়েছে। কিন্তু তার কোনও প্রচার নেই। তাই আজও জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গ্রামে অধিকাংশ বাড়িতেই প্রাচীন পদ্ধতিতে প্রসব করান দাইরা। স্বভাবতই প্রসবকালীন মৃত্যুর হারও আর পাঁচটা জায়গার তুলনায় বেশি জঙ্গলমহলে। প্রসূতিদের সচেতন করতে তাই পুজোর মরসুমে জঙ্গলমহলের গ্রামে গ্রামে ‘জননী সুরক্ষা যোজনা ও জননী শিশু সুরক্ষা কার্যক্রমে’র প্রচার করছে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক। মাধ্যম পথনাটিকা। যদিও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির হাল না ফিরিয়ে শুধুমাত্র এই প্রচারে কতটা কাজ দেবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।
দারিদ্রসীমার নীচে থাকা প্রসূতিদের জন্য জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের আওতায় ‘জননী সুরক্ষা যোজনা ও জননী শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম’ প্রকল্প রয়েছে কেন্দ্রের। প্রথম দু’টি সন্তানের জন্মের সময় প্রসূতিকে পাঁচশো টাকা করে দেওয়া হয়। প্রসবকালীন যাতায়াতের খরচও সরকার বহন করে। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিপিএল তালিকাভুক্ত মায়েদের বিনামূল্যে চিকিৎসা হয়। চিকিৎসকদের মতে, প্রসবকালীন অবস্থায় অন্তত তিন বার স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরি। গর্ভাবস্থায় টিটেনাসের টিকা নেওয়া ও কমপক্ষে একশোটি আয়রন-ফোলিক অ্যাসিডের বড়ি খাওয়াও জরুরি। অথচ জঙ্গলমহলের আদিবাসী ও অনগ্রসর সম্প্রদায় অধ্যুষিত গ্রামের বাসিন্দা প্রকল্পের কথা জানেন না।
তাই প্রচারে সহজবোধ্য পথনাটিকাকেই বেছে নিয়েছে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক। দফতরের মেদিনীপুর শাখার আধিকারিক সুদীপ্ত বিশ্বাস জানান, ঝাড়গ্রামের ‘কথাকৃতি’ নাট্যসংস্থার শিল্পীরা পথনাটিকাটি করছেন। এই সময় নাটকের প্রেক্ষাপটে পুজো রয়েছে। সুদীপ্তবাবুর কথায়, “মাওবাদী প্রভাবিত ঝাড়গ্রামের প্রত্যন্ত গ্রামে প্রচারে জোর দেওয়া হচ্ছে। জামবনি ও বেলপাহাড়ির অনগ্রসর এলাকাগুলিতেও এ ধরনের প্রচার হবে। পথনাটিকার পাশাপাশি, র্যালি ও আলোচনাসভারও আয়োজন করা হচ্ছে।” কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক সূত্রের খবর, যে সমস্ত গ্রামে প্রচার করা হচ্ছে সেই সব গ্রামের তালিকা রাজ্য সরকারই ঠিক করে দিয়েছে। |
গত কয়েকদিন ধরে ঝাড়গ্রামের আগুইবনি অঞ্চলের নিরামিষিপুর, নেতুরা, মুড়াবনি ও একতালের মতো গ্রামগুলিতে পথনাটিকার মাধ্যমে প্রকল্পটির কথা জানাচ্ছেন ‘কথাকৃতি’র শিল্পীরা। নাট্যকার ও নির্দেশক কুন্তল পাল বলেন, “নাটক দেখার পর গ্রামবাসীরাদের কাছ থেকে আমাদের শুনতে হচ্ছে, ‘কাছে পিঠে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। রাত বিরেতে জঙ্গল রাস্তায় যাওয়াও নিরাপদ নয়। সেজন্য অধিকাংশ প্রসব বাড়িতেই হয়’।” পথনাটিকা শেষে গ্রামবাসীদের সঙ্গে মতের আদানপ্রদান করতে গিয়ে চরিত্রাভিনেত্রী দেবলীনা দাশগুপ্তেরও একই অভিজ্ঞতা, “সরকারি এই প্রকল্প সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গও জানা নেই গ্রামবাসীদের।” স্থানীয় প্রৌঢ়া আরতি প্রধান সখেদে বলেন, “সরকার না জানালে গাঁয়ের বউবিটিরা এ সব জানবে কোথা থেকে।”
একতালের বধূ পেশায় অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী সুচিত্রা চেট্যালের কাজকর্ম প্রসূতি ও সদ্যোজাতদের নিয়েই। উপযুক্ত প্রচারের অভাবে জননী সুরক্ষা যোজনার আওতায় যে অনেককেই আনা সম্ভব হয়নি তা মেনে নিয়েছেন তিনি। তবে তাঁর সংযোজন, “বাড়িতেই প্রসবের একটা বড় কারণ, কাছে-পিঠে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেইও বিশেষ।” একতালের স্থানীয় বৃদ্ধ রাধাগোবিন্দ রাউৎ ও সমাজকর্মী অরবিন্দ ভুঁই বলেন, “স্থানীয় আগুইবনি পঞ্চায়েত অফিসের লাগোয়া উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রটিতে ঝাড়গ্রাম থেকে সপ্তাহে একদিন মাত্র চিকিৎসক আসেন। কাছাকাছি শয্যাবিশিষ্ট স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে যথাক্রমে ১০ ও ১৫ কিমি দূরে ঝাড়গ্রামের মোহনপুরে ও বেলিয়াবেড়া ব্লকের তপসিয়ায়। ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালের দূরত্ব ২৭ কিমি। রাতের বেলা জঙ্গল রাস্তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। কেউ অসুস্থ হলে বা কোনও প্রসূতির প্রসব বেদনা উঠলে তখন ভগবানই ভরসা।” এই পরিস্থিতিতে উপযুক্ত পরিকাঠামো না গড়ে এ ধরনের প্রচার কতটা কাজ দেবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে স্বাভাবিক ভাবেই। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের মুখপাত্র অসিত বিশ্বাসের আশ্বাস, “সারা রাজ্যে দারিদ্রসীমার নিচে থাকা বিপুল সংখ্যক প্রসূতিকে প্রতিদিনই জননী সুরক্ষা যোজনার আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। উপযুক্ত প্রচারের ফলে জঙ্গলমহলের চিত্রটাও এখন যথেষ্টই বদলে গিয়েছে। কয়েকটি জায়গায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দাবি রয়েছে। দাবি খতিয়ে দেখে উপযুক্ত পদক্ষেপ করা হবে।” |