যন্ত্রণা না পাওয়াই সব চেয়ে বড় যন্ত্রণা সাজিদের জীবনে
চার বছরের সাজিদ ঘোষি-র একটুও ব্যথা লাগে না। পড়ে গিয়ে রক্তারক্তি হলেও হাসে পশ্চিম মেদিনীপুরের বনশল গ্রামের এই ছেলেটি। গায়ে ইঞ্জেকশনের সূচ ফোটালে তার ভ্রূক্ষেপ নেই, ধাক্কা খেয়ে মাথা ফেটে গেলে, আগুনে পুড়ে হাতে ফোস্কা পড়লে বা বন্ধুরা জোরে খিমচে দিলেও টের পায় না সে!
এ সব শুনে সাজিদকে ফ্যান্টম বা হি-ম্যান জাতীয় বীরপুরুষ মনে হতে পারে, যার গল্প শুনিয়ে অন্য বাচ্চাদের সাহসী হওয়া শেখানো যায়। কিন্তু ব্যাপারটা সে রকম নয়। ব্যথা লাগার জন্য যে স্নায়ুগুলোর দরকার, সেগুলোই ওর ভোঁতা, অকেজো। চিকিৎসকদের ভাষায়, সাজিদ ‘পেনলেস কিড।’ মানসিক দুঃখ-কষ্ট থাকলেও শারীরিক বেদনার কোনও অনুভূতি তার নেই। গরম কাকে বলে, ঠান্ডা কী জিনিস, এ সম্পর্কে কোনও ধারণাই গড়ে ওঠেনি। গরমে একটুও ঘাম হয় না তার।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ব্যথা-মুক্ত সাজিদ অন্যদের চেয়ে ভাগ্যবান। কিন্তু এই ব্যথাহীন পৃথিবীর বাসিন্দা হওয়াটাই বারবার সাজিদকে প্রায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। কী ভাবে? চিকিৎসকরা বলেন, “যে ব্যথা কাকে বলে জানে না, তাকে ব্যথা থেকে সতর্ক করা যাবে কী ভাবে? হাত পুড়ে জ্বালা করবে জেনে লোকে আগুনে হাত দেয় না। পড়ে গিয়ে হাড়ে চোট লেগে ব্যথা করলেই তো লোকে চিকিৎসকের কাছে যাবে। তবেই তো ব্যথাটা চিহ্নিত হবে এবং সময়মতো চিকিৎসা হবে। সাজিদের তো ব্যথার বোধটাই নেই।” প্রতি মুহূর্তে কী করে তাকে আঘাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা যায়, সেই উপায় খুঁজতে দিশেহারা বাড়ির লোক আর চিকিৎসকরা।
সিপায় আক্রান্ত মেদিনীপুরের সাজিদ
সাজিদের রোগের বৈজ্ঞানিক নাম ‘কনজেনিটাল ইনসেনসিটিভিটি টু পেন উইথ অ্যানহাইড্রোসিস’ বা সংক্ষেপে ‘সিপা’। জিনবাহিত বিরল স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা, যার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শিশু চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ বলেন, “এই রোগে আক্রান্তদের শরীরের বাইরের অংশের ব্যথাবোধটাই থাকে না। কারণ, যে পেরিফেরাল স্নায়ুগুলি ত্বক থেকে অনুভূতি মস্তিষ্কে বহন করে, তাদের সেই স্নায়ুগুলিই অকেজো।” তাঁর কথায়, “এই রোগে আক্রান্ত বেশির ভাগ শিশুই মাথা ব্যথা বা পেট ব্যথার মতো জিনিসও টের পায় না। সাজিদ সেগুলো পায় কি না, এখনও জানতে পারিনি। কারণ সাজিদ এখনও সেটা ঠিক প্রকাশ করতে পারেনি।”
সাজিদের অন্য ভাইবোন কিংবা মাঠের কাজ সামলাতে ব্যস্ত বাবা ইসমত ঘোষি, মা শুভরাতন বিবির এত সময় নেই যে একা শুধু সাজিদকে চোখে-চোখে রাখবেন। তাই সাজিদের আঘাত অজানাই থেকে যায়। মাসখানেক আগে সেই পায়ের ঘা বেড়ে হাড় অবধি ছড়িয়ে গ্যাংগ্রিন হওয়ার দশা। কলকাতার পার্ক-সার্কাসে এক বেসরকারি শিশু হাসপাতালে এসে কোনওক্রমে সেই পা রক্ষা পায়। বেখেয়ালে হাতের আঙুলও অনেকটা চিবিয়ে ফেলেছে সাজিদ। ব্যথা লাগেনি, ফলে চিবিয়েই গিয়েছে। হাত ক্ষতবিক্ষত। বাধ্য হয়ে মুখের সব দাঁত তুলে ফেলা হয়েছে সাজিদের। কিন্তু এ ভাবে আর কত দিন? উত্তর জানা নেই চিকিৎসকেদের।
