মন্দারমণির অবৈধ হোটেলকে স্বীকৃতির উদ্যোগে প্রশ্ন
ছন্দহারা ঢেউয়ে বালি আলগা,কাদায় দুর্গম স্বপ্নের বেলাভূমি
রিবেশকর্মী ও বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা মিলে গিয়েছে। মন্দারমণিতে বেলাভূমির বালি সরে বেরিয়ে পড়েছে কাদা। কাদায়-কাদায় দুর্গম হয়ে উঠছে সমুদ্রের জলে ধোয়া একদা মসৃণ তট।
আর বেলাভূমির এই অবক্ষয় অব্যাহত থাকলে ভ্রমণপিপাসু বাঙালির নবীন গন্তব্যটির ভবিষ্যৎ দ্রুত অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞদের একাংশ। যে বিপর্যয়ের জন্য তাঁরা আঙুল তুলেছেন সাগরতটে নির্বিচার হোটেল নির্মাণের দিকে। কেন?
ওঁদের দাবি: এতে প্রকৃতির স্বাভাবিক ছন্দে আঘাত পড়ছে। তার জেরেই বিপত্তি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞানের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্রের কথায়, “সমুদ্রের ঢেউকে তার নিজস্ব গতিতে পুরোটা বয়ে যেতে দিতে হবে। না হলে ঢেউ হোটেলের পাঁচিলে ধাক্কা মেরে ফিরে যাওয়ার সময়ে অনেক বেশি বালি নিয়ে যাবে। এই প্রক্রিয়াকে পরিভাষায় বলে রিফ্লেকশন অব ওয়েভ।’’
এ ভাবেই মন্দারমণির বেলাভূমিতে বহু জায়গায় কাদা বেরিয়ে পড়ছে বলে বিশেষজ্ঞদের দাবি। তটভূমির নিরাপত্তায় ১৯৯১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার প্রণীত কোস্টাল রেগুলেশন জোন (সিআরজেড) বিধি মোতাবেক, ভরা জোয়ারে সমুদ্রের জল যতটা পৌঁছায়, তার পাঁচশো মিটারের মধ্যে কোনও রকম বাণিজ্যিক নির্মাণ বেআইনি।
বালি সরে বেরিয়ে পড়েছে মাটির কঙ্কাল। সমুদ্রতটের এখন এই অবস্থা। —নিজস্ব চিত্র
২০১১-য় তাতে যে সংশোধনী আনা হয়েছে, সেখানেও পাঁচশো মিটারের নিষেধাজ্ঞাটি বহাল। তা সত্ত্বেও বেলাভূমি ‘দখল’ অন্তত ৮০টি হোটেল গজিয়ে উঠেছে। তারা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ছাড়পত্র পর্যন্ত নেয়নি বলে অভিযোগ।
ফলে ক্রমশ রুগ্ণ থেকে রুগ্ণতর হচ্ছে মন্দারমণির বেলাভূমি। বালুক্ষয়ের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছে অবাধ গাড়ি চলাচল। মন্দারমণির কিছু ‘তিন তারা’ মার্কা হোটেলে গাড়ি নিয়ে যেতে হলে বেলাভূমির উপর দিয়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই, কারণ হোটেলগুলোর পিছন দিকে ইট-সুড়কি ফেলা রাস্তাটি অত্যন্ত সরু। কাজেই ‘ট্যুরিস্টদের সুবিধার্থে’ সমুদ্রতটেই কংক্রিটের রাস্তা তৈরি হয়ে গিয়েছে। তার উপর দিয়ে রোজ চলছে হাজারো গাড়ি, মালবোঝাই ট্র্যাক্টর, লরি। এমনকী, কাঁথি-মন্দারমণি রুটে যে দশ-বারোটা ট্রেকার চলে, সেগুলোর যাত্রাপথ ওটাই।
স্বাভাবিক ভাবে বালিতে ক্ষয় ধরছে আরও বেশি। লাগোয়া দাদনপাত্রবাড়ের প্রবীণ মৎস্যজীবী মন্টুরাম মণ্ডলের আক্ষেপ, “ভারী ভারী লরি আর ট্র্যাক্টর হোটেল তৈরির মালপত্র বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের ধার দিয়ে। ট্যুরিস্টদের গাড়ি, ট্রেকার তো আছেই। চাকায়-চাকায় বালি আলগা হয়ে পড়ছে। জোয়ারের ঢেউয়ের ধাক্কায় আলগা বালি সরে বেরিয়ে আসছে কাদা-মাটি।”
এতে যে শুধু পর্যটকেরা অসুবিধায় পড়ছেন তা-ই নয়। কাদার গেরোয় মাছ ধরার কাজেও রীতিমতো সমস্যা হচ্ছে বলে মৎস্যজীবীদের অনেকের অভিযোগ। উপরন্তু ব্যাহত হচ্ছে জৈব-শৃঙ্খল। “মন্দারমণির বেলাভূমিতে প্রচুর লাল কাঁকড়া ছিল। তটরক্ষায় যাদের ভূমিকা যথেষ্ট। কিন্তু ভারী গাড়ির দৌরাত্ম্যে লাল কাঁকড়া হারিয়ে গিয়েছে। তাতে বিস্তর বেড়ে গিয়েছে বালুক্ষয়ের হার।” বলেন অভিজিৎবাবু। হোটেল-মালিকেরা কী বলছেন?
