|
|
|
|
পুজোয় যাত্রা-নাটকের ঐতিহ্য আজও অম্লান |
সুমন দে • মেদিনীপুর |
রোগী দেখার ফাঁকেই একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন পাঠ-খাতায়। এক লহমায় ভেবে নিলেন ওই দৃশ্যের জন্য ভঙ্গিটা ঠিক কী হওয়া উচিত। তারপরেই আবার জুটে গেলেন কাজে। দিনগুলো এখন এভাবেই কাটছে বছর ছেচল্লিশের নার্স রুবি চক্রবর্তীর। ঘর, গেরস্থালি, হাসপাতাল সব সামলে তবেই তো ‘নেশা’র জন্য সময় বের করছেন তিনি।
মেদিনীপুর মেডিক্যালে নার্স রুবির মতোই অবস্থা বাকিদেরও। গৃহবধূ শেলি মণ্ডল, রিঙ্কু পড়িয়া, ব্যাঙ্ক অফিসার বিনয় রায়, ব্যবসায়ী অরূপ হাজরা বা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী দুলাল আঢ্যস প্রত্যেকেই প্রাত্যহিকী থেকে চুরি করছেন সময়। আর সেই সময় বঁচিয়ে ছেলেবেলায় ফিরছেন তাঁরা। বহু বছর ধরে যাত্রা, নাটক বা নাচ-গান শুধু স্মৃতি হয়েই ছিল। আর এখন তাঁদের ছেলেমেয়েরাই স্কুল, কলেজে পড়ে। এই বয়সে এসেই স্মৃতির আগল ঠেলে আবার নিজেদের মেলে ধরেছেন তাঁরা। প্রতি বছরের মতোই এবারও যাত্রা, নাটক, নৃত্যনাট্য, সঙ্গীত পরিবেশন করবেন নিজেরা, ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই। |
|
নাটকের মহলায় ব্যস্ত রামকৃষ্ণনগরের বাসিন্দারা। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল। |
রুবিদেবী বলেন, “অভিনয়, নাচ, গান করতে না পারলে মনে হয় পুজোটাই বৃথা। ভাবতে পারেন, কখন সেই ছোটবেলায় স্কুলে দু’একবার অভিনয় করেছি। আর এখন ৪৬ বছর বয়সে আবার সেই অভিনয়ে। পাড়ার সকলে মিলে এই চর্চা করায় এই বয়সে নাচটাও শিখে নিয়েছি!”
এঁরা সকলেই মেদিনীপুর শহরের রামকৃষ্ণ নগরের বাসিন্দা। তাঁদের মতে, বর্তমানে যাত্রা, নাটকের মতো লোক সংস্কৃতি গ্রামগঞ্জ থেকেও উঠে যেতে বসেছে। পরিবর্তে জায়গা করে নিচ্ছে ডিজে, হাঙ্গামা, ধামাকা। তাই এই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতেই প্রতি বছরই পুজোয় যাত্রা, নাটকের আয়োজন করেন তাঁরা। এমনকী অভিনয়ও করেন নিজেরাই। বাদ যান না মহিলারাও। এখন যদিও মফস্বলের কিছু জায়গায় বাড়ির মেয়েদের যাত্রা বা নাটকে অভিনয় করা নিয়ে নানা কটু মন্তব্য শোনা যায়। কিন্তু এ দিক দিয়ে রামকৃষ্ণনগর সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের। যেখানে বাবা-ছেলে, মা-মেয়ে-সকলেই একসঙ্গে অভিনয়, নাচ, গানে মেতে ওঠেন। গোলাড় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সুরেশ পড়িয়ার স্ত্রী রিঙ্কু পড়িয়া বলেন, “বাড়ি থেকে বাধা দেবে কী? বরং উৎসাহ জোগায়। শাশুড়িমা অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি থাকায় রিহার্সালে যেতে পারিনি। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেই শাশুড়িমার অর্ডার, আমি সুস্থ, বৌমা তুমি রিহার্সালে যাও। নাহলে অভিনয়টা ভাল করতে পারবে না।”
এবার পুজোর চারদিনের একদিন হবে যাত্রাপালা। নাম ‘সোনাই দিঘী’। বাকি দু’দিন নাটক ‘একটি অবাস্তব গল্প’ (পুরুষদের) অন্যটি ‘মুক্তির উপায়’ (মহিলাদের)। যাত্রাতে নায়ক হচ্ছেন পাড়ার ব্যবসায়ী অরূপ হাজরা, আর নায়িকা পাড়ারই গৃহবধু শেলি মণ্ডল। শেলির কথায়, “ছোট বেলায় গান শিখেছি। তবে অভিনয় করিনি। অভিনয়টা শিখেছি, বিয়ের পর। এই পাড়াতে এসেই। ” যাত্রায় অভিনয় করবেন পাড়ার বাসিন্দা তথা মেদিনীপুর কলেজের জুওলজির শিক্ষক শ্যামল ঘোষ, তাঁর ছেলে ফিজিক্স অনার্সের ছাত্র সৌমেন্দু, ব্যাঙ্কের অফিসার বিনয় রায়, লক্ষ্মী মণ্ডল, স্কুল শিক্ষক হেমেন মিশ্রের স্ত্রী করবী মিশ্র সকলেই। যাত্রা নাটকের বাইরে রয়েছে নৃত্যনাট্য ‘অসুর দলনী’, ও ‘শ্রীরাধার মান ভঞ্জন’। যোগ দিচ্ছেন বড় থেকে ছোট সকলেই। সপ্তম শ্রেণির সৌমিলী শ্রীরাধার মান ভঞ্জনের রাধিকা। সে বলে, “টিউশনের জন্য নিয়ম করে রিহার্সাল দেওয়া হয় না। তবে রাতে কারও না কারও বাড়িতে ঠিকই দিয়ে নি।”
এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা ও ভাড়াটিয়া মিলিয়ে প্রায় আড়াইশ পরিবারের বাস এই পাড়ায়। পুজোর চারদিন এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মজে থাকেন সকলেই। ছোট্ট বেলার স্মৃতি রোমন্থন নয়, স্মৃতির আগল ঠেলে বেরিয়ে এসে ফের নতুন করে বয়স্করাও অভিনয়, নাচ, গান শেখেন, তা মঞ্চস্থ করে সকলকে আনন্দও দেন। তবে অন্যকে আনন্দ দেওয়া শুধু নয়, এ আনন্দ তো নিজেরও জন্য। এই চারদিনের ভাললাগা নিয়েই তো কাটবে বাকিটা বছর। |
|
|
|
|
|