সাজিদের মতো শিশুদের কিন্তু ভয় পাওয়া, রাগ, দুঃখ, হাসির মতো মানসিক অনুভূতিগুলো থাকে। তারা পছন্দমতো জিনিস না পেলে ঘ্যানঘ্যানও করে। কারণ এগুলি নিয়ন্ত্রিত হয় কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে।
স্নায়ুচিকিৎসক শ্যামল দাসের কথায়, “পেরিফেরাল সেনসরি নার্ভের এক ধরনের তন্তু শরীরের বাহ্যিক আঘাতের অনুভূতিগুলি নিয়ন্ত্রণ করে। আর অটোনমিক ফাইবার নিয়ন্ত্রণ করে ঘাম হওয়া। এই শিশুদের ক্ষেত্রে এই দু’টি নার্ভ কাজ করে না।” স্নায়ুচিকিৎসক সিতাংশুশেখর নন্দীর কথায়, “অতি বিরল রোগ। ২০ বছর আগে আমি বেঙ্গালুরুর ‘নিমহানস’-এ এই রকম এক রোগী দেখেছিলাম। আঘাত বুঝতে পারে না বলেই সংক্রমণ থেকে অল্প বয়সেই এদের মৃত্যু হয়। আমাদের দেশে বিক্ষিপ্ত ভাবে এমন ঘটনা দেখা গেলেও নথিভুক্ত হয়নি, গবেষণাও হয়নি।”
১৯৮৩ সালে প্রথম এই রোগ ‘ডিসর্ডার’-এর তালিকাভুক্ত হয়। এখনও পর্যন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন জার্নালে এই রোগের সবচেয়ে বেশি রোগীর কথা (প্রায় ৩০০) নথিভুক্ত হয়েছে জাপানে। মায়ানমার, তাইল্যান্ড, জাপানে এমন কয়েকটি পরিবার পাওয়া গিয়েছে, যেখানে পরিবারের অনেকে এই রোগে আক্রান্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৮৪ জন রোগী মরক্কোয় ২ জন এবং নিউজিল্যান্ডে ১ জন রোগীর কথা নথিভুক্ত আছে। ভারতে এখনও এমন কোনও রোগীর নাম নথিভুক্ত করা নেই।
আমেরিকার টেক্সাসের বিগ লেক শহরে গ্যাবি বলে একটি মেয়ের খোঁজ পেয়েছেন চিকিৎসকরা। তার বয়স এখন ১১। তিন-চার বছর আগে আপন মনে চোখ চুলকোতে গিয়ে সে একটা চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়েছিল। গ্যাবির একটুও লাগেনি, কিন্তু চোখটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এখন কিছুটা বড় হওয়ায় সে আঘাতের কথা কিছুটা অনুমান করতে পারছে। তার ভিত্তিতে সে এখন নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
হয়তো কোনও দিন সাজিদও লড়াইটা করতে পারবে। কিংবা চিকিৎসা-গবেষণাই বাতলে দিতে পারবে, যন্ত্রণার বোধ কী ভাবে ফিরে আসতে পারে সাজিদদের শরীরে!
অ-বোধ
স্নায়ুর রোগ সিপা
• থাকে না ব্যথার অনুভূতি।
• বোঝে না বিপদ।
• নিরাময়ের পথ অজানা।
• শারীরিক সমস্যা হিসেবে প্রথম চিহ্নিত হয় ১৯৮৩-তে।

প্রথম সাড়া
• সিপায় আক্রান্ত বালক কারসনকে নিয়ে ২০০৯-এ ডিসকভারি চ্যানেলের অনুষ্ঠান ‘দ্য বয় হু নেভার ক্রায়েড’।

শিল্প-সাহিত্যে
• স্টিভেন জেমসের উপন্যাস দ্য রুক (চরিত্র ক্রেগটোন ম্যালিস), স্টেগ লার্সনেসের দ্য গার্ল হু প্লেড উইথ ফায়ার (চরিত্র ব্লন্ড জায়েন্ট)।
• চলচ্চিত্র বিরিভমেন্ট (চরিত্র মার্টিন ব্রিস্টল)।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.