ওঁদের হিসেবে, মন্দারমণির পর্যটনের সঙ্গে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষের রুটি-রুজি জড়িত। বছরে পর্যটক আসেন গড়ে অন্তত এক লাখ। কিন্তু যার আকর্ষণে মানুষ মন্দারমণিতে ভিড় জমায়, সেই দীর্ঘ, মসৃণ বেলাভূমির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁরা বিশেষ ভাবিত নন। বরং এখানকার হোটেল-মালিকদের সংগঠন ‘মন্দারমণি হোটেল অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক দেবদুলাল দাসমহাপাত্রের দাবি, “প্রাকৃতিক নিয়মেই বেলাভূমির কাদা বেরিয়ে পড়ে। কাদা আবার কোনও দিন বালিতে ঢেকে যাবে।” কালিন্দী গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সীতাংশু গিরিও মনে করেন, বেলাভূমির ক্ষয়ের পিছনে সমুদ্রতটে হোটেল তৈরির কোনও ভূমিকা নেই। ‘‘এ জন্য প্রাকৃতিক কারণই দায়ী।” মন্তব্য তাঁর।
মন্দারমণির দিকের বেলাভূমিতেই কাদার বহর বেশি। সেখানে গত আট বছরে সমুদ্রের গা ঘেঁষে মাথা তুলেছে সার-সার হোটেল। ওই দিকটা ভরে যাওয়ার পরে এখন দাদনপাত্রবাড়ের দিকে নিত্যনতুন হোটেল তৈরি হচ্ছে একই ভাবে, বেলাভূমি দখল করে। সেখানেও তটভূমিতে বালুক্ষয়ের সূচনা ইতস্তত চোখে পড়ছে। তবে ‘পর্যটন-দূষণের’ দাপট সর্বত্রই স্পষ্ট। কী রকম?
বিভিন্ন বড় ও নামী হোটেলের সামনে সমুদ্রতট জুড়ে ছড়ানো ডাবের খোলা, পলিপ্যাক, চিপসের প্যাকেট, আইসক্রিমের কাপ। ঢেউয়ের টানে এগিয়ে-পিছিয়ে শেষ পর্যন্ত সেগুলো গেড়ে বসে বালিয়াড়িতে। তটভূমির ওই জঞ্জাল হামেশাই জালে আটকে মাছ ধরাও বরবাদ হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে আছে প্রবল শব্দ ও বায়ু দূষণ। সৌজন্য, হোটেলে-হোটেলে বসানো অতিকায় সব জেনারেটর। উল্লেখ্য, পরিবেশ ছাড়পত্র না-থাকায় কোনও কোনও হোটেলে বিদ্যুতের লাইন নেই।
তাই পর্যটকদের আলো জোগাতে রাতভর ডিজেল পুড়িয়ে জেনারেটর চলছে। আঁধারে ডুবছে মন্দারমণির পরিবেশ-ভাগ্য।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.